“মা, মা, কোথায় তুমি? এদিকে একটু এসে দেখে যাও!”-মেয়ের ডাকে রীতা ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে নিল। জানালা দিয়ে দেখল আকাশ কালো হয়ে এসেছে। বোধহয় বৃষ্টি হবে। অনেকদিন বৃষ্টি হয়না এই ইট-কাঠের শহরে। সেই গতমাসে বোধহয় একবার বৃষ্টি হয়েছিল। এরপর আর বৃষ্টির নামগন্ধ নেই। কাজ করতে করতে কখন যে বেলা গড়িয়ে বিকেল হয়েছে খেয়াল করেনি সে। নিজে নিজেই ভেবে বেশ অবাক হল। রিডিং টেবিলের টেবিল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে প্রায় বিকেল ৪ টে বাজতে চলল। কিন্তু এখনো কত কাজ বাকি!-রীতা মনে মনে ভাবল। কিছুদিন থেকেই সে খুব অস্থির হয়ে আছে। অফিসে কাজের চাপটাও একটু বেশি। পরের সপ্তাহে কোন এক বিদেশী ক্লায়েন্ট আসবে আর তাদের জন্য প্রেজেন্টেশন করার দায়িত্ব রীতা-র উপর দিয়েছে অফিস। রীতা এই চাকরি করছে অবশ্য খুব বেশিদিন হয়নি, মোটে এক বছর তবে এরমধ্যে কাজের পারদর্শিতার কারণে অফিসে তার একটা অবস্থান সে তৈরি করে নিয়েছে। আগে যেখানে সে জব করত, সেটিও খুব খারাপ ছিলনা। কিন্তু মেয়ের জন্মানোর পরে নিজের দায়িত্ব অনেক বেড়ে যাওয়ায় সে চাকরি ছেড়ে দেয়। এরপর মেয়ে একটু বড় হলে, সে তার স্বামীর সহযোগিতায় আর একটি চাকরি পেয়ে যায়। সেখানেই এখনো কাজ করছে রীতা। এই অফিসে কাজের একটা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ সে পেয়েছে। রীতা এখনো অবাক হয়, খুব তাড়াতাড়ি সে এখানে খুব ভাল কিছু বন্ধু সহকর্মী পেয়েছে। সুস্মিতা, ওর অফিসের এক কলিগ। যদিও বয়সে রীতার থেকে বছর খানেক জুনিয়র তবে মেয়েটির সাথে তার এক অদ্ভুত ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। কখনো অফিসে না যেতে পারলে সুস্মিতা রীতার সব কাজ সামাল দেয়। মেয়েটি অনেক স্মার্ট-অন্তত এমনটি মনে করে রীতা। সুস্মিতা বিয়ে করেছে আমেরিকা ফেরত সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারকে। এইতো গেল সপ্তাহে সুস্মিতা রীতাদের নিয়ে সেন্ট-মার্টিন ঘুরে আসল। মানে, দুই পরিবার গিয়েছিল। সুস্মিতা আর ওর জামাই এবং রীতা, রীতার বর আর ছয় বছরের মেয়েটি। অবশ্য রীতার জামাইও একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, তাই একসাথে দুইজন মিলে ঐ ছুটির মধ্যেও কাজের আলাপসালাপে ব্যস্ত ছিল। রীতা মনে মনে ভাবে- এই এক সমস্যা এদের। নিজেদের প্রফেশনের লোক পেলে আর হুশ থাকেনা। ছুটিতে এসেও তারা ভুলে যায় যে তারা ছুটিতে এসেছে। রীতার স্বামী আহমেদ রাকিব খান একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, বছরের বেশ কিছু সময় দেশের বাইরেই কাটাতে হয়। যেমন কিছুদিন আগেই সে অফিস থেকে ট্রেনিং এ ইন্ডিয়ায় গেল। বোধহয়, আগামী সপ্তাহেই ফিরে আসবে সে। রীতার সাথে রাকিবের বিয়ে হয় প্রায় ৮ বছর হতে চলেছে, বাবা-মায়ের মতেই পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয় ওদের। