প্রিয়,
কেমন আছো? এই প্রশ্ন তোমাকে করা অমূলক কারণ তুমি সর্বদাই ভাল থাকো। তবুও অভ্যাসবশত করেই ফেললাম। অনেক ব্যস্ত তুমি, হয়ত কিছুটা ব্যস্ত আমিও-অস্বীকার করি না। এই ব্যস্ততা কি আজ আমাদের বন্ধুত্বের মাঝে এত প্রকট আকারে চেপে বসেছে যে তুমি-আমি চাইলেও কিছু করতে পারব না। তবুও কি মাঝে মাঝে কি পুরানো দিন গুলো একবারও তোমার হৃদয়ের বায়স্কোপে আবির্ভূত হয়না! হয়ত হয়না। তুমি আমার থেকে অনেক বেশি বাস্তববাদী তাই না হওয়াটাই স্বাভাবিক নয় কি? কিন্তু আমি কখনোই অতীতকে ভুলতে পারিনা। অতীতের মধুর স্মৃতি যেমন আমাকে হাসায় তেমনি দুঃখের স্মৃতি আমাকে সচেতন করে তোলে।
আচ্ছা তোমার কি মনে আছে, আমাদের বন্ধুত্বের সূত্রপাত হয়েছিল কিভাবে? সেই যে মমিন স্যারের ২য় বর্ষের ব্যাচ-এ তুমি আসলে তোমার মায়ের সাথে ভর্তি হতে। সেদিন কিন্তু তোমাকে খেয়াল করিনি একেবারেই, তোমার সাথে কথা হবার প্রশ্নই নেই। আমার এক স্কুল বন্ধু সর্বপ্রথম তোমাকে খেয়াল করে, সত্যি বলতে ও আমাকে ডেকে তোমাকে দেখিয়ে বলে-“দেখ,দেখ আমাদের ব্যাচে একটা টিউবলাইট আসছে!” অনেক ফর্শা ছিলে তো তাই ও এভাবে তোমার পরিচয় দিয়েছিল। সেদিন প্রথমবারের মত তোমাকে দেখি, খুব সম্ভবত একটা আকাশী নীল-সাদা জামা পরেছিলে। খুব ভাল মনে নেই, তাই ভুল হতেই পারে। সেদিন কি ভেবেছিলাম কখনো তোমার সাথে আমার বন্ধুত্ব হবে আর আমিও এভাবে তোমাকে ভালবাসব? আসলে তোমাকে প্রথমে দেখে খুব অহংকারী মনে হয়েছিল, সেটা তোমার বডি-ল্যাঙ্গুয়েজের কারনে মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। এরপর এভাবেই প্রত্যেক রবিবার-মঙ্গলবার আমার ও সাইফের ‘টিউবলাইট’ হয়ে ক্লাসে আসতে আবার ক্লাস শেষে তোমার আম্মুর সাথে চলে যেতে। একটা মজার ব্যাপার কি জানো, আমি তোমার আম্মুকে ভীষন ভয় পেতাম, কেন জানিনা তিনি আমার দিকে এমন ভাবে তাকাতেন যেন আমি সবথেকে বড় অপরাধি। আমিতো তোমার আম্মুর চাহনি এড়ানোর জন্য আমার সেই বন্ধুকে সামনে নিয়ে দ্রুত পায়ে হেটে চলে যেতাম। এখন এসব আমার কাছে হাস্যকর ছেলেমানুষী মনে হয়। কিভাবে দেখতে দেখতে কেটে গেল দিনগুলো টের পাইনি। হঠাৎ করেই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা সামনে এসে পড়ল। খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আমরা সবাই পড়াশোনা নিয়ে। মমিন স্যারের ফাইনাল মডেল টেস্ট শুরু হল, তুমিও আমার সাথেই এক ব্যাচেই পরীক্ষা দেয়া শুরু করলে। সেইসময় তোমার সাথে আমার প্রথম কথা হয়েছিল। হয়ত সেদিন তোমার সাথে আমার শেষ কথা হতে পারত। কিন্তু বোধহয় সৃষ্টিকর্তার কিছু অন্যরকম পরিকল্পনা ছিল। কি জানি-এসব নিজে থেকে বোঝার ক্ষমতা নেই একেবারেই। যাইহোক, এরপর অনেকগুলো মাস কেটে গেল। আমাদের পরীক্ষা শুরু হয়ে আবার শেষ হয়ে গেল। দেখতে দেখতে আমাদের পরীক্ষার ফলাফলের দিন ঘনিয়ে এল। কেন জানিনা, খুব একটা খারাপ ছাত্রী ছিলেনা তবুও তোমার আশানুনুরূপ ফলাফল হলনা। তুমিতো সেদিন সারাটাদিন মন খারাপ করে থাকলে। আমি আমার মায়ের কাছ থেকে তোমার ফলাফল শোনার পর সন্ধ্যার দিকে তোমার সাথে মোবাইলে কথা বলি। তখন তোমার নিজের মোবাইল ছিল না, তোমার মায়ের নাম্বারেই ফোন করতে হত। অনেক সাহস নিয়েই ফোন করেছিলাম তোমার মন একটু ভাল করতে, সেসময় রাত প্রায় ৮ টা, আমি আর আমার কলেজের এক বন্ধুর সাথে আজিমপুর অফিসার্স কলোনির পুকুর পাড়ে বসে ছিলাম। সেদিন ছিল তোমার সাথে আমার প্রথম মোবাইলে কথোপকথন। এরপর অনেকদিন কেটে গিয়েছিল, একদম মনে পরেনি তোমার কথা। খুব ব্যস্ত হয়ে পরেছিলাম ভার্সিটি ভর্তি কোচিং নিয়ে। খুব আকশ্মিক ভাবেই আবার আমাদের দেখা হয়ে গেল। তোমার মা রিকশা দূর্ঘটনায় পা ভেঙ্গে ফেলেছিলেন আর তাকেই দেখার জন্য আমি আর আমার মা তোমার বাসায় গিয়েছিলাম। সেখানেই তোমার সাথে আমার বন্ধুত্বের মূল সূত্রপাত।
