somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ll--দ্বিতীয় জীবন--ll ( প্রথম পর্ব )

২৪ শে জুন, ২০১২ বিকাল ৩:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




আমি তার জন্য অপেক্ষা করে আছি।

ঘড়ির কাটা টিক টিক শব্দ তুলে জানিয়ে যাচ্ছে তার গতিময়তা। তার পরম গতিকে বাড়ানো বা কমানোর সাধ্য আমার নেই। এখন বাজে ৯. ৩৫। আরও দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। সাড়ে এগারোটার দিকে সে আসবে। ডিনার করবো তখন।

চিন্তা থামিয়ে নোটপ্যাডে মনোযোগ দিলাম। মনটা কোন এক কারনে বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। লেখার আগ্রহ পাচ্ছিনা। গত দুমাস ধরে সমস্যাটা প্রকট আকার ধারণ করেছে। লেখালেখিতে বাধাগ্রস্ত হলে আমার মাথা ঠিক থাকে না। অস্থির অস্থির লাগে। এখনও নিজেকে খুজে পাচ্ছিনা। কলম চলছে না। আমার লেখনীশক্তি মনে হয় অতি দ্রুতই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

টেবিল ছেড়ে ইজি চেয়ারে এসে বসলাম। একটা সিগারেট ধরালাম। রুমের মাঝে তেমন আলো নেই। শুধু টেবিল ল্যাম্প এর আলোটা আছে। আমার এমনিতেও আকাশ পাতাল কাঁপানো চোখ ধাঁধানো আলো ভালো লাগে না। রুমে কখনো টিউবলাইট ও জ্বালাই না। আধা আলো, আধা অন্ধকারের এই রূপটাই আমার কাছে বেশি ভালো লাগে।

সারাদিন একা একা থাকি। আমার রুমেই থাকি। কারো সাথে কথা বলার কোন আগ্রহ হয়না। রাত জাগি, দিনে ঘুমাই। আগেও অসামাজিক ছিলাম, এখনও আছি। অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। তবে এটা ঠিক যে, অসামাজিক মানুষের সমাজ থেকে দুরে থাকতে হয়। সমাজে থাকলে আমার সমস্যা, বাকি মানুষগুলোরও সমস্যা। কারন আমার জীবন যাপন প্রক্রিয়ার সাথে সুস্থ স্বাভাবিক কারোরই জীবন যাপন ধারা মিলে না। এমনকি আমার বাবা মা এর সাথেও না। তারা আলাদা থাকে। আমিও আমার মতো একা থাকি।

কি করবো? অনেক আগে থেকেই এই অবস্থা। জীবনে সবচেয়ে বেশি যে কথাটা শুনেছি সেটা হচ্ছে- "মানুষ হও!" বাবা মা এর মুখে, শিক্ষকের মুখে, আমার প্রেয়সীর মুখে।
যদিও কোন লাভ হয়নি। নিজেকে বদলানোর বিন্দুমাত্র আগ্রহবোধ তৈরি হয়নি কখনো আমার মধ্যে। আমি যেই কে সেই অসামাজিকই রয়ে গেছি।

যূথী কেন আগে আমাকে ভালোবাসতো, আমি জানিনা। মেয়েদের আসলে বোঝা কঠিন। তারা প্রথম দিকে কোন ছেলের নির্লিপ্ততা দেখে আকৃষ্ট হয়, বেলা শেষে সেই নির্লিপ্ততাকেই ঘৃণা করে। দীর্ঘ সময় পরে ছেলেদের এই গা ছাড়া স্বভাব আর তাদের ভালো লাগে না। যূথী শেষের দিকে এটা নিয়ে আমার সাথে প্রতিদিন রুটিন করে ঝগড়া করতো। আমার কোন কাজই তার ভালো লাগতো না। আমি যে বেলা করে ঘুমাই, সেটা না, আমি যে একটু লেখালেখি করতাম, এমনকি সেটাও না। আমার প্রতি তার অজস্র অভিযোগ জমে গিয়েছিলো। চিৎকার করে সে তার সেই সব অভিযোগগুলোকে মুক্তি দিতে চাইতো। আমি নির্বিকার ভাবে সব শুনতাম। যূথীর ক্ষেত্রে আমি ছিলাম একটা গাছ মানব। গাছ মানবরা শুধু অভিযোগ শুনেই যায়, কখনো কিছু বলেনা। আমিও শুনতাম। সকাল বিকাল দুইবেলা করে শুনতাম। শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যেতাম। তার চিৎকারে একসময় আমার ঘুম না ভেঙে আরও গভীর হতো। অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো আরকি।

