somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চরমপন্থি রাজনীতি

২১ শে জুন, ২০০৮ দুপুর ২:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তৎপর চরমপন্থি দলগুলোর নীতি-আদর্শের কোন বালাই নেই। অস্ত্রই এখন চরমপন্থি রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। বিশেষ করে নির্বাচন আসলেই দক্ষিণ-পশ্চিম জনপদে শুরু হয় অস্ত্রের ঝনঝনানি।

চরমপন্থি রাজনীতির ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৬৭ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নকশাল বাড়িতে প্রয়াত কমরেড চারু মজুমদারের নেতৃত্বে ঘটে কৃষক বিদ্রোহ। ওপারে শুরু হয়ে যায় শ্রেণীশত্রু খতমের রাজনীতি। ওই রাজনীতির ঢেউ এপারের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলেও লাগে। উগ্র মাওবাদী রাজনীতির একদল অনুসারী এপারেও জুটে যায়। গঠিত হয় চরমপন্থি সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল)। তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) একদল তরুণ কর্মী এ চরমপন্থি দলের সাথে সম্পৃক্ত হয়। তাদের হাতে উঠে মাওসেতুং-এর লাল বই। গোপনে ওপার থেকে নকশালদের পত্রিকা দেশব্রতী এদের হাতে আসতো। ১৯৬৯ সালের দিকে খুলনার ডুমুরিয়া, যশোরের অভয়নগর, বাঘাড়পাড়া, শালিখা ও কালীগঞ্জ থানা এলাকায় গোপন চরমপন্থি সংগঠন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করে। এ দলের নেতৃত্বে আসেন অতি বামপন্থি নেতারা। তাদের মধ্যে ছিলেন যশোরের কমরেড আব্দুল হক ও হেমন্ত সরকার। পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) শ্রেণীশত্রু খতমে বিশ্বাসী ছিল। ১৯৭০ সালে কালীগঞ্জ থানার চাঁদ আলী চেয়ারম্যানকে প্রথম শ্রেণীশত্রু হিসাবে হত্যা করা হয়। এটিই ছিল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে রাজনীতির নামে প্রথম হত্যাকাণ্ড।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি নির্বাচন বয়কটের ডাক দেয়। কিন্তু নির্বাচন প্রতিরোধে কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দলটি অস্ত্র সংগ্রহে ব্যাপকভাবে তৎপর হয়ে উঠে। তারা পাকিস্তানী বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সাথে যুগপৎ লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। এ লড়াইয়ে অনেক শীর্ষ ক্যাডার নিহত হয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দলটি ব্যাপক শক্তি অর্জন করে এবং তাদের শ্রেণীশত্রু খতম অভিযানে নতুন মাত্রা পায়। সে সময় আওয়ামী লীগ ও যুব লীগের বেশ কিছু নেতা-কর্মী তাদের হাতে নিহত হন। তারা রক্ষী বাহিনীর টার্গেট হয়। চলতে থাকে খুন, পাল্টা খুন। ১৯৭৩ সালে জাসদ গণবাহিনী গঠন করে। মেহেরপুর থেকে শুরু করে চুয়াডাঙ্গা জেলা হয়ে মাগুরা পর্যন্ত তারা তাদের সশস্ত্র তৎপরতার বিস্তৃতি ঘটায়। ফরিদপুর ও রাজবাড়ি এলাকায় গণবাহিনীর শক্ত ভিত্তি ছিল। মাগুরা-ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গা মহাসড়কের উভয়পাশ থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত গণবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। আর দক্ষিণপাশ থেকে খুলনা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে থাকে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিষ্ট পার্টির। চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়ায় পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি দলের নামও পরিবর্তন করেনি। চীন স্বীকৃতিদানের পর দলের নাম বাংলাদেশ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি রাখা হয়। এক সময় ত্রি-বিশ্ব তত্ত্ব নিয়ে আদর্শগত দ্বন্দ্বে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙ্গে যায়। আব্দুল হকের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি আলবেনীয় প্রেসিডেন্ট ড. আনোয়ার হুজার দলের অনুসারী হয়। এখন আন্তর্জাতিক কোন লাইনে আছে তা স্পষ্ট নয়।

