
আশি এবং নব্বই এর দশকে আমরা যারা বড়ো হয়েছি, আমাদের চলাফেরায় এতো চাকচিক্য ছিল না। এখনকার পোলাপানের মতো এতো টাকা-পয়সা ছিল না পকেটে। আমরা বই বগলে নিয়ে স্কুলে যেতাম, তখন স্কুল ব্যাগের তেমন প্রচলন ছিল না। সাইকেলে চড়ে কলেজে যেতাম। তখন ঢাকার প্রায় সব কলেজে সাইকেল স্ট্যান্ড ছিল। রাস্তার পাশের টং দোকানে বসে আমরা একটা চা পিরিছে ঢেলে দুভাগ করে দুজনে খেতাম। একটা সিগেরেট খেতাম দুই, তিন জনে। সিগারেটের ক্ষেত্রে তখন ফার্স্ট বুক, সেকেন্ড বুক, থার্ড বুক...বলে কথা চালু ছিল। তখন আমজনতার ব্রান্ড ছিল স্টার-রমনা, মধ্যবিত্ত লেবেলে চালু ছিল ক্যাপিস্টান এবং ব্রিস্টল। আশির দশকের শেষ দিকে চলে আসে গোল্ড ফ্লাগ এবং গোল্ড লীপ। এক্টু অভিজাত লোকজন খেতো ফাইভ ফিফটি ফাইভ, বেনসন এন্ড হেজেস কিংবা মার্লবোরো। অনেক সৌখিন লোক আবার হাতে বানানো সিগারেটও খেতো। ’ফ্লাইং ডাচ ম্যান’ নামক ব্রান্ডের প্যাকেট কিংবা ক্যানে পাওয়া যেতো হাতে বানানো সিগারেটের উপাদান।

আমাদের সময় বিনোদনের মূল অনুষঙ্গ ছিল সিনেমা। ঢাকাই সিনেমা খুব জনপ্রিয় ছিল তখন। রাজ্জাক, ওয়াসীম, সোহেলরানা, জাফর ইকবাল, আলমগীর, ফারুক ছিলেন খুব জনপ্রিয় নায়ক। নায়িকাদের মধ্যে ছিল শাবানা, কবরী, ববিতা, সুচরিতা, রোজিনা, অঞ্জু ঘোষ, চম্পা প্রমুখ। তুখোড় জনপ্রিয় ভিলেন ছিলেন জসীম। তারপরে ছিলেন, মঞ্জুররাহী, আহমদ শরীফ, রাজ, খলিল, মিজু আহমেদ সহ আরো অনেকে। টেলিসামাদ ছিলেন ঢাকাই সিনেমার সবচে জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা। পাশাপাশি ছিলেন
আশিষ কুমার লৌহ, দিলদার, মতি, ব্ল্যাক আনোয়ার, সুরুজ বাঙালি। এদের আগে ছিলেন খান জয়নুল, রবিউল, হাসমত।
আশি দশকের ঢাকায় অনেক গুলো সিনেমা হল ছিল। এর মধ্যে স্টার, মুন, লায়ন, তাজমহল, রূপ মহল, শাবিস্তান, নাগর মহল (পরবর্তীতে চিত্রামহল) গুলিস্তান, নাজ, বিউটি, মল্লিকা এখন আর নেই। এগুলো সব ছিল ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হল। গুলিস্তান সিনেমা হলের নামেই সুপরিচিত হয়ে ওঠে ঢাকার গুলিস্তান এলাকা।

নব্বই দশক পর্যন্ত ঢাকা বাসীর বিনোদনের মূল অনুষঙ্গ ছিল সিনেমা। আমরা খিলগাঁও এলাকার পোলাপান তখন দলবেঁধে সিনেমা দেখতে যেতাম জোনাকি, মধুমিতা কিংবা গুলিস্তানে। ঢাকার পিল খানায় একটি সিনেমা হল ছিল, এখন আছে কিনা জানি না। নব্বই’এর দশক পর্যন্ত ওখানে পাকিস্তানী ছবি প্রদর্শিত হতো। মোহাম্মদ আলী, জেবা, দীবা, ওয়াহিদ মুরাদ একসময় এই দেশেও তখন খুব জনপ্রিয় ছিল। পাকিস্তানী ছবির তারকা পর্যায়ের কৌতুকাভিনেতা ছিল রঙ্গীলা।