যূথী আমাকে নিয়ে অনেক হতাশ হয়ে গিয়েছিলো হয়তো। আবার নাও হতে পারে। হয়তো পরিকল্পনাই তার ভিন্ন ছিলো। কি জানি, জানি না। না জেনে কাউকে দোষারোপ করা ঠিক না।

৩ বছর একসাথে থেকে,আমাদের বিয়ের ঠিক আগে আগে, কোন ঘটনা ছাড়াই সে ঠাস করে আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। যাবার আগে বলে গেলো-

"আমি চলে যাচ্ছি। ভালো থেকো। আর এটা জেনে রেখো, তোমাকে বিয়ে করে সংসার করা কোন মেয়ের পক্ষে কোনোদিন সম্ভব হবে না।"

সে চলে গেলো। ভালো দেখে একটা ছেলে বিয়ে করলো। আমার মতো বাউন্ডুলে, অসামাজিক আর অভদ্র না, ভদ্র। আমি সবই শুনলাম। কিন্তু কিছুই করলাম না। চুপচাপ বসে রইলাম।

এতোটাই হঠাৎ করে সে চলে গেলো যে আমার এটা বুঝতে সময় লাগলো, আমার প্রিয় মানুষটি আর আমার পাশে নেই। আমি আসলে তাৎক্ষনিকভাবে বিশ্বাস করতে পারেনি এমনটা হতে পারে। ভালোবাসার মানুষটির ছেড়ে চলে যাওয়া অনেকটা মৃত্যুবাড়ির মতো। মৃত্যুবাড়িতে কেউ মারা যাওয়ার পর প্রথম আধা ঘণ্টা খুব কান্নাকাটি হয়, এরপর হঠাৎ করেই সবকিছু শান্ত হয়ে আসে। কাছের মানুষগুলো টের পায়না যে তাদের কেউ একজন তাদের ছেড়ে চলে গেছে। বুঝতে পারে তিন চার দিন পর, যখন আস্তে আস্তে দুর থেকে আসা আত্মীয় স্বজনরা বিদায় নিয়ে চলে যায়।

কেউ চলে গেলে প্রকৃতি নিজে থেকেই কিছু পরিবর্তন চায়। কম্পেন্সেটরি মেকানিজম অফ ন্যাচার। যূথী চলে যাওয়ার পর আমারও বেশ কিছু পরিবর্তন হলো। অতি দ্রুত, কিন্তু অন্য ৮-১০ জনের মতো নয়। আমার তেমন কষ্ট হলো না, আমি ভেঙেও পড়লাম না। যূথীর জন্য কোন আহা উহু বোধ হলো না আমার। বরং আমার পরিবর্তন হলো অন্যরকম। আমি সবকিছুর উপর থেকে ধীরে ধীরে আগ্রহ হারালাম।

