তাঁর সাথে আমার দেখা হয়েছিল মাত্র একবার; ১৯৯১ সালে, বইমেলায়। ছোট্ট আমি সেদিনের বইমেলায় গিয়েছিলাম দুলাভাইয়ের হাত ধরে। তখনি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা শক্তিমান এই লেখক বসেছিলেন কোন এক প্রকাশনীর স্টলে, যেখানে তাঁর নতুন শিশুতোষ বই "মজার ভূত" বিক্রি হচ্ছিল। আমি তখন পড়ি তৃতীয় শ্রেণীতে; "নন্দিত নরকে", "শংখনীল কারাগার" বা "অন্যদিন"-এর মতো বইগুলোর নাম অথবা এসব গল্পের মানে বোঝার মতো বয়েস ছিল না সেটা। বড়জোর তাঁর নাম শুনেছিলাম কয়েকবার, কিন্তু লেখা পড়িনি একটাও; বয়েসটা কম হলেও একজন 'বাজারি লেখক'-এর নাম শুনব না তাই কী আর হয়?!
শেষমেষ বইমেলা থেকে বই কিনতে হবে এই অজুহাতে কিনে ফেললাম "মজার ভূত", আমার প্রথম পড়া তাঁর বই। কেনার পর দুলাভাই বললেন, "ওই যে লেখক বসে আছেন; বইটা দাও, দেখি একটা অটোগ্রাফ নিতে পারি কি না।" অটোগ্রাফ কী জিনিস তা বোঝারও বয়েস ছিল না সেটা, শুধু দেখলাম লোকজন লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর সামনে, তিনি প্রত্যেকের বইতে কী যেন লিখে দিচ্ছেন। আমার নতুন কেনা বইতে একটা উটকো লোক কলম দিয়ে লিখবে-দাগাবে, মন থেকে মেনে নিতে পারছিলাম না এটা, যেখানে আমার স্কুলের নতুন বইতে আমি একটা দাগও দিতাম না কখনো। দুলাভাই অটোগ্রাফ নেয়ার চেষ্টা করলেন কতক্ষণ; মেলার সময় প্রায় শেষের দিকে...
সবসময় যেটা হয় আমার সাথে, আমার বইটা এগিয়ে দেয়ার পরপরই তিনি বললেন যে আজ আর না। স্টলের বিক্রেতাও বলল যে স্যার আজকে আর অটোগ্রাফ দেবেন না। আমার মন খুশি খুশি যে লোকটা আমার বইতে দাগাতে পারবে না, চেপে রাখা রাগটা দেখিয়ে আমিও বললাম, "লাগবে না।" তিনি ভালভাবেই শুনতে পেলেন সেটা। বই ফেরত নিয়ে স্টল থেকে সরে আসছি হঠাৎ পেছন থেকে বিক্রেতার ডাক, "স্যার আপনাদের ডাকছেন।" আমি যতই বলি "আমার বইতে উনি কেন লিখবেন, দরকার নেই", দুলাভাই ততই আগ্রহী তাঁর অটোগ্রাফ নিতে। আবার ফেরত গেলাম স্টলে, অভিমানী চেহারা নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম তাঁর দিকে। তিনি নাম জিগেশ করলেন, বলার পর খসখস করে লিখে দিলেন: "পারভেজকে শুভেচ্ছা..."। আজ এত বছর পর অধম আমি ধরে রাখতে পারিনি তাঁর দেয়া সেই শুভেচ্ছা। তাঁর লেখাগুলোর সাথে নিজের জীবনের অনেক স্মৃতি, অনেক সময়, অনেক আবেগ জাড়িয়ে থাকলেও তাঁকে হারানোর পাশাপাশি হারিয়ে ফেলেছি তাঁর সাথে আমার অবুঝ বয়েসের ছোট্ট সেই স্মৃতি।
আজন্ম তিনি চলে যেতে চেয়েছিলেন কোনো এক জোসনা ভরা চাঁদনী রাতে, কিন্তু চলে গেলেন শ্রাবণ মেঘের দিনে। এই 'বাজারি লেখক', 'সস্তা লেখক', 'নিম্নবিত্তের লেখক', 'অপন্যাস লেখক', 'ফালতু পাঠকের লেখক' বাংলা সাহিত্যকে কী দিয়েছেন বা দিতে পেরেছেন তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই আমার। আমি শুধু এটা জানি যে আমার মনন ও জীবনবোধের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে তাঁর লেখার ছায়া। এ কারণে তাঁর জন্যে এই মনে সম্মানের যে জায়গাটা রয়েছে তাতে করে 'ধন্যবাদ' শব্দটা আর নতুন করে উচ্চারণ না করলেও চলে বুঝি। তিনি আজীবন থাকবেন এই হৃদয়ে, তাঁর লেখা থাকবে এই মনে, তাঁর শেখানো জীবনবোধ থাকবে আমার সারাটা জীবন জুড়ে... তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