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে দেয়া মাত্রই বিয়ে হয়ে যায় রীতার। রীতা বিয়ের পর থেকেই দেখে এসেছে রাকিবের কাজের প্রতি আগ্রহ। এখনো কাজপাগল মানুষটির কাজের নেশা কমেনি। আসলে রীতা যে এখনো চাকরি করছে, তার অনুপ্রেরণা সে পেয়েছে তার স্বামীর কাছ থেকেই। এমনকি, মেয়ের জন্মের পরও তাকে একটি ভাল চাকরি খুঁজে দিয়েছে রাকিব। আসলেই নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী বলে মনে করে রীতা। “মা, কোথায় তুমি?”-মেয়ের কণ্ঠস্বরে রীতার সম্বিত ফিরে আসে। সে কিছুটা হন্তদন্ত হয়েই মেয়ের ঘড়ে যায়। সে দেখে মেয়ের হাতে তার পুরানো ফটো-এলবাম। প্রথমে নিজের মেয়েকে ঐভাবে নোংরা জিনিষ ঘাটাঘাটি করতে দেখে একরকম রাগ হয় মেয়ের উপর। কোত্থেকে এই ফটো-এলবামটি যে বার করল ও, সে নিজেও বুঝতে পারেনা। বোধহয় পুরানো কা-বার্ডে এককোণে পরে ছিল। এখানে রীতা-র স্কুল-কলেজ আর ভার্সিটি জীবনের কিছু পুরানো ছবি আছে। রীতা দেখল, মেয়ের হাতে একটা তার নিজের স্কুল জীবনের ছবি। “মামনি, এটা কি তোমার ছবি?”-মেয়ের আদুরে গলায় রীতা-র মনের রাগ নিমেষেই কর্পূরের মত উবে যায়। খুব বেশিক্ষণ রাগ ধরে রাখতে পারলনা রীতা। সেও মেয়ের মত আদুরে গলায় বলে-“হ্যাঁ,মামনি। এই ছবি আমার। আমার বয়স যখন তোমার মত, সেসময়ের ছবি।”-রীতা কথাটি বলেই যেন নিজে নিজেই স্মৃতির ধুসর পাতা উল্টাতে থাকে কিছু খুঁজে পাবার আশায়! হঠাৎ করেই মেয়ের হাত থেকে পরে গেল ফটো-এলবাম আর জীর্ণ এলবাম থেকে অনেকগুলো ছবি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে। রীতা তা দেখেই ছবিগুলো তুলতে যায়। তখনি কোন এক অবাধ্য বাতাসের তোরে একটি ছবি উড়ে গিয়ে পরল দরজার ওপাড়ে। রীতা কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘড় থেকে বেরিয়ে ছবিটা তুলতে গেল। ছবিটা হাতে নিতেই চমকে ওঠে রীতা। এটা তো সেই ছবি!-রীতা নিজে নিজে ভাবে। ছবিটা হাতে নিয়েই অন্যমনস্ক হয়ে পরে সে। ছবিটা হয়ত তেমন আহামরি কিছু নয় তবে তার কাছে এর আবেদন চিরন্তন। রীতা দেখল, এরই মধ্যে মেঘলা আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। পিচ ঢালা রাস্তা বর্ষা সিক্ত, কিছুটা কর্দমাক্ত আর সেই রাস্তা দিয়ে মানুষের দুরন্ত পদচারণ। সবাই যেন কোন আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে। ঐ যে পাশের বাড়ির মেয়েটি বারান্দা থেকে কাপড় তুলতে এসেছে-সবইতো আমাদের শহরের চিরাচরিত দৃশ্য। তারপরও রীতার কাছে সবকিছুই কেন যেন অচেনা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আজ আকাশের যে কান্না, প্রকৃতির যে মন খারাপ-সব যেন তার জন্য। বারান্দায় এককোণে রাখা চেয়ার টেনে অন্যমনস্ক ভাবে বসল রীতা, খুব আচমকা ভাবেই যেন সবকিছুই ওলট-পালট হয়ে গেল। হাতের ছবিটির দিকে আরেকবার তাকালো সে, খুব সাদামাটা ভাবেই তোলা একটি ছবি। কিন্তু এই ছবির সাথে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ছবিতে যে ছেলেটিকে দেখা যাচ্ছে সে আজ কোন দূর সীমানায় হারিয়ে গিয়েছে তা জানেনা রীতা। শুধু এটুকুই জানে যে ছেলেটি তাকে অনেক ভালবাসত, এতটাই ভালবাসত যে কখন যে নিজের সত্ত্বাকে সে বিকিয়ে দিয়েছিল খেয়াল করেনি। তিলতিল করে নিজে জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে গেল। এখন আকাশকে যেন আরও বেশি কালো মনে হচ্ছে রীতার কাছে। রীতা আকাশের দিকে তাকিয়ে স্মৃতির কিছু অমলিন পাতা রেখাপাত করতে লাগল।