আগে রাস্তায় রাস্তায় টো টো করে ঘুরে বেড়াতাম, পার্কে বসে থাকতাম, সেই অভ্যাস হঠাৎ করেই কোথায় হারিয়ে গেলো। তার বদলে আমি ঘরকুনো হয়ে গেলাম। দিনরাত কাটতে লাগলো আমার ছোট্ট রুমটাতে বসে। দিনের সময়গুলো লম্বা হয়ে গেলো। আমি বসে বসে অর্থহীন হাবিজাবি চিন্তা করতাম। চিন্তার কোন আগা নাই, মাথা নাই। লেখালেখির মাত্রা বেড়ে গেলো বহুগুণ। নিজেকে গুছিয়ে নিতে গিয়ে আমি আরও বেশি অগোছালো হয়ে গেলাম।

অবশ্য এরকম করে সময় কাটাতে আমার খারাপ লাগতো না, বরং ভালোই লাগতো। বেশি বন্ধু বান্ধব কোন কালেও ছিলো না। যারা ছিলো তাদের সাথেও যোগাযোগ কমিয়ে দিলাম। তারা ছিলো আসলে ভাইরাসের মতো। তাদের থেকে দুরে সরে নিজেকে অনেকটাই ভারমুক্ত মনে হতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে আমি সমাজ থেকে আলাদা হয়ে গেলাম।

আমার পৃথিবীটা অনেক আগে থেকেই একা ছিলো। না, একা না, সেখানে শুধু যূথী ছিলো। যার কাছে আমি নিজেকে খুঁজে ফিরতাম কোন এক কালে। ও চলে যাওয়ার পর আমি আরও বেশি একা হয়ে গেলাম। সত্যিকার ভাবে আমার একাকীত্বকাল শুরু হলো।

আমার এই একাকীত্বকালে আমি অনেক কিছু শিখেছি। জীবন দর্শন, কিছু নির্মম সত্য, অনুভূতির নানা রূপ। আমি প্রচুর চিন্তা করে আমার সময় কাটাতাম। একটা সময় এমন হলো যে চিন্তা ভাবনাগুলো আমাকে গভীরভাবে পেয়ে বসলো। রাতে ঘুম আসতো না, গুঢ় কিছু উপলব্ধি এসে মাথায় জট পাকিয়ে থাকতো। তারা আশ্রয় নিলো আমার নোটবুকে।

লিখতে লিখতে আমি আবিষ্কার করলাম, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য আসলে খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই। একটা কলম, একটা নোটপ্যাড আর শরীরটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কিছু পুষ্টিই যথেষ্ট। ৬ মাস ধরে একটা চাকরি করতাম ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে, বাবার পরিচিত। সে কারনে অনিয়মিত হলেও চাকরি টিকে ছিলো। মহানন্দে আমি সেই চাকরি ছেড়ে দিলাম।

আমার এহেন পরিবর্তন আমার পিতা মাতার দৃষ্টি এড়ালো না। তারা প্রথম কয়েকদিন দেখলেন, হয়তো এটা ভেবে যে শখের পাগলামি, দু দিন পরেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কালক্রমে যখন সেটা একেবারে গেড়ে বসলো, তখন আমার পিতা ও মাতা দুজনেরই কপালে সুস্পষ্ট ভাজ পড়লো। অবশ্য আমি তাঁতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে আমার মতোই জীবনযাপন করতে লাগলাম।

আমাকে অসামাজিক থেকে অতিমাত্রায় সামাজিক করার জন্য তারা বোধকরি আমার জন্য মেয়ে দেখা শুরু করলেন। কানের কাছে এসে ঘ্যান ঘ্যান করে মা যখন কোন মেয়ের কথা বলতো, আমি তখন আমার নিজের চেতনার জগতের নেশায় বুঁদ হয়ে ডুবে চুর। আমি কোনকালে অন্য কোন মেয়ে দেখা নিয়ে কোন আগ্রহ বোধ করিনি এবং মা কে একবারের বেশি দুবার বুঝানোর ইচ্ছাটা পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি।

