somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আরব তরুণদের অপচয় ও আভিজাত্যের নতুন প্রতীক

২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ভোর ৪:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কাতারের একটি বহুল প্রচারিত আরবি দৈনিক ‘আশশারক’। দৈনিকটির সঙ্গে প্রতি রবি ও বুধবার দেয়া হচ্ছে প্রায় ৬৪ পৃষ্ঠার ট্যাবলয়েড আকারের বিজ্ঞাপনবুলেটিন ‘আলওয়াসিত’। আমরা অহরহ বাড়ি বিক্রি, গাড়ি বিক্রি, জমিবিক্রিসহ নানা পন্য বেচাবিক্রির বিজ্ঞাপন দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু ‘আলওয়াসিত’-এর শেষ কয়েকপৃষ্ঠাজুড়ে যেসব বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়, তা দেখে আমি শুধু বিস্মিত নয়, অবাক হয়েছি কয়েকবার। শুধু সংখ্যা নিয়ে এমন অবাক কারবার!
হ্যা, সত্যিই অবাক কারবার। বিজ্ঞাপনগুলো থেকে কয়েকটি তুলে ধরার আগে মনে পড়ে গেল নিজের সঙ্গে সংঘটিত একটি দৃশ্যের কথা। এখানকার এক বাংলাদেশি তরুণ সাজ্জাদ ভাইয়ের সঙ্গে একবার আমি কোথাও যাচ্ছিলাম। তিনি তখনও তার বাবার দেয়া পুরনো মডেলের একটি গাড়ি ব্যবহার করতেন। সেদিন আমি তাতেই চড়ে সাজ্জাদের সঙ্গী হয়েছিলাম। রাস্তায় হঠাৎ দেখি, এক আরবীয় তরুণ আমাদের গাড়িটিকে লক্ষ্য করে সাজ্জাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে। ব্যাপারটি সাজ্জাদকে জানাতেই তিনি স্বাভাবিক ভাবে বললেন, বাদ দিন, ওদিকে তাকাবেন না। আমি দু পক্ষের এমন আচরণে অবাক হলাম এবং কৌতুহলী হয়ে বিষয়টি জানতে চাইলাম।
সংক্ষেপে সাজ্জাদ জানালেন, আমার ব্যবহৃত এ গাড়িটি আমার বাবার দেয়া। বাবাকে দিয়েছিলেন তার শেখ। গাড়িটির লাইসেন্স নাম্বার অনেক পুরনো বলে সবাই এটি কিনতে চায়। এ দৃশ্য তাই এখন অমাার গা সওয়া। কাতারি তরুণদের কাছে পুরনো লাইসেন্সনাম্বারের কদরই আলাদা। হালআমলে যেসব লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে সেগুলোতে আটটি সংখ্যা থাকে। তবে সাজ্জাদের ব্যবহৃত গাড়িটির লাইসেন্সনাম্বার ছিল চারসংখ্যার- ২৬৩৩। কাজেই এটি অনেক পুরনো বলেই এর চাহিদা খুব বেশি। সাজ্জাদ আমাকে জানিয়েছেন, তাদের গাড়ির নাম্বারটি নিয়ে তারা অসংখ্যবার এমন বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন। কিন্তু শেখ রাজি নন বলেই তারা বিক্রি করেননি। এ নাম্বারটির কেনার জন্য এক আরবীয় তরুণ দু লাখ পঞ্চাশ হাজার রিয়াল পর্যন্ত দিতে রাজি হয়েছিলেন, বাংলাদেশি মুদ্রামানে এর মূল্য পঞ্চাশ লাখ টাকারও বেশি।
চারসংখ্যার এমন পুরনো নাম্বার তো বটেই, পাঁচ কিংবা ছয়সংখ্যার সুন্দর নাম্বারগুলোরও এমন চাহিদা ও কেনা নিয়ে তুমুল প্রতিযোগিতা চলে কাতারের তরুণদের মধ্যে। শুধু কাতার নয়, আরবআমিরাত, বাহরাইন এবং সৌদিআরবসহ আশপাশের দেশগুলোতেও ধনকুবের তরুণরা এ ব্যাপারটিকে নিজেদের আভিজাত্য ও গৌরবের বিশ্বস্ত প্রতীক হিসেবে ভেবে থাকে। শুধু মনে রাখা সহজ, এ জন্য নয়, বরং তরুণদের বিশ্বাস, আর রাকামুল মুমাইয়াজ লিশাখছিল মুমাইয়াজ, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের জন্যই বিশেষ নাম্বার।
গাড়িতে ব্যবহৃত লাইসেন্স নাম্বারের পাশাপাশি আকর্ষণীয় ও গোছানো কিংবা সহজে মনে রাখা যায়- এমন মোবাইল নাম্বার নিয়েও পারস্পরিক বড়াইয়ের লড়াই চলে সর্বত্র। রাস্তায় এমন একটু ভিন্ন ধরণের নাম্বার সম্বলিত লাইসেন্সের গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার পর সবাই যখন কৌতুহলী দৃষ্টিতে এদিকে তাকাবে, এটাও এখন এখানে ব্যক্তিত্বের অংশ।
এই সংক্ষিপ্ত ভূমিকার পর চলুন দেখে আসি বিজ্ঞাপনবুলেটিন আলওয়াসিতের শেষ কয়েকটি পৃষ্ঠা থেকে কিছু নাম্বার ও মূল্যচিত্র। এ বিজ্ঞাপন বা নোটিশগুলোতে যে অঙ্কের মূল্য চাওয়া হয়েছে, তা দিয়ে অনায়াসে একটি নতুন গাড়ি কেনা যাবে। চারসংখ্যা দিয়ে তৈরি লাইসেন্স নাম্বারের মূল্য সবচেয়ে বেশি। এরপর পাঁচসংখ্যা এবং এরপর ছয়সংখ্যার বিশেষ নাম্বারগুলো।
