somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যায় যায় দিন...

১৯ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১০:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যখন প্রথম এই কলোনীতে এলাম তখন পড়ি ক্লাস ফাইভে। দুটো মাঠ, . মসজিদ, গ্রীন হাউজ, জিন ব্যাঙ্ক, সোনালী ব্যাঙ্কের একটা শাখা, বিশাল এক দিঘি আর গবেষণার কাজের জন্য অনেক জায়গা আর বড় বড় দুটো মাঠ নিয়ে গড়ে উঠা ছড়ানো ছিটানো বাড়িগুলো দেখতে যেমনই হোক না কেন চোখের শান্তি বিঘ্নিত করেনি কখনও। সবগুলোই আজব আকারের দালান, বিশ্রী রকমের হলুদ বহিরাবরনের ভিতরে বিশাল উঁচু উঁচু রুমগুলোর আকার-আয়তনের বেখাপ্পা ভাবটা হাসির সৃষ্টি করতো অনেক! আমার রুমটা ছিলো বিশাল, খোলামেলা, দুদিকে দরজা, যার একটা বারান্দার সঙ্গে যোগ দিয়ে বাতাস আর ধুলোবালির অবিমিশ্র ভালোবাসায় শান্তির সাথে সাথে ভোগান্তিও জুটাতো অবিরত! আম্মুর অনেক সখের মাঝে ক্যাকটাস, গাছ আর ক্রিস্টালের সখ একটু বেশিই ছিলো, তাই বাসার আনাচে কানাচেতে জলদিই ভরে উঠেছিলো পাতাবাহারের বাহারে বা মানিপ্ল্যান্টের লতানো অনুষঙ্গে। আমরা দুই ভাইবোনের কেউই ধ্বংসাত্বক ধরণের না হওয়ায় বাসার সব রুমগুলোর সাজসজ্জায় ক্রিস্টালের ছড়াছড়ি হতেও সময় লাগেনি। আমি রাঙ্গিয়েছিলাম আমার দেয়ালগুলো নানা রঙ্গে, নকল সূর্যমুখী ফুল থেকে শুরু করে চে গুয়েভারা বা সুলতানের ছবি অলঙ্করন করেছে আমার প্রতিটা দেয়াল, বইগুলো গুছাতে যদিও সময় লেগেছিলো অনেক। দিনে দিনে টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে কেনা বই স্তুপাকারে মেঝেতে রাখাও যখন অসম্ভব হয়ে গেলো তখন বাবা আমার হাতে ধরিয়ে দিলো ড্রিল মেশিন, দেয়াল ফুটো করে তাতে তক্তা বসিয়ে তাক তৈরী করলাম কয়েকটা, বই রাখার জন্য, পরে বুকশেলফ বানানোর পরে অবশ্য সেগুলোতে সিডি আর ডিভিডি বইয়ের জায়গা নিয়ে নিতে দেরী করেনি।