একদিনের কথা বলি। সেদিন সকাল সকাল এসে মা তার নিয়ম মতো কথার মোটর স্টার্ট দিয়েছেন। আজও তার কথার প্রধান এবং একমাত্র বিষয়বস্তু- বিয়ে। বাবার কোন এক ছোটবেলার বন্ধু নাকি আছে, তার নাকি অতি সুন্দরী একটা মেয়ে আছে, তার কথা। আমি বসে বসে শুনছি। ঘুম পাচ্ছে, কথা শুনতে ইচ্ছা করছে না। মা কে থামাতেও ইচ্ছা করছে না। কেউ কথা বলতে থাকলে কথার মাঝে তাকে থামানো অভদ্রতা। ছোটবেলার বিদ্যা।

মেয়ের সব গুন বর্ণনা শেষে মা প্রশ্ন করলেন-
"তো, এখন তোর কি মত?"
আমি হাই তুলে বললাম- "আমার মত হলো মেয়েটা অনেক ভালো। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভালো।"
মা এর চোখমুখ একশ ওয়াটের বাল্বের মতো উজ্জ্বল হয়ে গেলো। বললেন-
"তো কি করা যায় বল তো। দেখি মেয়েটা, নাকি?"

আমি হাই তুলতে তুলে বললাম- "মা, আমি এখন ঘুমাবো। কারো সাথে সংসার করার কোন ইচ্ছা আমার নেই। আর শোন, সব সময় কানের কাছে এসে ভ্যাজর ভ্যাজর করবে না। কেউ বেশি কথা বললে আমার বিরক্ত লাগে।"

মা থতমত খেয়ে গেলেন। তিনি বোধ হয় ভেবেছিলেন আমি মিষ্টি জাতীয় কিছু বলবো। রাগী গলায় বললেন-
"তো কেন বললি মেয়ে খুব ভালো? আমার সাথে ফাজলামি করিস তুই?"

আমি অবাক হয়ে বললাম-" তো মেয়ে কি খারাপ? যে মেয়ের এতো গুন তাকে আমি খারাপ বলবো নাকি? আমি বিয়ে করবো না সেটা আমার সমস্যা। মেয়ের সমস্যা তো না।"

"তোর ভং দিন দিন বাড়ছে। এক থাপ্পড় দিয়ে তোর সব কটা দাঁত ফেলে দেওয়া দরকার।"

মা গজর গজর করতে করতে চলে গেলেন। আহ, শান্তি। শান্তি এর অপর নাম সকাল বেলার ঘুম। আফসোস, এটা এই বাড়ির কেউ বুঝলো না।

রাতে খাবার টেবিলে বাবা বললেন-
"শুনলাম তুমি নাকি বিয়ে করবে না বলে ঠিক করেছো?"
"হ্যাঁ, ঠিক শুনেছেন।"
বাবা মেঘস্বরে বললেন- "কেন জানতে পারি?"
"অবশ্যই জানতে পারেন। বলবো?"

বাবা আবারো বিষদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। বললেন-
"বলো।"

আমি ছোটখাটো একটা বক্তৃতার জন্য প্রস্তুত হলাম। গম্ভীর গলায় বললাম-
"মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে পরনির্ভরশীলতা। আমি আমার দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। আমার জীবনে সত্যিকার অর্থে আর কোন মানুষের প্রয়োজন নেই। কারো সাথে সংসার করাটা আমার কাছে উটকো একটা ঝামেলা ছাড়া আর কিছু না। তাছাড়া আমি এখন থেকে নিয়মিত লেখালেখি করবো বলে ঠিক করেছি। সেখানে আরেকজনের উপস্থিতি আমাকে যন্ত্রণা দেবে। সবচেয়ে বড় কথা- আমি এরূপ নারী পুরুষ সম্পর্কে বিশ্বাস হারিয়েছি। আমি ভালবাসায় বিশ্বাস করিনা। যে মেয়ে আমার সাথে থাকতে আসবে, সে খামোখাই কষ্ট পাবে। আমি ইচ্ছা করে কাউকে কষ্ট দিতে চাই না।"