রাজধানীর অভিসার সিনেমা হলে তখন প্রায় নিয়মিত ভাবে চলতো বিদেশী ছবির প্রদর্শনী। বিদেশী বলতে মূলত ইংরেজি এবং চাইনিজ ছবি। চাইনিজ ছবির নায়ক ব্রুসলী তখন এই দেশেও তুখোড় জনপ্রিয়। এ ছাড়া জেমস বন্ড নায়ক রজার মুর, শন কনরী, ওয়েস্টার্ন মুভির বিখ্যাত নায়ক ক্লিন্ট ইস্টউড,
চার্লস ব্রনসন, এ্যাকশন হিরো চক নোরিস, র্যম্বো খ্যাত সিলভিস্টার স্ট্যালন এর জনপ্রিয়তাও ছিল ব্যাপক। অভিসার ছাড়াও মধুমিতা, গুলিস্থান সহ বিভিন্ন সিনেমা হলে প্রতি রোববার মনিং শোতে ইংরেজি এবং চাইনিজ ছবি প্রদশির্ত হতো। এই সময় এক টিকেটে দুইটি ইংরেজি ছবি দেখার প্রচলন শুরু হয়।

এখনকার পোলাপান যেমন ফাস্টফুডে কিংবা চায়নিজে ডেটিং করে, সেই সময় সিনেমা হল ছিল আকর্ষনীয় ডেটিং স্পট। যে সব পোলাপান সাধারণত স্টল আর রিয়েল স্টলে বসে সিনেমা দেখতো। তারাই আবার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে ঢুকতো বিলাসবহুল ড্রেস সার্কেলে (ডিসি)। সিনেমা শুরুর আগে ওয়েটিং রুমে দুজনে একান্তে বসে চটপটি কিংবা ফুচকা খাওয়া। বিরতির সময় পেপসি-কোকাকোলা, স্পাইট-সেভেন আপ কিংবা ফান্টা-মিরিন্ডার ২৫০ এম এল কাঁচের বোতলে চুমুক দেয়া, চিপস কিংবা বাদাম খাওয়ার পাশাপাশি অন্ধকারে গার্লফ্রেন্ডকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়া, একটু আধটু খুনসুটি এমনই ছিল তখনকার প্রজম্মের সিনেমা কেন্দ্রিক প্রেম।

আশির দশকের মধ্যভাগে ভিসিআর (ভিডিও ক্যাসেট রেকর্ডার) নামক একটি যন্ত্রের প্রচলন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে ব্যাপক ভাবে হিন্দি ছবির আগ্রাসন শুরু হয়। পুরোন ঢাকার বেগমবাজার হয়ে উঠে এই অবৈধ হিন্দী ছবি প্রদশর্নীর তীর্থ স্থান। ২৪ ইঞ্চি সনি টিভিতে ভিসিআরের মাধ্যমে ছবি প্রদর্শিত হতো। আমরা তখন দলবেঁধে জোনাকি, মুধুমিতা কিংবা অভিসার বাদ দিয়ে বেগমবাজার, সিদ্দিকবাজার মুখি হই। বেগম বাজারে তখন দিনেতো প্রদশর্নী চলতোই আবার মাত্র দশ টাকা দিয়ে সারা রাতও তিন-চারটি ছবি দেখার ব্যবস্থা ছিল। ছবি দেখার মাঝখানে প্রদর্শিত হতো পর্ণ ছবির কাটপিস।

বন্ধুরা, এই লেখাটি সিরিজ আকারে কয়েক পর্বে লিখবো। আজ মূলত লিখলাম আশি এবং নব্বই দশকে সিনেমা কেন্দ্রিক বিনোদনের ইতিবৃত্ত। পরের পর্বে থাকবে রেডিও-টেলিভিশন এবং ব্যান্ড সঙ্গীত বিষয়ক প্যাঁচাল। আমার সমসাময়িক বয়সের যারা এই লেখাটি পড়বেন, তারা কমেন্টের মাধ্যমে নিজের তারুণ্য, অভিজ্ঞতা, বেড়ে ওঠার পেক্ষাপট, প্রেম- ভালোবাসা, আনন্দ-বিনোদন তথা তৎকালীন আর্থ-সামাজিক অবস্থা ইত্যাদি শেয়ার করবেন আশা করি।
#এই পোস্ট ইতিপূর্বে ফেসবুকে প্রকাশিত হয়েছে।
পোস্টে ব্যবহৃত পোস্টার গুলো নেট থেকে সংগৃহীত।
____________
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুন, ২০২১ রাত ১০:২৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




