somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নন্দিত নরক হতে বিদায়...

০১ লা আগস্ট, ২০১২ রাত ১১:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



নিজেকে কেমন যেন আবুল আবুল লাগছে।

আমি বসে আছি একটা লিচু গাছের নিচে। আশেপাশে আরো বেশ কিছু লিচু গাছ, পুরো বাগান। পাশেই আমার প্রিয় সেই দীঘি, শান বাঁধানো ঘাটটা খুবই পরিচিত। যদিও পুরো ঘাট ময়লা জমে নষ্ট হয়ে আছে। কিন্তু সেদিকে কারো কোন খেয়াল নেই। ঘাটে বসে প্রকৃতি দেখতে হবে অথবা পাখির ডাক শোনার জন্য কান পেতে থাকতে হবে – এখানে অমন কেউ এখন আর আছে বলে মনে হচ্ছে না। ঘাট পরিষ্কার থাকলেই কী আর না থাকলেই বা কী! পুরো জায়গাটার সাথেই কত স্মৃতি, কত কত সময় পার করেছি এখানে, আর এখন…

একটু দূরে কবর খোঁড়া হচ্ছে। খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছি। আমার মতোই আগ্রহ নিয়ে আরো অনেকে দেখছে। কারো কারো মুখে হাসি দেখা যাচ্ছে। কেউ কবর খোঁড়া দেখতে পারার আনন্দে খুশি, আবার কেউ হয়তো একজন মানুষ চলে গেছে, আপদ-ঝামেলা বিদায় হয়েছে এই সুপ্ত আনন্দে খুশি। যারা এই আনন্দ দেখাতে লজ্জা পাচ্ছে তারা মুখ গম্ভীর করে আছে। প্রায় সবাইই যথাসম্ভব চেষ্টা করছে মরা বাড়ির ফ্লেভারটা চোখে-মুখে ধরে রাখতে। কাজটা কঠিন। নিজের মুখটা এমন করে রাখার চেষ্টা করছে যাতে মনে হয় এই মৃত্যুতে তার চেয়ে বেশি দুঃখ আর কেউ পায়নি। কারো কারো চোখে সামান্য পানিও আছে। কেউবা পুরোপুরি নিস্তব্ধ।

আমি নিজেও হাসিমুখে বসে আছি। খুব মজা লাগছে নিজের কবর খোঁড়া নিজেই দেখতে পাচ্ছি বলে। আর মজা লাগছে আমার জন্য অনেকের মায়াকান্না দেখে। তারাতো আর বুঝতে পারছে না যে আমি এখন অন্য জগতের মানুষ। সব কিছু বুঝতে পারছি, দেখতে পাচ্ছি। যাই হোক, কবর ভাল খুঁড়েছে। কবরতো আর গর্ত খোঁড়ার মতো কোন বিষয় না। অনেক হিসাব-নিকাশ করতে হয়। দেখা গেল মাপমতো খুঁড়তে পারল না, তারপর যা হবার তাই। লাশ কিছু দূর নেমে গেল আটকে, আর নামে না, আবার ওঠানোও যাচ্ছে না! কী ভয়ংকর বিচ্ছিরি ব্যাপার! কিন্তু না, এদের খোঁড়া ভাল হয়েছে। এক কথায় যাকে বলা যায় “বড়ই সৌন্দর্য্য!”

গতকালতো আরো তামাশা হয়েছে, বিচ্ছিরি নাকি মজার বুঝতে পারছি না। শহীদ মিনারে একদম নাগরিক উৎসব পালনের মতো ব্যাপার। যারা আমাকে 'বাজারি/সস্তা লেখক', 'অপন্যাস লেখক', 'ফালতু পাঠকের লেখক’ বলত তারাও দেখলাম খুব কাছাকাছিই আছে। টিভি চ্যানেলগুলোতে আমাকে নিয়ে নিজেদের স্মৃতিকাতরতা জানাচ্ছে। কোন কোন চ্যানেলে নাকি “হিমু/মিসির আলি কার সৃষ্ট চরিত্র? উত্তর দিতে এসএমএস করুন অমুক নম্বরে”- এসব মশকরাও হচ্ছে। আরো মজা হয়েছে যে আমাকে কোথায় কবর দেয়া হবে এটা নিয়ে ঝগড়া লেগে গেছে! এ ব্যাপারে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের প্রয়োজন পড়েছে। আবুল হোসেন বেছে বেছে আমার কবর দেয়ার এই সময়টাতে পদত্যাগ করেছেন, টেনশনে মিডিয়া কাভারেজের ব্যাপারটা হয়তো তিনি মাথায় রাখতে পারেননি।

এমনটা হবে আমি জানতাম, তাই আগেই মানা করে দিয়েছিলাম। তবুও আমার মরদেহ নিয়ে বিস্তর টানাহ্যাঁচড়া চলল। মরে যাওয়ার পরও শান্তি নেই। আমার খুবই কষ্ট হচ্ছিল এসব দেখে। আপন মানুষগুলোর মধ্যে আসলে কে কতটা আপন তা আরো ভালো করে বুঝতে পারলাম। বাঁচতে ভয় পাইনি কখনো, কিন্তু মরতে গিয়ে এবার যেন ভয় পেয়ে গেলাম। যাক, অবশেষে অন্তত কবর দেয়ার জায়গাটাতো ঠিক করা হলো। নিজে সারাজীবন নাটক লিখেছি, আর জীবনের শেষে নিজেকে নিয়েই করা নাটক দেখতে হচ্ছে! ইচ্ছে হচ্ছিল বাকের ভাইকে ডেকে এনে সব নাটক বন্ধ করে দিই। এরপর আরো কত কী দেখতে হয় কে জানে! কীভাবে হঠাৎ আমার প্রাণহীন এই শরীরটা এতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল সবার কাছে!