"বটে! আর চাকরি বাকরি? সেটাও কি আর করবে না বলে ঠিক করেছো?'"
"চাকরি বাকরি করার প্রয়োজন দেখছি না এখন। প্রয়োজন হলে দেখা যাবে।"
"তুমি নিশ্চয়ই ভালো করে বুঝছো যে, তোমাকে আমি বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবো না?"
আমি বললাম-" আমি সেটা জানি। আমার অন্নসংস্থান নিয়ে আপনার চিন্তা করার কিছু নেই। ওটা আমার কলম দিয়েই আমি করে নেবো।"

মা ফোঁস করে উঠলেন- "নবাবজাদার আজকাল বড় ডাঁট। নবাবজাদা দু পাতা লিখেই লেখক হয়েছেন। নবাবজাদাকে আজকাল কিছু বলে কয়ে ছোঁয়ানো যায়না। বললেই উনার গায়ে ফোস্কা পড়ে।"

বাবা বললেন-" শুনলাম, আজকাল নাকি তুমি মানুষজনকেও খুব একটা সহ্য করতে পারছো না? ঘটনা কি সত্যি?"
আমি বললাম-"জি, সত্যি। আমার একা থাকতে ভালো লাগছে। আমি কয়দিন একটু একা থাকতে চাই।"
"তুমি সমাজে আছো কেন? জঙ্গলে যাও। বন-জঙ্গলে যেয়ে ছাল বাকল পড়ে বসে থাকো। স্টুপিড কোথাকার।"

আমি টেবিল ছেড়ে উঠতে উঠতে বললাম-" জঙ্গলে পরে যাবো। আপাতত একটু ত্রিশাল যেতে চাচ্ছি। আশাকরি, আমি ত্রিশালের বাসায় গেলে আপনাদের কোন সমস্যা নেই।"

ত্রিশালে আমাদের আরেকটা বাড়ি। বাবা শখ করে কিনেছেন। অতি হুলস্থূল ধরনের বড়লোক মানুষদের মাঝে মাঝেই কিছু উদ্ভট শখ জাগে। আমার বাবারও তাই। ত্রিশালে বাড়ি কিনে তিনি ফেলে রেখেছেন। কেউ থাকেনা। শুধু একজন কেয়ারটেকার আছে। তার নাম ইদ্রিস মিয়া। সে দেখাশোনা করে।

দুদিনের মাঝেই আমি ত্রিশালের বাড়িতে চলে এলাম। বেশ বড়সড় দোতালা বাড়ি। বাড়ির সামনে বাগান। বাগানের শেষে ছোট পুকুর। স্বচ্ছ তার পানি। বাগানে ঘাস ছোট ছোট করে কাটা। একটা দোলনা আছে। সন্ধ্যার পর এসে আমি দোলনায় বসি। একা একা আকাশ দেখি। রাতে লেখালেখি করি। আর দিনে নাক টেনে ঘুমাই। পারফেক্ট লিভিং থিং।

একা একা এই পরিবেশে থেকে আমি দিন দিন আরও অসামাজিক হয়ে যাওয়া শুরু করলাম। জীবন দর্শন সম্পর্কে আগে যা ছিলো শুধুই ধারনা, তা একেবারে অন্ধ বিশ্বাসে পরিণত হতে লাগলো। এটা অনেকটা গাছের মতো, উপযুক্ত পরিবেশ পেলে একেবারে ডালপালা ছড়িয়ে বড় হয়ে ওঠে। আমার দৃষ্টিভঙ্গির আরও পরিবর্তন হলো। প্রচুর লিখলাম আমি।
নিজেকে খুঁজে পেতে শুরু করলাম নির্জনতা আর একাকীত্ব এর মাঝে।

নিরুদ্রবে তিন মাস কাটিয়ে দিলাম এখানে। ঠিক করলাম আমি আর ঢাকা ফিরে যাবো না। আমার জন্য সবচেয়ে প্রশস্ত পরিবেশ এটাই। এই পরিবেশ ছেড়ে যেয়ে ঢাকা থাকার কোন মানে হয়না।