১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এলাকার দখল নিয়ে গণবাহিনী ও বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ। চলতে থাকে খুন, পাল্টা খুন। গণবাহিনী কোণঠাসা হয়ে উত্তরদিকে সরে যায় এবং ঝিনাইদহের শৈলকুপা ও কুষ্টিয়া এলাকায় আশ্রয় নেয়। বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির আধিপত্য সারা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিস্তৃত হয়। এরপর ১৯৮০ সালে সর্বহারা পার্টির এ অঞ্চলে আগমন ঘটে। তারা ভারী অস্ত্রের প্রভাবে দ্রুত এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে নেয়। সর্বহারা পার্টি, গণবাহিনী ও বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে আন্ডারগ্রাউন্ডে ত্রিমুখী লড়াই চলতে থাকে। সকল দলেরই নেতা, ক্যাডার একের পর এক খুন হতে থাকে। একসময় সর্বহারা পার্টি আধিপত্য বিস্তার করে নেয়। অন্য পার্টিগুলো আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে যায়। অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও প্রতিপক্ষের আক্রমণে এক সময় সর্বহারা পার্টির ক্ষমতা খর্ব হতে থাকে। বাইরে থেকে আসা নেতারা মারা পড়ে। তাদের অস্ত্র স্থানীয় ক্যাডারদের দখলে চলে যায়। সর্বহারা পার্টির অস্তিত্ব প্রায় মুছে যায়। আশির দশকের শেষদিকে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) আবির্ভাব। তারা ভারী অস্ত্র নিয়ে এলাকায় সংগঠন গড়ে তোলে। নতুন নতুন ক্যাডার দলে ভিড়ে। বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি, গণবাহিনী ও সর্বহারাদের হাতে নির্যাতিতরা পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টিতে ঢোকে। শুরু হয়ে যায় ব্যাপক খুনখারাবি।

আশির দশকের শুরুতে চরমপন্থি দলগুলোর মধ্যে নীতি-আদর্শের বালাই থাকে না। রাজনীতি তখন আর অস্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তখন থেকেই অস্ত্রই রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়। রাজনীতির নামে শুরু হয়ে যায় চাঁদাবাজি ও ব্যক্তিগত-সামাজিক শত্রুতার জন্য মানুষ হত্যা। ১৯৯০ সালের পর ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া ও সাতক্ষীরা জেলাতে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। এরপর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে নিজ দলের ভিতর খুন, পাল্টা খুন চলতে থাকে। কিছুদিনের জন্য দল নিস্তেজ হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে সদ্য নিহত দাদা তপন দলের সামরিক দায়িত্ব হাতে নেয়ার পর আবার শক্তিশালী হয়ে উঠে। ইতিমধ্যে ১৯৯৭ সালে মির ইলিয়াস হোসেন দিলীপের নেতৃত্বে শ্রমজীবী মুক্তি আন্দোলন নামে একটি বাম সংগঠন গড়ে তোলা হয়। এ সংগঠনের কেন্দ্রস্থল ছিল ঝিনাইদহ। বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির ক্যাডাররাই মূলতঃ এ দলে যোগ দেয়। তাদের নিয়ে দলের আন্ডারগ্রাউন্ড উইং গণমুক্তি ফৌজ গঠন করা হয়। ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ আমলে চরমপন্থিরা আত্মসমর্পণ করে। তবে তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভাঙ্গাচোরা পাইপগান ও শটগানসহ আত্মসমর্পণ করে। ২০০০ সালে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি মির ইলিয়াস হোসেন দিলীপকে তার সহকারীসহ ঝিনাইদহ শহরে হত্যা করে। এরপর গণমুক্তি ফৌজে ভাঙন ধরে। একটি গ্রুপ ফের তাদের পুরনো সংগঠন বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টিতে ফিরে যায়। গণমুক্তি ফৌজ এখনো তৎপর ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়ায়। ২০০৩ সালের আব্দুর রশিদ মালিতা ওরফে দাদা তপন পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বের হয়ে জনযুদ্ধ গঠন করেন। এরপর আন্ডারগাউন্ড রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন হয়। জনযুদ্ধ ভয়ঙ্কর সংগঠনে পরিণত হয়। এরা ঘোষণা দিয়ে মানুষ খুন করে। ১৯৮০ সালের পর আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির নেতা-ক্যাডাররা স্থানীয় ও সংসদ নির্বাচনে ব্যবহৃত হতে থাকে। এক শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতা নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য তাদের টাকার বিনিময়ে ব্যবহার করতে থাকে। নির্বাচনের আগে এ সমস্ত পার্টির ক্যাডাররা রাতের আঁধারে অস্ত্র নিয়ে তাদের মনমত প্রার্থীকে ভোট দিতে বলে। তারা ভোটারদের ভয়ভীতি দেখায়। ফলে অনেক আসনে ভোটাররা পছন্দসই প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেনি। ১৯৭৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে গণবাহিনীর সাবেক নেতা গোলাম মোস্তফা ঝিনাইদহ-১ এবং রাজবাড়ি-১ আসনে আব্দুল মতিন নির্বাচিত হন।

।। দৈনিক ইত্তেফাক । ২১.০৬.২০০৮ ।।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুন, ২০০৮ বিকাল ৩:০০
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×