বার বার মনে হচ্ছিল: পদত্যাগ করে আবুল হয়ে গেলেন বাদশাহ হুমায়ূন, আর মরে গিয়ে আমি হয়ে গেলাম আবুল!


আমাকে দেখতে আরো এসেছিল আমার ভক্তরা, যাদের অনেকেরই ছিল চোখ ভর্তি পানি। সস্তা একজন লেখক মরে গেছে। তার জন্য এদের এতো ভালোবাসা এতো আবেগ আসে কোথা থেকে?! সামান্য মধ্যবিত্তের জীবনগাঁথা লিখলেই মানুষের এতো ভালবাসা পাওয়া যায়, এতো শ্রদ্ধা পাওয়া যায় জানা ছিল না। না, এরা শুধুই আমার ভক্ত তা নয়। এরা সবাই আমার বন্ধু, একেকজন যেন আমার বইয়ের একেকটা চরিত্র।

আমার কন্যারা কাঁদছিল। ছেলেটা এসেছিল হলুদ পাঞ্জাবি পরে। হিমুর মতো হতে চেয়েছিল মনে হয়। কিন্তু হিমুর মতো আবেগহীন, নির্বিকার থাকতে পারেনি। হাউমাউ করে কাঁদছিল। তাদের কান্না দেখে মনটা খুব খারাপ হয়েছে। বাবার জন্য ছেলেমেয়েদের এতো দরদ আছে বুঝতেই পারিনি। চোখের সামনে সব কিছু কেমন যেন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আরো ক’টা দিন বেঁচে থাকলে মন্দ হতো না।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এমন দিনে আকাশ ভাঙা জোসনা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু চাঁদের সাথে শিডিউল মেলেনি। বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে। জোসনা নেই যখন, আকাশ ভাঙা বৃষ্টিও মন্দ না। কিন্তু মন খারাপ করা বৃষ্টি ভালো লাগে না। যেমন কারো কান্না দেখতে ভালো লাগে না। প্রকৃতির কান্না দেখতেও ভালো লাগে না। ঝুম বৃষ্টি নামুক। সবার কান্না, বিষণ্নতা ধুয়ে-মুছে নিয়ে যাক। রয়ে যাক শুধু ভালোবাসা। আর তাতেই ধন্য হোক এই মানবজীবন।

এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে,
এসো করো স্নান নবধারা জলে
এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে…

[জুলাই ২৪, ২০১২ তারিখে ফেসবুক প্রোফাইলে প্রকাশিত। হুমায়ূন আহমেদ অনুকরণে লেখার চেষ্টা করা হয়েছে। যারা স্যাটায়ার-ধর্মী লেখার সাথে পরিচিত না বা হুমায়ূনকে পছন্দ করেন না তাদেরকে এই পোস্ট এড়িয়ে চলার জন্য বিনীতভাবে অনুরোধ জানানো হলো।]
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হত্যাকাণ্ড বন্ধে কেন ম্যাজিক জানা জরুরি ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৪৪


জাতি হিসাবে আমরা বড়োই অভাগা। ইতিহাসের মঞ্চে রাজা বদল হয়, কিন্তু চিত্রনাট্য বদল হয় না। এক রাজা যায়, আরেক রাজা আসে; কিন্তু পর্দার পেছনের কলকাঠি নাড়া সেই একই হাত।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডোডোরা আমার পোষ্টে এসে আমাকে ভৎসনা করেন।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৬



ব্লগ এখন নিস্তব্ধ, মাঝে মাঝে ১/২টা পোষ্ট আসে, মৃতের মতো পড়ে থাকে, সামনের পাতা থেকে পেছনে পাতায় যায় না। তবে, আমার পোষ্টগুলো সেইদিক থেকে কিছুটা সুখী,... ...বাকিটুকু পড়ুন

৪–৫ আগস্ট : রাষ্ট্রক্ষমতার মুখোশ খুলে দেওয়া রাত ও দিন

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:০১

৪–৫ আগস্ট : রাষ্ট্রক্ষমতার মুখোশ খুলে দেওয়া রাত ও দিন

৪ আগস্ট রাত — আশ্বাসের আড়ালে ছদ্ম-অভ্যুত্থানের নীরব নকশা
৪ আগস্ট সন্ধ্যায় কোটা-আন্দোলনের বিশৃঙ্খলাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে যখন রাষ্ট্রজুড়ে উত্তেজনা,... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশে এমপি হওয়ার মতো ১ জন মানুষও নেই

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৪



দলগুলোতে মানুষই নেই, আছে হনুমান।

আমেরিকায় যদি ট্রাম্প ক্ষমতায় না'আসতো, বাংলাদেশে হ্যাঁ/না ভোট দিয়ে ইউনুসকে দেশের প্রেসিডেন্ট করে, দেশ চালাতো প্রাক্তন মিলিটারী অফিসারেরা ও বর্তমান জামাতী অফিসারা মিলে। দুতাবাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

=চলো দেখি সূর্য উদয়=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৫০


শীত কুয়াশা ফুটো করে,
সূর্য যখন উঠে নীলে
দেয় ছড়িয়ে সোনা আলো,
দেখলে মনে শান্তি মিলে।

একটি সকাল ফের পেয়ে যাই
নিঃশ্বাস নিয়ে বাঁচি সুখে,
পাই প্রেরণা সূর্যের কাছে
আলোর শক্তি তুলি বুকে।

দেখবে নাকি আমার সাথে
রোজ বিহানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×