কিন্তু আমার মা এর আমার এই শান্তিতে থাকাটা পছন্দ হলো না। তিনি আমার পিছে লেগেই থাকলেন। বোধকরি, তাকে আমার মামা, চাচা খালা, ফুফুরা বোঝালেন যে ছেলের বয়স বেশি হয়ে যাচ্ছে এবং ছেলে জংলী হয়ে যাচ্ছে। ছেলেকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে হবে। বিয়ে দিলেই ছেলে জংলী সমাজ থেকে ভদ্র সমাজে ফেরত আসবে।

তিনি আমাকে নিয়মিত ৮-১০ বার ফোন করা শুরু করলেন। প্রথম প্রথম ভাবলাম ফোন ধরবো না, কিন্তু পরক্ষনেই চিন্তা করলাম-ফোন না ধরে উপায় নেই, ফোন না ধরলে মা এর ত্রিশালে এসে হাজির হবার সম্ভাবনাই প্রবল। অগত্যা কষ্ট হলেও আমাকে ফোন ধরে থাকতে হতো।

তার ফোনের মাঝে আমি সবচেয়ে বেশি যে নামটা শুনেছি- সেটা হচ্ছে চন্দ্রা। প্রতিদিন তিনি এই মেয়েটার সম্পর্কে যতো যতো গুনের কথা বলতেন, তাঁতে একটা এনসাইক্লোপিডিয়া না হলেও চন্দ্রাক্লোপিডিয়া হয়ে যায়। আমি শুধু হু হা করতাম আর তাঁতে তিনি ক্ষ্যান্ত না হয়ে প্রতিদিন দিগুণ উৎসাহে চন্দ্রাগুণাবলী আওড়াতে আওড়াতে তার মুখে ফ্যানা আর আমার কান পাকিয়ে ফেলেছিলেন।

একদিন ফোন করে তিনি বললেন-
"তোর সাথে আমার জরুরী কথা আছে।"
"কি জরুরী কথা?"
"তুই বাসায় আয়।"
"কেন?"
"চন্দ্রার বাসা থেকে তোকে দেখতে আসবে।"
"চন্দ্রা কে?"

মা অবাক হয়ে বললেন- "চন্দ্রা কে মানে? এতদিন তোকে কার কথা বললাম?"
"ও আচ্ছা।"

এবার মা রেগে গেলেন। ফোনের এপাশ থেকেও তার নাকের গরম বাতাস টের পাওয়া গেলো।
"তুই আমার কোন কথা শুনিস নাই এতদিন, না?"

মা রাগ হলে তাকে দ্রুত ঠাণ্ডা করতে হয়। না করলে বিপদ।

আমি মিহি গলায় বললাম-" কি যে বলো মা! শুনবো না কেন? শুনেছি তো।"
"তাহলে চন্দ্রাকে চিনিস নাই কেন?"
"কঠিন নামতো। এতো কঠিন নাম মনে থাকে বলো? ভুলে গেছিলাম।"
"এক থাপ্পড় মেরে তোর সব দাঁত ফেলে দেবো। বেয়াদব ছেলে কোথাকার! তুই কাল বাসায় আসবি। নাইলে কিন্তু, ভয়ংকর কিছু হবে।"
"কি হবে?"
"আবারো মুখে মুখে কথা? আসতে বলেছি আসবি।"
"আচ্ছা, আসবো।"
"চুল দাড়ি কেটে আসবি। চুল দাড়ি না কাটলে তোকে বান্দরের মতো লাগে। জংলীর মতো আসলে ওরা তোকে পছন্দ করবে না।"
"একটা ঘোমটা দিয়ে আসি?"
মা আরেকটা হুংকার দেওয়ার আগেই আমি খট করে ফোন নামিয়ে রাখলাম।