আজ থেকে অনেকগুলো বছর আগে-রীতা মনে করার চেষ্টা করে। হ্যাঁ, ২০ বছর আগে সেসময় সে কলেজ ২য় বর্ষের ছাত্রী। পড়াশোনা, কলেজের ক্লাস, বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো আর বিকেলে প্রাইভেট পড়তে যাওয়া এভাবেই যেন সেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল। সকালে ক্লাসের পরে বান্ধবীদের সাথে দলবেঁধে ঘুরে বেড়ানোতেই ছিল সকল আনন্দ। তার কলেজ জীবনের খুব ভাল বান্ধবী ছিল প্রমীতা। রীতা ওকেই সব থেকে বেশি বিশ্বাস করত,বোধহয় নিজের থেকেও একটু বেশি। এমন কোন ঘটনা ছিলনা যা রীতা ওকে বলত না! আর এই প্রমীতার পাশাপাশি তার আরও একজন ভাল বন্ধু ছিল, সে হল এই ছেলেটি। ছেলেটির নাম ছিল আকাশ। আকাশের সাথে পরিচয় হয়েছিল স্যারের কাছে পড়তে গিয়ে। ছেলেটি ছিল ভদ্র, ক্লাসের সব থেকে চুপচাপ ছাত্র। কোনদিন নিজে থেকে কথা বলেনি প্রথমে তাই রীতাও কথা বলেনি। তবে প্রয়োজনও দেখা দেয় অনেকটা আকষ্মিক ভাবেই। প্রথম কথা হয় ক্লাস শেষে এক বিকেলে, যদিও সেদিন সম্পুর্ণ ছিল প্রয়োজনের খাতিরে। হয়ত, সেইদিন প্রথম ও শেষ কথা হতে পারত। কিন্তু বোধহয়, সৃষ্টিকর্তার অন্য রকম পরিকল্পনা ছিল। অনেকদিন কথা নেই, দেখা নেই। এভাবেই চলতে চলতে খুব আকষ্মিক ভাবেই আকাশের সাথে দেখা হয়ে যায় রীতার। একথা সেকথা থেকেই তারা কিছুটা পরিচিত হয়। এরপর ফোন নাম্বার দেয়া নেয়া তাদেরকে আরেকটু পরিচিত হতে সাহায্য করে। এক সময় তারা নিজেরা খুব ভাল বন্ধু হয়ে যায় একে অপরের। তারা নিজেরাও হয়ত বুঝতে পারেনি কখন তারা এত কাছাকাছি চলে আসে। এরপর তো দিনের পর দিন কেটে গেল, কত দিবা-রজনী ভাল বন্ধুত্বের সেতু বন্ধন তৈরী করে গেল। কখনো তাদের মাঝে দুরত্ব সৃষ্টি হবে তা কেউ কোনদিন ভাবতেও পারতনা। রীতা নিজেই মনে করতে লাগল, কত ভাল বন্ধু ছিল তারা। সেই সময় কথা না হলে মনে হত, কতকাল যেন নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ হয়না। খুব সামান্য কত কারনে নিজেদের মধ্যে যে মান-অভিমান হত তাদের মাঝে- সেই অনুভুতিটুকু আজ বোঝাতে পারবেনা রীতা। রীতার মুখে স্মিত হাসি, এ হাসি হঠাৎ করেই নিজের জীবনের সব থেকে সুন্দর মুহূর্ত গুলোকে মনে পরার জন্য। বাইরে অঝর ধারায় বৃষ্টি নেমেছে। আকাশ বৃষ্টি পছন্দ করত, আর ভালবাসত সে বৃষ্টিতে ভিঁজতে। কখনো কখনো আকাশ এত পাগলামি করত, বৃষ্টির সময় হুটহাট করে ভিজতে চলে যেত। এত বাধা-নিষেধের পরও সে কথা শুনতনা। এভাবেই চলছিল, কিন্তু যে কোন কারনেই হোক না কেন, ভার্সিটি ভর্তির পর ওদের মধ্যে যোগাযোগ অনেক কমে গেল তারপরও বন্ধুত্বের টান কিন্তু একদম কমেনি। যদিও দুজনেই অনেক ব্যস্ত হয়ে পরল, কিন্তু বন্ধুত্ব কি সেসব কিছু মানে! ছুটি পেলেই দেখা করত, ছেলেটি তার হোস্টেল থেকে চলে আসত বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে। খুব সুন্দর সম্পর্ক ছিল তাদের মাঝে। কিন্তু রীতা চিন্তাও করেনি, কোনদিন এই সম্পর্কে ফাটল ধরবে!
