উত্তরবঙ্গের কথা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে মঙ্গাপীড়িত দরিদ্র এক জনপদের মুখচ্ছবি।যে জনপদের প্রতিটি মানুষই লড়াই করে দারিদ্রতার সঙ্গে। বেঁচে থাকে নিদারুন অর্থকষ্টে। আসলেই কি তাই?একসময় ভাবা হতো যমুনা নদীর উপর সেতু নির্মান হলেই বদলে যাবে এই অঞ্চলের ভাগ্য। সেতু নির্মিত হয়েছে সেই ১৯৯৮ সালে। এরপর কতটা বদলেছে উত্তরবঙ্গ? এরকম নানা জানা-অজানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই গন্তব্য উত্তরের জনপদ।
গভীর রাতে দেশের সবচেয়ে উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেতুঁলিয়া। জেলা পরিষদের ডাক বাংলোয় যখন ঠিকানা মিললো তখন আকাশে পূর্ন চাঁদ। কিছুটা ঢালের উপর মহানন্দার তীর ঘেঁষে এই বাংলো। বাংলোর বারান্দায় বসে যখন উপভোগ করছি চাদেঁর আলোয় মহানন্দার পানির চিকচিক স্বর্নচ্ছটা তখনও ভাবনাতে নেই সকালে এই মহানন্দায় কিসের দেখা মিলবে।
সকাল দশটা। বাংলো থেকে কিছুটা এগিয়ে সদ্য তৈরি হওয়া এশিয়ান হাইওয়ে দেখে মুগ্ধতা কেবল বাড়ছেই।এতো প্রশস্ত রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে সামনে সীমান্তের দিকে এগুতে থাকলেই চোখে পড়বে দুপাশে পাথরের স্তুপ। পাথরভাঙা মেশিন। আর শত শত নর-নারীর সেই পাথর জড়িয়ে কর্মযজ্ঞ। কিছুটা এগিয়ে মহানন্দার জলে পা দেওয়া। বহু শ্রমিক নদী থেকে পাথর উত্তোলনে ব্যস্ত। একজন টুপ করে ডুব মারে স্বচ্ছ অগভীর মহানন্দের জলে। তুলে আনে পাখরের স্তুপ। দশ বারজন মিলে টেনে নিয়ে আসে সেই পাথর উঁচু স্থানে। সেখান থেকে আবার পাথর বাছাই করে আলাদায় ব্যস্ত আরেকদল। তারপর পাথরভাঙা, লোড-আনলোড আরও নানা প্রক্রিয়া শেষে বেচাকেনা। এই পাথরশ্রমিকরা যেখান থেকে পাথর তুলছে তার ঠিক অল্প কিছুটা দুরুত্বে মানে ছোট মহানন্দার ওপারেই ভারতের কাঁটাতারের বেড়া। অথচ এই শ্রমিকদের মনে কোন ভয় ডর নেই। নির্বিবাদে এই পাথর উত্তোলনে ব্যস্ত সকলেই। হিমালয় বিধৌত পুরো পঞ্চগড় যেন পাথরের খনি। জেলার করতোয়া, মহানন্দাসহ সবক’টি নদী-নালায় পাথর পাওয়া যায়। খালবিল, সমতল ভূমি কিংবা আবাদি জমি যেখানেই খোঁড়াখুঁড়ি সেখানেই পাথর। কোথাও কম, কোথাও বেশি। প্রতি বছর সেখান থেকে উত্তোলন করা হয় হাজার হাজার টন পাথর। সারাদেশের প্রায় ৬০ ভাগেরই অধিক পাথর সরবরাহ করে এই পঞ্চগড়ের পাথরশ্রমিকেরা। সেই সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি নদী থেকে পাথর উত্তোলনে ব্যস্ত থাকে তারা। দুপুরের খাবারটাও এই নদীতে। পাথরের স্তুপের উপর বসে ভাত-ডাল খেয়ে নেয়া। নদীতে যখন পানি কম থাকে তখনই এই পাথর উত্তোলনের মৌসুম। বর্ষা আসলেই পানি বেড়ে যায়। তখন অনেকটাই ঘরে বসে থাকতে হয় বিশালসংখ্যক পাথরশ্রমিককে। কথা হলো আবুল বাশার নামে এক পাথর শ্রমিকের সঙ্গে। বললেন, পাথরই তাঁদের শিল্পকারখানা, পাথরই তাঁদের ব্যবসা, পাথরই তাঁদের অন্নের যোগানদাতা। যেহেতু পুরো উত্তরবঙ্গে ভারী কোন শিল্পপ্রতিষ্ঠান নেই সেহেতু আঞ্চলিকভাবে এই পঞ্চগড়েই গড়ে উঠেছে এই প্রাকৃতিকসম্পদকে ঘিরে এক মহাকর্মযজ্ঞ।