টেলিগ্রামের জন্য শোকগাথা লেখার সময় বুঝি হয়ে এল। চোখ-কান খোলা রাখলে যেকোনো দিন শোনা যাবে, ‘একটি শোক সংবাদ!! ধুঁকে ধুঁকে চলা পৃথিবীর সর্বশেষ টেলিগ্রাম অফিসের মৃত্যু ঘটেছে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল প্রায় দেড় শ বছর।’
আর এর মধ্য দিয়েই যবনিকাপাত ঘটবে টেলিগ্রাফিক যোগাযোগব্যবস্থার একেবারে শুরুর দিককার এই পদ্ধতির। টেলিগ্রাম যখন প্রথম এসেছিল, তখন সে টান দিয়েছিল শব্দ ধরে। বড় একটা বাক্যকে যত কম শব্দে লেখা যায়, এই পরিবর্তনে নেতৃত্ব দিয়েছিল টেলিগ্রাম ব্যবস্থা। ‘ফাদার সিরিয়াস. কাম শার্প’ জাতীয় বার্তা আদি জমানার অনেকের অভিজ্ঞতায়ই আছে। হাল আমলে টেলিগ্রামের উত্তরসূরি হিসেবে এসেছে মোবাইল ফোনের খুদে বার্তা (এসএমএস)। এবার সে শব্দের বদলে এক কাঠি বাড়িয়ে শব্দের বর্ণ ধরে টান দিয়েছে। Great এখন g8, To be এখন 2b, শার্লক হোমসের বিখ্যাত উক্তি Elementary, my dear watson বদলে গিয়ে হয়েছে LEmntry, my dEr wtson. ১৬০ অক্ষরের মধ্যে দরকারি-অদরকারি, আবেগ-নিরাবেগের নানা প্রকাশ তো ঘটাতে হবে!
বিষয়টা যেহেতু এত দিন মোবাইল ফোন আর চ্যাট উইন্ডোগুলোতেই সীমাবদ্ধ ছিল, তাই তেমন কেউ মাথা ঘামায়নি। কিন্তু যখনই এই খুদে কিন্তু শক্তিশালী শব্দগুলো তাদের নতুন রূপ নিয়ে ঢুকে যাচ্ছে ইংরেজি বাক্যে, গ্রামার ভেঙেচুরে দৈর্ঘ্যে খাটো করে দিচ্ছে বাক্যকে, তখনই শুরু হচ্ছে ঝামেলা।
এ নিয়ে ২০০৩ সালের দিকে প্রথম আলোচনায় এসেছিল স্কটল্যাল্ডের ১৩ বছর বয়সী এক স্কুলছাত্রী। বিষয়টা নিয়ে বিবিসি একটা প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছিল। ওই স্কুলছাত্রী স্কুলের পরীক্ষায় গ্রীষ্মের ছুটি নিয়ে রচনা লিখেছিল এসএমএসের কায়দায়—My smmr hols wr CWOT. B4, we used 2go2 NY 2C my bro, his GF & thr 3 :— kids FTF. ILNY, it's a gr8 plc. ইংরেজিতে অনুবাদ করলে এই বার্তার মানে দাঁড়ায় এ রকম, My summer holidays were a complete waste of time. Before, we used to go to New York to see my brother, his girlfriend and their three screaming kids face to face. I love New York. It's a great place.
মুশকিলে পড়ে গিয়েছিলেন বালিকার স্কুলশিক্ষক। কী করবেন তিনি? তাঁর ভাষায় প্রাচীনলিপির কাছাকাছি দুর্বোধ্য এই লেখায় নম্বর দেবেন, নাকি পুরোটা এক টানে কেটে দেবেন? কিন্তু মুশকিল হলো, এই লেখা শিক্ষকের কাছে দুর্বোধ্য মনে হলেও এই প্রজন্মের একটা বড় অংশই এখন এসব শব্দমালায় অভ্যস্ত, চটপটে। বিষয়টা শুধু অন্য দেশের সমস্যা নয়। এই আমাদের দেশেও শিক্ষার্থীরা তাদের স্কুলের খাতায়, তরুণ-তরুণীরা তাদের চাকরির আবেদনে You-কে U , Are-কে r লিখছে। এটা ভুল, না শুদ্ধ? কী বলবেন আপনি একে? পুরো ব্যাপারটাই তো ‘গ্লোবাল’। কোনো কোনো ভাষা বিশেষজ্ঞ বলছেন, ‘এর ফলে ভাষার মৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে। এ ধরনের শব্দকে কোনোভাবেই আমাদের শব্দমালার ভেতর ঢুকতে দেওয়া ঠিক হবে না।’ এই বক্তব্যের বিরোধীরাও শার্টের আস্তিন গুটিয়ে তৈরি তাদের বক্তব্য নিয়ে, ভাষা একটা বহমান স্রোতের মতো, মানুষের মুখে মুখে এর পরিবর্তন চাইলেই কেউ ঠেকাতে পারবে না, আর ঠেকাতে চাওয়ার চেষ্টা করাও উচিত হবে না। আর এটা তো কেউ জোর করে চাপিয়ে দিচ্ছে না। ভাষা তো সাধারণ মানুষের জন্য আর সাধারণ মানুষই যদি ভাষাকে পরিবর্তন করে তাহলে দোষ কোথায়। স্রোত নদীর পাড় ভেঙে এগিয়ে গেলেই সেই নদীকে আমরা সচল বলি, তাকে বাঁধ দিয়ে আটকে দিলে নদী হয়ে পড়বে মৃত। তেমনি ভাষা ভাঙচুর না হলে সেটা সচল যে বোঝা যাবে কীভাবে, স্থির হওয়া মানেই তো মৃত্যু।