সেবার অনেক শীত পরেছিল এই নগরীতে। সেই রকম শীতের রাতে আকাশ একটা কথা বলে তাকে যা কোনদিন ভাবেওনি। আকাশ বলে যে সে রীতাকে ভালবাসে! রীতা যেন আকাশের কথা শুনে খুব অবাক হয়, কোনদিন ভাবেনি এমন কিছু বলে বসবে। কিন্তু রীতা যে আকাশকে ভালবাসেনা; সে কি করে বলবে আকাশ কে! আকাশ যদি কষ্ট পায়, এসব চিন্তা করে আর কিছুই বলতে পারেনা রীতা, শুধু বলে যে পরে সময় আসলে দেখা যাবে, এখনো সময় হয়নি। এভাবেই সেদিনের মত আকাশকে মানিয়ে নেয় রীতা। কিন্তু, রীতা আকাশের সাথে যোগাযোগ অনেক কমিয়ে দেয়, সে ভাবে হয়ত এভাবেই একদিন আকাশ ভুলে যাবে রীতাকে। কিন্তু বিধাতার কি অন্য পরিকল্পনা ছিল নাকি আকাশ রীতাকে এতই ভালবাসত, যে তাকে ভুলতেই পারলনা। আকাশ অপেক্ষার প্রহর গোনে আর ভাবে হয়ত একদিন রীতা তার কাছে আসবে, হয়ত একদিন তার সুখের স্বপ্ন গুলো সত্যি হবে।
একে একে দিন যায়, মাস কাটে, বছর অতিক্রম হয়ে গেল, আকাশের সাথে রীতার যোগাযোগ নেই বললেই চলে। কখনো কখনো যোগাযোগ হলেও আকাশ ভাল করেই বুঝতে পারে যে রীতা আর সেই রীতা নেই যে আকাশের সাথে একদিন কথা না বলে থাকতে পারতনা। আকাশের সেই রীতা যে আজ কোথায় হারিয়ে গেছে, বুঝতে পারেনা সে। নিজে নিজেই মনঃকষ্টে ভুগতে থাকে। কাউকে কিছু না বলে একটু একটু করে কষ্টের বীজ বোনে আকাশ। বর্ষার আকাশে যেমন মেঘের ঘনঘটা দেখা যায় তেমনি আকাশের হৃদয়ও মেঘাচ্ছন্ন। ও কিভাবে নিজেকে বোঝাবে, সান্তনা দেবে বুঝে পায়না। পুরোনো ছবি, মুঠোফোনের কিছু বার্তা এসব দেখেই আকাশ স্মৃতির পাতায় রীতাকে জীবন্ত করার চেষ্টা করে। মনে পরে যায় অনেক কথা, অনেক মুহুর্ত যেগুলো অমূল্য। মনে পরে একদিন রীতা আকাশকে বলেছিল-“তুই আমার সব থেকে ভাল বন্ধু”। আজ সেই কথাগুলো্র কোন মূল্য বোধহয় নেই রীতার কাছে।
এদিকে দিনের সাথে সাথে রীতা বুঝতে পারে আকাশের অনুপস্থিতি। বুঝতে পারে, কেউ যেন নেই। কিন্তু রীতা কি করবে! হাতে মুঠোফোন নিয়ে আকাশকে ফোন দিল রীতা, কিন্তু ফোনের ব্যালেন্স নেই। ব্যস্ততার মধ্যে ভুলেই গিয়েছিল ফোন রিচার্জ করার কথা। ল্যান্ডফোনের রিসিভার হাতে নিয়ে আকাশের নাম্বার ডায়াল করতে গিয়ে মাঝপথে কি মনে করেই থেমে গেল। রিসিভারটি আবার রেখে দিয়ে বারান্দায় এসে দাড়ালো। কিছুটা আনমনে রীতা যেন কি ভাবছে! হঠাৎ করেই তার চিন্তারেখায় ছেদ পড়ল একটি বাচ্চা মেয়ের কন্ঠ শুনে-“বাবা, বাবা-আমি আইস্ক্রিম খাবো!” রীতা দেখল একটি ৪-৫ বছরের মেয়ে তার বাবার হাত ধরে বায়না করছে। তার বাবা মেয়ের জন্য একটা আইস্ক্রিম কিনতেই পাশের দোকানে থামল। এভাবেই রীতাও বাবার হাত ধরে কিছু বায়না