আমাদের দেশে একটা প্যাটার্ন চালু আছে। খুব সুন্দর করে দেশের ব্র্যান্ডিং করে বোঝানো যে যা করতে হবে জনগণকেই করতে হবে। সেটা টেলিকম ইন্ডাস্ট্রির বিজ্ঞাপন হোক, কোন সাংস্কৃতিক বার্তা হোক, কোন পত্রিকার বিজ্ঞাপন হোক। সবার একই ধরনের কথা। ‘আমরাই পারি’, ‘আমরা বদলালেই বদলে যাবে বাংলাদেশ’। আমি নিজেও আগে এই নীতিতে বিশ্বাস করতাম যে আমরা মানে জনগণরা যদি নীতিতে অটল থাকি তাহলেও দেশের বিশাল পরিবর্তন হয়ে যাবে। কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই বোঝা যাবে যে পুরা ব্যাপারটাই ভাওতাবাজি, বুজরুকি। ব্যাপারটা এরকম যে যারা দুর্নীতিগ্রস্ত এরা তো জীবনে ঠিক হবে না। তুমিই বাবা মেনে নাও। আপস কর বাবা। আওয়ামী বিএনপি তো এরকমই। তুমি তো জানোই। কিন্তু এসব কথা তো আর এভাবে বলা যায় না। সুন্দর মোড়কে সুন্দর সুন্দর বিজ্ঞাপন করে পাগল ছাগল জনগণকে উজ্জীবিত করে বেকুব বানানো। আমাদের মাটির সংস্কৃতি, কর্পোরেট সংস্কৃতিও একই দিকে নির্দেশনা দেয়। কিছু মানুষ না বুঝে আমার মত এই নীতিকে সমর্থন করে। আর কিছু অর্থলোভী, দলকানা মানুষ যারা আপনাকে অবিরাম বলে যাবে ‘আমরা বদলালেই বদলে যাবে বাংলাদেশ’। এদের থেকে খুব সাবধান। এরা রাজনৈতিক দলগুলার লুক্কায়িত এজেন্টও হতে পারে। এরা একটা ‘শূন্যতা’ আপনার সামনে ‘পরিপূর্ণতা’ হিসেবে উপস্থাপন করবে।
আমারই এক ফেসবুক বন্ধু জনগণকে একগাদা দোষারোপ করে বলল- জনগণই খারাপ, এরা ঘুষ দেয়। এরা নিয়ম মানে না। হেন তেন। ঐ একই প্যাটার্ন। মূল কথা। জনগণ বদলালেই বদলে যাবে বাংলাদেশ। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম যে সরকার কোন মুনি ঋষি ধরনের। অনেক তপস্যা করে ঘুষ না নেয়ার পণ করে আছে। আমরা এই পাপী তাপী জনগণ সুন্দরী কামোত্তেজক নারীর মত অর্থ আমাদের কোমড়ে গুঁজে ওঁদের সামনে কোমড় নাড়িয়েই যাচ্ছি। এইসব ঋষিরা আর কতক্ষণ নিজেদের আটকে রাখবে।
পরিবহণ খাত নিয়ে বিশাল এক আন্দোলন হয়ে গেল। সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিন্তু আমি হলপ করে বলতে পারি যে কিছুদিনের মধ্যে যেই লাউ সেই কদু হবে। আবারো দোষ দেয়া হবে জনগণকে। বলা হবে জনগণ নিয়ম মানে না। বিআরটিএ এর চারপাশে দালাল ঘুরে। এই দালালেরা কিভাবে ঘোরে? স্বাভাবিক নিয়মে লাইসেন্স করতে গেলে ঘুরায়ে ঘুরায়ে এমন পরিস্থিতি করবে যে লাইসেন্স করার ইচ্ছাই মরে যাবে। ঘুরে ফিরে সেই দালাল। হাসিমুখে হাজির। টাকা দিলেই হবে। এই আন্দোলনের পরেও বিআরটিএ তে দালাল ঘুরছে। জনগণের নৈতিক কর্তব্য হবে সরকারের কাছেই বৈধভাবে লাইসেন্স করা। লাইসেন্স না পেলেও চেষ্টা করে যাওয়া। কারণ আমরা বদলালেই তো বদলে যাবে বাংলাদেশ। তাই না?? আমার বন্ধুর মত অবুঝ অথবা অর্থলোভী অথবা দলকানারা কখনো বলবে না, এই দালাল সিস্টেম ওঠে না কেন? ওঁরা আমাকে আপনাকে গালি দিবে। আর বলবে আমরা বদলালেই বদলে যাবে বাংলাদেশ।
আমার মা একজন প্রাক্তন সরকারী চাকুরিজীবি। আমার মত যাদের বাবা মা বা আত্মীয়স্বজন সরকারী চাকুরিতে আছেন বা ছিলেন তাঁরা জানেন যে অবসর নেয়ার পর পেনশনের টাকা উঠানোর কি রীতি।
- ও আপনি ৩৫ লাখ টাকা পাবেন? আমাদের একটু মিষ্টি খাওয়ান।
সেই মিষ্টি হতে হবে ৩৫,০০০ টাকার। টাকা না দিলে ওঁরা আপনার পেনশনের টাকা দিবে না। আপনি আমার ঐ বন্ধুর মত ‘গর্জে’ উঠুন। ঘুষ না দিয়ে বসে থাকুন। আপনার খুব দরকার? ছেলে মারা যাচ্ছে। যাক!!! বউ মারা যাচ্ছে? যাক!! আপনি না বদলালে কিভাবে বদলাবে বাংলাদেশ?