ইংরেজি অভিধানের সম্পাদকেরা এই সমস্যাকে নিচ্ছেন বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই। কারণ সংক্ষিপ্ত এই শব্দগুলো যদি সত্যি সত্যি বৈধতা পেয়ে যায়, তাহলে অভিধানে যে পরিবর্তন আনতে হবে তা রেকর্ড সৃষ্টি করবে। একযোগে এত শব্দ এর আগে কখনো অভিধানে ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা জাগাতে পারেনি।
যারা এতক্ষণ এই বলে স্বস্তিতে ছিলেন যে এটা তো ইংরেজি ভাষার সমস্যা, আমাদের কী, তাদের হালকা চিন্তিত করে তোলা যাক কয়েকটি বিষয় অবহিত করে। বাংলা গণব্লগ বা ওয়ার্ডপ্রেস ধরনের ব্যক্তিগত ব্লগ সাইটগুলোয় ঢুকেছেন কখনো? অথবা বাংলা লেখা যায়, এমন মোবাইল ফোনসেটের এসএমএস দেখেছেন? সেখানে ‘হাহাপগে’ দেখলে বিভ্রান্ত হবেন না। বিষয়টা এতই মজার যে লেখক ‘হাসতে হাসতে পড়ে গেছেন’। LOL বা Lough Out Loudly-এর বাংলা সংস্করণ এটি। কেউ কেউ আবার হাহামগেও (হাসতে হাসতে মরে গেছি) লেখে। দূরে গিয়ে মরার পরামর্শ দেওয়া হয় DGM-এর মাধ্যমে। ব্যাকরণ মেনে রেফ (র্ ) ‘র’-এর পরিবর্তে ব্যবহূত হলেও সব সময় এমনটি হবে এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু এসএমএস বা ব্লগিংয়ে সব সময় ব্যবহূত হবে, এমনটিই এখন বাস্তবতা। তাই তো শব্দের আকার ছোট করতে ‘কমন পড়লেও পড়তে পারে’—এই আশাবাদ ব্যক্ত করা হয় ‘কমন পর্লেও পর্তারে’ এমন বর্ণের বিন্যাসে। মন এখন আর ‘মন চায়’ না, ‘মঞ্চায়’। আগে যখন চিঠি লেখালেখির চল ছিল, তখনই তো আমরা চিঠির শেষে লিখতাম Eতি, আর বিদায় লিখতাম Bদায়। আবার অনেককে চিঠির শেষে লিখতে দেখতাম ‘এবার তাহলে ৮০’।
এটাকে এখন ‘ডিজুস সংস্কৃতি’ বললে ভুল হবে না।, ভাষাকে কোনো নিয়মশৃঙ্খলার ভেতর বেঁধে দেওয়া যাবে না, কিন্তু ভাষার একটা নীতিমালা থাকতে হবে। যে ভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি, সেই বাংলা ভাষার কোনো নীতিমালা নেই। ফলে প্রযুক্তির কল্যাণে ভাষার যত্রতত্র ব্যবহার সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। এটা খুবই ভয়ের কথা, ভাষার একটা বৈজ্ঞানিক দিক হলো, মানুষ সব সময় একে সংক্ষিপ্ত করতে চায়। এ জন্যই আমরা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে ডাকি রাজউক বলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঢাবি আবার এক্সামিনেশনকে এক্সাম। কিন্তু এই প্রবণতা যখন নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী ছাড়িয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে ছাড়িয়ে যায়, তখনই হয় সমস্যা। নীতিমালাহীন বাংলা ভাষা এভাবে চলতে থাকলে একদিন আর যা-ই হোক, বাংলা থাকবে না। কাজেই সরকারকে দ্রুত বাংলা ভাষা রক্ষায় নীতিমালা তৈরি করতে হবে।
বাংলার এই সংক্ষিপ্তকরণ এখনো আঁতুড়ঘরে থাকলেও নতুন প্রজন্মের এসএমএস আর ব্লগিংয়ের সঠিক আলো-হাওয়া আর পরিচর্যায় ঠিকই সে বেড়ে উঠছে। এভাবেই বেড়ে উঠেছিল একদিন নতুন দিনের নতুন ইংরেজি শব্দগুলো এসএমএসের ১৬০ শব্দের বাধ্যবাধকতায় পড়ে। তা আজ মুঠো থেকে বেরিয়ে এসেছে জনসম্মুখে। কবে যে এমন বাংলা শব্দ দেখতে হবে বইপত্রের পাতায়! অপেক্ষায়তেছি (অপেক্ষা করিতেছি)!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