করত। কিন্তু এখনতো আর বাবার হাত ধরে কিছু চাওয়া হয়না। কিন্তু বড় হবার পরেও তো আকাশের কাছে সে যেন এভাবেই বাচ্চা মেয়ের মত কিছু বায়না করত! আকাশের কথা মনে হতেই রীতার মন আরো খারাপ হয়ে যায়। আকাশ শিশুদের খুব ভালবাসত। নিজেও সবসময় বলত রীতাকে, যদি মেয়ে হয় তাহলে নাম রাখতে অনেন্দিতা আর ছেলে হলে রাখতে দিগন্ত। রীতা এসব শুনে শুধু হাসত আর বলত-“আগে বিয়েতো করি! এরপর দেখা যাবে”।
এভাবেই একদিন রীতা ইউনিভার্সিটি থেকে চাকরি জীবনে প্রবেশ করল। আকাশের সাথেও যোগাযোগ নেই অনেকদিন। মাঝে একবার খবর নেবার চেষ্টা সে করেছে কিন্তু কোন খবর পায়নি। কি আর করা, রীতাও তার জীবনকে গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পরল যথারীতি। এদিকে আকাশ তখনো মনে রীতার ছবি এঁকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুড়ছে চাকরি খোঁজার জন্য। যদি একটা ভাল চাকরি পেয়ে যায় তাহলে আবার রীতাকে সে তার ভালবাসার কথা বলবে। মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে, আকাশও স্বপ্ন দেখতে ভালবাসত। সে স্বপ্ন দেখত একটি সুন্দর জীবনের। একবার সে ভাবে, যে রীতার বাসায় যাবে কিনা, কিন্তু পরক্ষনেই তার ব্যাক্তিত্ববোধ তাকে বাধা দেয়। ‘নাঃ, নিজের পায়ে না দাঁড়ানো পর্যন্ত সে কখনোই ও-বাড়ি যাবেনা’-মনে মনে নিজেকে বুঝ দেয় সে। এভাবেই দিন শেষে ঘড়ে ফিরে শুয়ে পরল। খুব ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত সে। মনে তার অনেক চিন্তা, আজকেও কোন চাকরি সে পেলনা। কোথাও কেউ তাকে চাকরি দেবার জন্য আগ্রহী নয়। এতটা খারাপ কিছু হবে কখনো ভাবেনি আকাশ।
এদিকে রীতার মা-বাবা রীতার জন্য পাত্র দেখছেন। মেয়ে বড় হয়ে গেছে। বিয়ে তো এবার দিতেই হবে। একদিন রীতার বিয়ের কথাও পাকাপাকি হয়ে গেল। এবার শুধু শুভ দিনের অপেক্ষা। সকলেই যেন খুব ব্যাস্ত বাড়ির মেয়ের বিয়ে নিয়ে। সেদিন আবার আকাশ চাকরির খোঁজ করতে গিয়েছিল। কিন্তু ফিরবার পথে একটি বেপরোয়া বাসের ধাক্কায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। আকাশ সেদিন মেডিকেলে ভর্তি হয় আশংকাজনক অবস্থায়। এরপর একদিন কেটে গেল, আকাশের সঙ্গাহীন অবস্থায়। ডাক্তার কিছুই বলতে পারে না। এরপর জ্ঞান ফিরলেও প্রায় ৪৮ ঘন্টা মৃত্যুর সাথে লড়াই করে হেরে গেল এই জীবনযুদ্ধে পরাজিত সৈনিক আকাশ।