সম্পর্কের জটিল সমীকরন মানেনি কখনোই আমাদের বন্ধুত্ব। তুমি কি কখনোই অস্বীকার করতে পারবে যে আমি তোমার ভাল বন্ধুদের বিশেষত খুব ভাল বন্ধুদের একজন ছিলাম না। আমি জানি, তুমি পারবেনা, কারণ টা হয়ত তুমি ভাল বলতে পারবে যে আমাদের বন্ধুত্ব নাটকীয়তা আর বাস্তবতা ছাড়িয়ে একটু অন্যরকম উচ্চতায় পৌছেছিল। মনে আছে, সেই বর্ষাস্নাত বিকেলের কথা, যেদিন তুমি আমার মুখোমুখি বসে বলেছিলে যে আমি তোমার সব থেকে ভাল বন্ধু। এখন বলত, সেই বন্ধুত্ব কোথায় গেল? তুমি বা আমি হারিয়ে গিয়েছি নাকি আমাদের বন্ধুত্ব হারিয়ে গিয়েছে আমাদের মাঝ থেকে? এই কথার উত্তর তোমার কাছে নেই, সে আমি জানি।
একসময়, আমি তোমাকে একদিন ফোন/মিসকল অথবা খুঁদে বার্তা না পাঠালে অস্থির হয়ে যেতে, রাগ করতে, অভিমান করতে। আর আজ, কত পরিবর্তন তাই না? আমি যদি কোনদিন তোমার সাথে যোগাযোগ না করি, তাহলে তোমার কিছুই যাবে আসবে না। তুমি কি এতটা সহজে ভুলে যেতে পারলে? যেই তুমি একদিন তোমার এই বন্ধুর সাথে সারাদিনের কথা শেয়ার না করে থাকতে পারতে না, আজ দেখ কত অবলীলায় আমার কাছ থেকে নিজেকে গোপনে লুঁকিয়ে রেখেছ!
একদিন, তোমাকে কিছু না বলে তোমার খুব প্রিয় এক জায়গায় গিয়েছিলাম ভার্সিটির নতুন বন্ধুদের সাথে, সেদিন তুমি কতই না অভিমান করেছিলে! আজ তুমি তো আর অভিমান করনা।
তুমি আমার সাথে ঘুড়তে যেতে চেয়েছিলে। আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম নিয়ে যাব। সেই তোমাকে নিয়ে আমার ঘুড়ে বেড়ানো আর হয়নি। আমি যখন ১৪ এপ্রিল,২০১০ এ সেই তোমার শরীর খারাপ দেখে তোমাকে বাসায় পৌছে দিতে চেয়েছিলাম-একদম রাজি হলেনা। যার সাথে একদিন ঘুড়ে বেড়াতে চেয়েছিলে, তাকে কেন এত অবিশ্বাস বলতে পার?
আমাকে বিশ্বাস কর বা নাই কর, আমি কিন্তু তোমাকে ভালবাসব এই লক্ষ বা উদ্দেশ্য কোনটাই ছিল না। তবুও কখন যে আমি তোমাকে ভালবেসেছি, আমি নিজেও জানিনা। আর এই অপরাধেই কি তুমি আমাকে এইরূপ শাস্তি দিবে?
আমার বন্ধুরা কি বলে জানো, তারা বলে তোমাকে ভুলে যেতে, বলে নতুন করে জীবন কে নিয়ে চিন্তা করতে। এই কথা একদিন তুমিও আমায় বলেছিলে যে আমি যেন তোমাকে ভুলে যাই। কিন্তু সত্যি বলতে কি, কখনোই ভুলতে পারিনি তোমাকে। তোমার পাঠানো প্রতিদিনের ব্যস্ত ইনবক্সের নিচে পরে থাকা সেই বার্তা গুলো পড়ি কেন জানো? শুধু না পাওয়ার মাঝে তোমাকে একটু খুঁজে পাওয়ার জন্য। এটা যদি আমার অপরাধ হয়, তাহলে সেই অপরাধ মেনে নিতে আপত্তি নেই একটুকু।
একদিন হয়ত সব কিছু ছেড়ে চলে যাব, সেদিন হয়ত তোমার মনে পরবে, কিন্তু অনেক দেরি হয়ে যাবে যে বন্ধু। অনেক দেরি। খুব বেশি ভেব না জীবন নিয়ে, কারন আমি তোমাকে সব সময় বলতাম-আল্লাহ যা করেন তা সবসময় ভালর জন্যই করেন। অনেক ভাল থেকো।
ইতি
তোমার বন্ধু

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