যেমন, গাড়ির জন্য লাইসেন্স নাম্বার হিসেবে ১৩৯৮৮৮ নাম্বারটি বিক্রির বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে, এর মূল্য (৩৫,০০০) পয়ত্রিশ হাজার কাতারি রিয়াল বা বাংলাদেশি মুদ্রায় সাত লাখ পয়তাল্লিশ হাজার টাকা। একই মূল্যে বিক্রি করা হবে ১৮১১৮১ এবং আরও কিছু নাম্বার। ৬৫৬২৫ ক্রমিকনাম্বারটির বিক্রয়মূল্য চাওয়া হয়েছে পঁচিশ হাজার কাতারি রিয়াল বাংলাদেশি মুদ্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। সর্বনিম্ন মূল্য হিসেবে যে নাম্বারটি বিক্রির বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে তা ৪০৫৬০ এবং এর মূল্য তেইশ হাজার কাতারি রিয়াল, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় পাঁচ লাখ টাকা। চারঅঙ্কের ৯৭৭১ নাম্বারটির কোনো মূল্য দেয়া হয়নি, তবে লেখা আছে অতি উচ্চমূল্য এবং সামর্থবান হলেই কেবল যোগাযোগ কাম্য। কেউ কেউ আবার বিশেষ নাম্বার কেনার জন্য বিজ্ঞাপনও দিয়েছেন। যোগাযোগ করার জন্য নিজের মোবাইল নাম্বার জানিয়েছেন আগ্রহী ক্রেতাব্যক্তিরা।
কাতারে মোবাইলফোন সেবাদাতা কোম্পানি মাত্র দুটি। ‘উরিদু’ এবং ‘ভোডাফোন’। কাতারের মোবাইলনাম্বারগুলো আট সংখ্যার হয়ে থাকে। মোবাইল নাম্বারে বিশেষ নাম্বার হিসেবে ৭৭১৭৭৭৭১ নাম্বারটির মূল্য চাওয়া হয়েছে এক লাখ কাতারি রিয়াল, বাংলাদেশি মুদ্রামানে সাড়ে একুশ লাখ টাকা। এর চেয়েও বড় ব্যাপার হলো, নিজের মতো করে নাম্বার সাজিয়ে নিতে চাইলে দিতে হবে বিস্ময়কর অঙ্কের মূল্য। ভিআইপি হিসেবে বিক্রির জন্য প্রথম চারটি একইসংখ্যা এবং মাঝে এক বসিয়ে তারপরের বাকি তিনটি সংখ্যা একইরকম বসাতে চাইলে দিতে হবে তিন লাখ আশিহাজার রিয়াল। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর মূল্য (৮০,৯৪,০০০) আশি লাখ চুরানব্বই হাজার টাকা।
হাজারের অঙ্ক ছাড়িয়ে এ মূল্য কখনো মিলিয়ন ও বিলিয়নের ঘরও স্পর্শ করে। গত মাসের ১০ তারিখ (১০ই মার্চ,২০১৪) আরবআমিরাতের মোবাইলফোন সেবাদাতা কোম্পানি ‘ইতিসালাত’ একটি নাম্বার (০৫০৭৭৭৭৭৭৭) বিক্রি করেছে ৭.৮৭ মিলিয়ন দিরহাম মূল্যে। এসব বিশেষ নাম্বার কেনার জন্য তুমুল প্রতিযোগিতা হয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ প্রস্তাবকারীর কাছে এটি বিক্রি করা হয়। নিজের ইচ্ছেমতো বিশেষ নাম্বার সংগ্রহ ও অর্ডার দেয়ার জন্য আরব উপসাগরীয় অঞ্চলের মোবাইলফোন কোম্পানীগুলো আলাদাভাবে প্রচারণা ও সেবা দিয়ে থাকে।
আরব তরুণদের ব্লগ ও ফোরামের বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং ফেসবুকের বিভিন্ন পাতায় এ বিষয়টি সবসময় আলোচনা এবং জনপ্রিয়তার শীর্ষে। আর যে এমন কোনো বিশেষ নাম্বারের ক্রেতা ও অধিকারী হতে পেরেছে, তার গর্ব ও আনন্দ তখন কে দেখে! এ নিয়ে রীতিমতো উৎসবের আয়োজনও হয়ে থাকে।
তবে এর বিপরীতে কিছু প্রসংশনীয় উদ্যোগও রয়েছে। বিশেষ নাম্বার বিক্রির পর প্রাপ্ত অর্থ ফিলিস্তিন কিংবা কোনো দুর্গত অঞ্চলের অসহায় মানুষকে দান করে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে, তবে তা নিতান্তই হাতেগোনা পর্যায়ে। এমন দুয়েকটি ঘটনা বাদে পুরো বিষয়টি ভয়াবহ আকারে সংক্রমিত হচ্ছে তরুণদের মধ্যে, যা দিনদিন সম্মান ও সাফল্যের অংশ হয়ে উঠছে তাদের কাছে।
আরববিশ্বের ফতওয়াপ্রদান কেন্দ্রগুলোতে অনেক তরুণ ও অভিভাবক এ বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। এখানকার আলেম ও মুফতিদের কেউই কোনোভাবে বিষয়টিকে জায়েজ বা বৈধ বলে ফতওয়া দেননি। বরং এর পুরোটাই অপচয় এবং অপব্যয়, সেটি মনে করিয়ে দিয়ে সচেতনতামূলক পুস্তিকা ও বিবৃতিও তারা প্রকাশ করেছেন।
কাতারে বেশ কয়েকটি দৈনিক থেখে মাত্র একটি দৈনিক আশশারক। প্রতি সপ্তাহে এর দুটি বিজ্ঞাপনবুলেটিন থেকে মাত্র একটি বুলেটিনের কিছু বিজ্ঞাপন ও মূল্য তুলে ধরা হলো। সবমিলিয়ে এ লেখায় পুরো বিষয়টির আগাগোড়া চিত্রও তুলে ধরা সম্ভব নয়। আরববিশ্বে ক্রমবর্ধমান বাহুল্য অপচয় ও আভিজাত্যের বিকৃত অর্থের এমন দৃশ্য নিশ্চয়ই কারো কাম্য নয়।