আমার মামা মারা গেছেন। ওয়ারিশান সার্টিফিকেট উঠাতে গেলে কাউন্সিলরের কাছে গেলে ঘুষ দেওয়াই নিয়ম। ওয়ারিশান সার্টিফিকেট না পেলে ব্যাংক, বাড়ি ঘর সবকিছুর কাজ আটকে যাবে। যাক!!! আপনি মরে মিশে শেষ হয়ে যান। তাও ঘুষ দিবেন না। আপনি বদলালেই বদলে যাবে বাংলাদেশ।
আমি বেতন পাই ৩২,৪১৫ টাকা। মানে মাসে এটা দিয়ে চলি। বাকি কিছু মনে হয় কেটে টেটে রাখা হয়। আমাদের এনবিআর বাধ্য করল ইনকাম ট্যাক্স দিতেই হবে। নইলে বেতন দিবে না। ট্যাক্স দিতে গিয়ে দেখলাম সময় শেষ। তাহলে এনবিআর এরকম নির্দেশ দিল কেন? কারণ আরেকটা দুই নম্বর উপায় আছে। টাকা দিলে ব্যাকডেট দিয়ে ট্যাক্স নিবে। আমি খারাপ। আমি ঘুষ দিয়েছি। আপনিই বাংলাদেশ। আপনি দিয়েন না। বেতন না দিলে খাবেন কি!!!! খাবেন না। মরে যান আদর্শের জন্য। আপনিই না বাংলাদেশ???
এরকম প্রত্যেক খাতে ‘বাংলাদেশ’ হওয়ার অফুরন্ত সুযোগ আমাদের।
আচ্ছা!! একটা দেশের জনগণ বদলানোর দায়িত্ব কার? এর একমাত্র ধানাই পানাই ছাড়া উত্তর- রাষ্ট্র। রাষ্ট্র একটা দেশের জনগণের অভ্যাস, রীতি-নীতি সব বদলানোর ক্ষমতা রাখে। যদি তাঁরা নিজেরা তা মানে। আমাদের দেশের এই খারাপ মানুষেরা তাহলে বিদেশে গিয়ে কিভাবে নিয়ম মানে? নিয়ম এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটলে তবেই একটা জাতি সুসভ্য হয়ে উঠবে। একদিনে বাংলাদেশ জাপান হতে পারবে না। ওঁদের মত পরিষ্কার করার আইডল হতে পারবে না। এই অনুশীলন তাঁদের বহু দিনের।
অবুঝ দলকানা অর্থলোভী দের বলছি। রাষ্ট্রের গঠন বদলান। আদর্শ বদলান। কিছু হলেই আমাদের গালিগালাজ করা থামান। কিছু না পারলে চুপ করে থাকেন। এই গনতন্ত্র দিয়ে কিছুই অর্জন হবে না। কেউ কাজ না করতে চাইলে তাঁকে দিয়ে কাজ করানো যায় না। এটা দিবালোকের মত স্পষ্ট আওয়ামী বিএনপি কেউই কাজ করতে চায় না। তাঁরা অর্থ উপার্জন করতে চায় অবৈধ উপায়ে। বাংলাদেশ এমন একটা দেশ যে এটা প্রমাণ করতে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের প্রয়োজন হবে না।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৫:৩৭