রীতার সব থেকে ভাল বন্ধু আকাশ যে তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে সে খবর পৌছে যায় রীতার কাছে। রীতা ছুটে গেল আকাশের বাসায়। সেখানে শোকস্তব্ধ পরিবেশ। আজ আকাশের অকালে চলে যাওয়াতে যেন প্রকৃতি শোক ঘোষনা করেছে। রীতাকে দেখে এগিয়ে আসল আকাশের ছোট বোন। ও রীতার হাতে একটি ডায়েরি দিয়ে বলল-“আপু, এটা ভাইয়ার ডায়েরি। ভাইয়ার শেষ ইচ্ছা ছিল এটা যেন আমি তোমাকে দেই”। রীতা কাপা কাপা হাতে ডায়েরি হাতে নিল। আকাশের ছোট বোন নিজের চোখের জল লুকোতেই কিনা ঘড়ের ভিতর দ্রুত পায়ে চলে গেল। রীতাও ফিরতি পথ ধরে চলে আসল বাসায়। হাতের ডায়েরি নিয়ে প্রথম পাতা থেকেই পড়তে শুরু করল সে। সুন্দর হাতের লেখায় দিনপঞ্জি লিখেছে আকাশ। সেখানে সব কথা লেখা আছে। রীতার সাথে ওর প্রথম দেখা, প্রথম বন্ধুত্ব, ভালবাসা। সব কিছু। কিভাবে এক একটা দিন ওকে ছাড়া কাটিয়েছিল আকাশ তাও উল্লেখিত আছে। রীতা মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়তে থাকে। আকাশ তাকে যে পাগলের মত ভালবাসত তা বুঝতে পারে সে। কিন্তু অনেক দেরী হয়ে গেছে, আকাশ বুকে অভিমান নিয়ে চলে গেছে তাকে ছেড়ে। তার ডায়েরির এক পাতায় লেখাঃ
“আমার কথা কি তোমার মনে পরবে, যদি কোনদিন সব দাবী দাওয়া ছেড়ে চলে যাই অনেক দূরে?”
রীতা সেদিন অনেক কেঁদেছিল, কিন্তু সে জানে কোন লাভ নেই এসবে। যে চলে গেছে না-ফিরে আসার দেশে সেতো আর কোনদিন ফিরে আসবেনা।
হঠাৎ মেয়ের ডাকে সম্বিত ফিরে পায় রীতা-“মা, আমার ভয় করছে!” তাকিয়ে দেখে মেয়েটা রীতার কাধে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে নিজে পাথরের মত বসে থাকে। এই মেয়েটি কত বড় হয়ে গিয়েছে। নাম রেখেছে অনেন্দিতা। আকাশের পছন্দের নাম। আজ আকাশ থাকলে দেখতে পারত অনেন্দিতাকে। এই ভেবে রীতার দুই চোখ বেয়ে জল নামে। অনেন্দিতা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে-“মা! তুমি কাঁদছো?” মেয়ের দিকে তাকিয়ে রীতা বলে-“না, মা। আমি কাঁদছিনা। আমি কি কাঁদতে পারি?”
বৃষ্টির ফোটা বড় হয়ে পরতে শুরু করল রীতার বাসার সানশেড দিয়ে। সেদিকে তাকিয়ে আবার বিষন্ন হয়ে পরল সে।
***************************************************
লেখাটি সম্পুর্ন রূপে পরীক্ষামূলক লেখা। আমার প্রথম গল্প লেখার একটি প্রচেষ্টা মাত্র। জানিনা আমি কতটুকু সফল হয়েছি, তবে চেষ্টা করেছি। লেখার সাবলীলতা, প্রাঞ্জলতা, ঘটনার প্রবাহমানতা যথাযথ রক্ষা করার চেষ্টা করেছি। তবে অতিসাবধানতা বশত কিংবা অভিজ্ঞতার অভাবের কারনে ভুল্ভ্রান্তি থাকাটা স্বাভাবিক। সকল ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন বলে আশা করি। ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০১১ রাত ৮:২১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