২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৩২

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে[

স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, মব-রাজনীতি ও এক ভয়ংকর নীরবতার ইতিহাস
চরম স্বৈরশাসন বা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রেও সাধারণত সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ে আগুন দেওয়ার সাহস কেউ করে না। কারণ ক্ষমতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

=হিংসা যে পুষো মনে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৮


হাদী হাদী করে সবাই- ভালোবাসে হাদীরে,
হিংসায় পুড়ো - কোন গাধা গাধিরে,
জ্বলে পুড়ে ছাই হও, বল হাদী কেডা রে,
হাদী ছিল যোদ্ধা, সাহসী বেডা রে।

কত কও বদনাম, হাদী নাকি জঙ্গি,
ভেংচিয়ে রাগ মুখে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণমাধ্যম আক্রমণ: হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিলেন নূরুল কবীর ও নাহিদ ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:০৫


জুলাই গণঅভ্যুত্থানের রক্তস্নাত পথ পেরিয়ে আমরা যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম, সাম্প্রতিক মব ভায়োলেন্স এবং গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণ সেই স্বপ্নকে এক গভীর সংকটের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। নিউ এজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপিকেই নির্ধারণ করতে হবে তারা কোন পথে হাটবে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:০৫




অতি সাম্প্রতিক সময়ে তারেক রহমানের বক্তব্য ও বিএনপির অন্যান্য নেতাদের বক্তব্যের মধ্যে ইদানীং আওয়ামীসুরের অনুরণন পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিএনপি এখন জামাতের মধ্যে ৭১ এর অপকর্ম খুঁজে পাচ্ছে! বিএনপি যখন জোট... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় আগ্রাসনবিরোধী বিপ্লবীর মৃত্যু নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৩৭



শরিফ ওসমান হাদি। তার হাদির অবশ্য মৃত্যুভয় ছিল না। তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, আলোচনা ও সাক্ষাৎকারে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি অনেকবার তার অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা বলেছেন। আওয়ামী ফ্যাসিবাদ ও ভারতবিরোধী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×