ঠিক করলাম দুই দিন ফোন ধরবো না। ফোন ধরলেই বিপদ। আমার মা ফোনের মাঝেই আমার গলায় চন্দ্রা নামের মেয়েটাকে ঝুলিয়ে দিতে পারে। আমি আমার মা কে চিনি। তিনি ভয়ংকর। একবার যেটার পিছে লাগেন, সেটা কিভাবে কিভাবে জানি করে ছাড়েন। চিন্তায় আছি।

আমি দুই দিন ফোনের কাছেও গেলাম না। গেলাম দুই দিন পরে। যেয়ে যেটা শুনলাম, সেটা শোনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। শুনলাম, মা হাসপাতালে ভর্তি। ল্যাব এইড হাসপাতাল। কেবিন নাম্বার ৩০১।

ঘটনা যে এতো বড় আকার ধারণ করবে, আমি সেটা বুঝিনি। খবর পাওয়া মাত্রই আমি অটো নিয়ে সোজা হাসপাতালে হাজির হলাম। পৌছাতে লাগলো সাড়ে তিন ঘণ্টা।

কেবিনে ঢুকে দেখি, সেখানে বড় মামা, সেজো মামা, দুই খালা সহ প্রায় আট দশেক আত্মীয় স্বজন উপস্থিত। তারা সবাই অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি ভ্রুক্ষেপ না করে মা এর সামনে যেয়ে দাঁড়ালাম।

মা বললেন- "এসেছিস কেন? এখনো আসতি না। মরার পরে আসতি।"
"কি হয়েছে?"
"সেটা শুনে তুই কি করবি? তুই জঙ্গলে বসে থাক। আমার কোন ছেলে নাই।"
"আচ্ছা, ছেলে না থাকলেও বলো।"
"তুই আমার কথা শুনিস না কেন?"
"কে বলছে শুনি না? শুনি তো।"
"তাহলে পরশু এলি না কেন?"
"কাজ ছিলো।"
"ও! তাই? তোর মতো মানুষের আবার কাজ ছিলো?!! তোর?"
"হু।"
"আজ এসেছিস যে? আজ কাজ নেই?"
"না।"
"আচ্ছা ঠিক আছে। আজ বাসায় চল।"
"বাসায় যাবো কেন?"
"আজকেই তোর একটা দফা রফা হবে। চল।"
" মানে কি? তুমি না অসুস্থ?"
"আমার কিছু হয়নি। শুধু ডায়াবেটিসটা একটু বেড়েছে। ঠিক হয়ে যাবে। চল।"

প্রতিবাদ করা দরকার, কিন্তু পারছি না। এখানে এসে আটকা পরে গেছি। রুমের সবাই আগের মতোই কঠিন দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সবচেয়ে বড় কথা, অনেকদিন পর আমি মা এর কাছে এসেছি। ছেলে নামের কলঙ্ক হলেও অনেকদিন পর মা কে দেখতে ভালো লাগছে। এ অবস্থায় কিছু বলা যায়না।

আমার মা হঠাৎ করেই অনেক উৎফুল্ল বোধ করছেন। সকাল বেলা যিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, দুপুর নাগাদ তিনি হেটেই হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গাড়ি করে বাসায় চলে এলেন। তার উৎসাহ দেখে মায়া লাগছে।

আমার মনে ক্ষীণ একটা আশা ছিলো যে চন্দ্রার পরিবার থেকে আমাকে পছন্দ করবেনা। তারা পছন্দ করলেও চন্দ্রা যে আমাকে পছন্দ করবেনা, বেঁকে বসবে সে ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত ছিলাম। এ যুগের মেয়ে, নিশ্চয়ই নিজের মত দেওয়ার আগে একবার কথা বলতে চাইবে। কথা বলতে আসলেই তাকে কিছু কথা বলে ভড়কে দিতে হবে।


(চলবে)

শেষ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৫৬
৯টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×