একবার আমাদের এক বন্ধুর মাথায় মাল উঠে গেলো। জানালো, সে শিল্প করবে। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে সবসময়ই কারো না কারো সাথে এরকমটা হয় এবং এবার অনেকদিন ধরে কারো মাথায় নতুন করে মাল ওঠে নাই বলে আমরা ব্যাপারটা মোটামুটি স্বাভাবিকভাবেই নিলাম এবং বিজ্ঞ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম- হ্যাঁ, ওর শিল্পই করা উচিৎ।
শিল্প করার অংশ হিসেবে অচিরেই সে রঙ-তুলির বাজারে ঘোরাফেরা শুরু করলো এবং একটা সস্তা ক্যানভাস কিনে এনে ঘরে বসে ক্ষুধার্ত মানুষের ছবি আঁকতে লাগলো। আমরা সময় পেলেই ওর চিলেকোঠার ঘরটায় চলে যেতাম। সারা মেঝেতে ছড়িয়ে থাকতো ব্রাশ, কাগজ আর কেরোসিনের গন্ধ। আমরা আগ্রহ নিয়ে সেসব দেখতাম। ওর মা নিজের মন্দভাগ্যকে দোষারোপ করতে করতে আমাদের চা আর টোস্ট বিস্কিট খেতে দিতেন।
কিছুদিন পর জানতে পারলাম আমাদের বন্ধুটি এবার নতুন শিল্প করছে; কবিতা লিখছে। তার ঘরটি তখন এলোমেলো হলেও পরিচ্ছন্ন। তবে সেখানে গিয়ে আর তার খোঁজ পাওয়া যায় না। সে সকালে বেরিয়ে যায়, কাঁধে একটি চটের ব্যাগ নিয়ে সারাদিন পথে পথে ঘুরে। আর রাতের বেলা ছাদে বসে অদ্ভুত সব উপমা দিয়ে আরো অদ্ভুত সব কবিতা লিখে। সেসব পড়ে আমরা আড়ালে মুখ টিপে হাসি। একবার শুনলাম সে নাকি বই ছাপাবে। বইয়ের নাম 'মরণফাঁদ'। আমরা উৎসাহের সাথে মাথা নাড়লাম, বেশ খাসা হয়েছে নামটা।
তারপর বেশ কয়েক বছর পেরিয়ে গেছে। বন্ধুদের কারো সাথে ঐভাবে যোগাযোগ নেই। আমাদের সেই বন্ধুটির শিল্পেরও আর কোনো খোঁজ রাখা হয়নি। একদিন ছুটির দিনে ঘরে বসে পত্রিকা ওল্টাচ্ছি। হঠাৎ পত্রিকার পাতায় ওর ছবি দেখে চমকে উঠলাম। চেনাই যাচ্ছে না ওকে। বাঁ গালের উপর কাটা দাগটা না থাকলে চিনতাম কিনা কে জানে।
ছোট মেয়েটা কোলের উপর বসেছিলো। হঠাৎ আমার এমন থমকে যাওয়া ওর চোখ এড়ালো না।
'উনি কে, বাবা?'
চুপ করে রইলাম। কখন যেন এক ফোঁটা নির্লজ্জ জল গড়িয়ে পড়লো পত্রিকার পাতায়- যেখানে পুলিশের গুলিতে আন্দোলনরত এক যুবকের মৃত্যু সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। আমার বন্ধুটির রক্তে ভেজা দেহের পাশেই পড়ে আছে প্ল্যাকার্ডটা। তার মতোই রক্তাক্ত। তাতে কালো কালিতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা- 'মানুষকে বাঁচতে দিন'।
ভীষণ কাঁপছিলো চারপাশ। আমি টুনটুনিকে আমার দুর্বল বুকে আরো শক্ত করে চেপে ধরে অস্পষ্ট কণ্ঠে ফিসফিস করলাম, 'ও একজন শিল্পী। একেবারে জাতশিল্পী।'
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০১৭ রাত ১২:২৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