চারতলা বাসার চারনম্বর তলায় আমাদের পশ্চিম দিকের ফ্ল্যাটটা ঘিরে খেলা করতো আলো আর বাতাস, সারাটা দিন। কলোনীর চারিদিকে গাছ, তাই জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে সবুজের সমারোহে আর যাই হোক, মাথা গরম হতোনা। বাইরের মাঠে সমবয়েসীদের হুল্লোড় করতে দেখে প্রথমদিনই বেরিয়েছিলাম ভাব করতে, সপ্তাহখানেকের মাঝেই কাছাকাছি বয়েসী একদঙ্গল ছেলেমেয়ের পালের মধ্যে আমিও হয়ে উঠলাম একজন! বাসার সামনে পিছনে আম-জাম-কাঠাল-কলা-বরই-কামরাঙ্গা-সজনে গাছের ছড়াছড়িতে অতি বড় ভদ্র বাচ্চাও দুদিনেই গাছবাওয়া শিখে ফেলতে বাধ্য, আর আমিতো আজন্মই গেছো! পিছনে পুকুরের কাছে ঝোপঝাড়, গ্রীষ্মের দুপুরে হলদেটে লু হাওয়ায় পানির জন্য ওদের হাহাকার আমি কান পেতে যেন শুনতে পেতাম। দিনের বেলায় চুলার মত হয়ে থাকা আমার ঘরটায় চৈত্র মাসের বাতাস শুধু টেবিল থেকে কাগজপত্রই না, সাথে স্বস্তিটুকুও সরিয়ে নিত লোডশেডিঙকে সঙ্গী করে। ফলের গন্ধে মাতোয়ারা চারিদিকের শান্তি ভঙ্গ করতাম আমরা দুষ্ট ছেলে মেয়ের দল, ঢিল মেরে, আর কালবোশেখীতেতো কথাই নাই, কে কত আম কুড়াতে পারে, এই প্রতিযোগীতায় বর্শার ফলার মতো বৃষ্টির ধার গায়েই মাখতামনা আমরা। বর্ষাকালে অপরাজিতাগুলো নীল নীল চোখ মেলে পাতার ফাঁকে উঁকি দিয়ে, আমি তাকালেই মনে হয় লজ্জায় মুখ নামাতো। ঝুম বৃষ্টিতে জানালার পাশে একগ্লাস গরম দুধ আর হাতে একটা রগরগে উপন্যাস, বাতাসে খিচুড়ির সুঘ্রাণ, আহ সেকি ভোলা যায়! মাঝে মাঝে ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভেজা, তাতে নাকি ঘামাচি মরে! আকাশ ভেঙ্গে যখন বৃষ্টি নামতো, ধোঁয়া ধোঁয়া নীলচে কালো মেঘগুলো যখন রেষারেষি করে বাজ হানতো ভয়াবহ শব্দে, তখন ব্যাংদের আনন্দ দেখে কে! সামনের এক টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ সেতারের রিমঝিম বাজনার চেয়েই বা কম কীসে! শরতে পিছনের মাঠ থেকে ছিড়ে আনতাম থোকা থোকা কাশফুল, সেই স্বভাব আমার আজও যায়নি। ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে পরে থাকতো শুকনো পাতা, কড়মড় করে মাড়িয়ে যেতে যেতেই পায়ের ছোঁয়ায় লজ্জাবতীর লজ্জা দেখে বাচ্চাদের মতো খেলায় মেতে উঠতাম। শীতের দিনে মুখের সামনে হাত নিয়ে বাষ্প উড়িয়ে ভাব নিতাম সিগারেট খাবার। আর একেকদিন শীতের পিঠা খাবার দাওয়াত থাকতো দলের একেক বন্ধুর বাসায়।

গভীর রাতে, যখন ঘুম আসতোনা, তখন চমকে উঠতাম দূরে কোনও বাচ্চার কান্নায়, কুকুরের ডাকে বা হঠাৎ পাশের গাছে ডেকে উঠা কাকের কর্কশ স্বরে। জানালার পাশে বসে দেখতাম চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া পৃথিবীটাকে, বয়ে যাওয়া মৃদু হাওয়ার মাঝে যেন লুকিয়ে থাকতো কোনও এক সম্মোহনী মন্ত্র। সেই অপার্থিব আলোয় আলোয় পাওয়া কোনও সুখ, মনে হতো তা মুখে বলে বুঝানো যাবেনা; দুঃখগুলো মনে হতো সুখের চেয়েও ভালো। নির্জন সময়গুলোতে একা একা গেয়ে উঠতাম আগডুম বাগডুম নানা গান, সুর দিতাম বিচিত্র সব ছড়ায়, 'আজকে আমার মনের মাঝে, ধাঁই ধপাধপ তবলা বাজে' অথবা 'নীল মাথাতে সবুজ রঙের চুল, পাপাঙ্গুল'- বীজমন্ত্রের মতো জপ করতাম ঘন্টা কয়েক ধরে। পাগলা দাশুর অভিনয় করতে করতে হেসে উঠতাম হঠাৎ, হাতে সময় থাকলে গুপী-বাঘার জাদুর জুতো পায়ে ঘুরে আসতাম হুন্ডী-ঝুন্ডী-শুন্ডী! দিন, রাত, ষড়ঋতূর হেরফের, রোদের লুকোচুরি মেঘের সাথে, আকাশের রঙ বদল, ঝুমঝুমঝুম বৃষ্টি- যা কিছু আমরা এমনি এমনিই পেয়ে যাই, সাথে স্বপ্ন-কিছু, অনেক, অবাস্তব, অসম্ভব এসব নিয়ে দিন কেটে গেলো একটা দুটো তিনটে করে, বছর ঘুরলো, যুগ পাল্টালো, মেয়েদের কামিজের ঝুলের মাপ কমলো অনেক কিন্তু এই আকাশ-বাতাস-মেঘ-বৃষ্টি-রোদ সব যেন চিরন্তনই রয়ে গেলো! আর .আমি বালিকা থেকে তরুনী হবার পথে পা বাড়ালাম!
২৫টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×