শোনালেন এক অদ্ভুত কথা। তারা নাকি পাথর খেয়ে বাঁচে। ব্যখ্যাও দিলেন সেই কথার। যেহেতু নদী থেকে পাথর উত্তোলন করেই জীবন জীবিকা নির্বাহ করছে তারা, পেটে পুরতে পারছে দুমুঠো অন্ন কিংবা নিজের দেখা স্বপ্ন পূরনের লে স্কুলে পাঠানোর সাহস দেখাচ্ছে নিজ সন্তানকে সেহেতু তাঁরা পাথর খেয়েই বাচেঁ।পাথরকে ঘিরেই অদ্ভুত সব জীবিনকাহিনী এগিয়ে চলে এখানে। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম। সেই সকাল থেকে বিকেল ভারী পাখর তুলে আনে যারা নদী থেকে কিন্তু তাঁদের মজুরী? যে পরিমান কষ্ট আর শ্রমে ধনীর বাড়ির ভীতগড়ার মূল উপকরন পাথর সরবরাহ করে এই শ্রমিকেরা সেই তুলনায় মজুরী সামান্যই। মজুরীর নামে চলে প্রহসন।
এই পাখরশ্রমিকদের মধ্যে কোন লিঙ্গবৈষম্য নেই। কি নারী কি পুরুষ কিংবা শিশুই সকলেই ব্যস্ত এই পাথর উত্তোলন থেকে পাথার বিক্রি পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে। পঞ্চগড়েরর প্রায় ৪০-৫০ হাজার শ্রমিক জড়িয়ে আছে এই পাথরব্যবসার সঙ্গে। মূলত পঞ্চগড়ের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি এই পাথর। উত্তরবঙ্গের বদলে যাওয়ার শুরুটা এই পঞ্চগড় থেকে। আর পঞ্চগড়েরর বদলে যাওয়াটা এই পাথরকে কেন্দ্র করে। কিন্তু সেই ইতিবাচক দিক থেকে ভাগ্য বদলানোই এখনই নেতিবাচকভাবে ভাগ্য বদলে দিতে পারে যেকোন মুহুর্তে।
পঞ্চগড়ের এই পাথর এখন কেবল নদী থেকেই উত্তোলিত হচ্ছেনা। পাথর যেনো এখানে চাষ হয়। মাটি খুঁড়লেই দেখা মিলবে পাথরের। একবার যে জায়গা থেকে পাথর উত্তোলন করা হয় কয়েক বছর পর ঠিক একইজায়গায় প্রকৃতিগতভাবে পাথরের সন্ধান মিলে। আর তাই এখানে এখন আবাদী জমি খুড়েঁ সেখান থেকে পাথর উত্তোলন হচ্ছে। যার পরে বদলে যাচ্ছে ভূ-প্রকৃতি। পরিবেশ পড়েছে মারাত্বক হুমকির মুখে। যেকোন মুহুর্তেই ঘটতে পারে ভূমিধসের মত ঘটনা।নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে , শুকয়ে যাচ্ছে এখানকার সব নদীই। ভুগর্ভস্থ এই পাথর নামক খনিজসম্পদ উত্তোলনের েেত্র সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালা না থাকাতেই পাথরখেকো কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অবাধে পাথর উত্তোলন করে চলেছে। পঞ্চগড়ের পরিবেশ সংশ্লিষ্ট এমনকি পাথরশ্রমিকেরাও চায় এই েেত্র রাষ্ট্রের নজরদারি। কেননা এই পাথরই যেমন তাঁদের আয়ের উৎস ঠিক তেমনি তাঁরা বেঁচেও থাকতে চায় স্বাভাবিকভাবে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




