গত কয়েকদিন ধরে পত্রিকার পাতা উল্টালেই একটি খবর চোখে পড়ছে, সেটি মানুষের মৃত্যুর খবর। মানুষের মৃত্যুর খবর বাংলাদেশে খুব স্বাভাবিক, কিন্তু গত কদিনে ঝড়ে মৃত্যুর পাশাপাশি র্যাব আর পুলিশের গুলিতে মানুষের মৃত্যু চোখে কাটার মত বিধছে। আজও র্যাবের গুলিতে মারা গেল তিনজন তরুন। রাত সাড়েবারটায় র্যাব গুলি করে হত্যা করেছে দুই যুবককে যাদের বয়স বাইশ থেকে পচিশ বলে উল্লেখ করেছে র্যাব কতৃপক্ষ নিজেই।
গত বিএনপি সরকারের আমলে সন্ত্রাস মাত্রাতিরিক্ত বাড়ার ফলে সেনাবাহিনী নামিয়ে অপারেশন ক্লিন হার্ট পরিচালনার পরে সন্ত্রাসকে পাকাপাকি নিয়ন্ত্রনের লক্ষ্যে র্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ান গঠন করা হয় যা কালক্রমে ক্রসফায়ার এক্সপার্ট বাহিনী হিসেবেই বেশী হাইলাইটেড হয়েছে। র্যাবের ক্রসফায়ারে কেউ মারা পড়লে পত্রিকায় বলা র্যাবের ভাস্য নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন থাকলেও ক্রসফায়ার জনসাধারনের কাছে মোটামোটি জনপ্রিয় ছিল এতে অনেক ভয়ংকর সন্ত্রাসীর সমাপ্তি ঘটেছে বলে। একটা সময়ে প্রায় প্রতিদিন একটা দুটা ক্রসফায়ার করেছে র্যাব, মাঝে মাঝে পুলিশ ও। তখন বিতর্কও উঠেছে। বিচারবর্হিভুত এমন হত্যাকান্ড কি আদতে সমর্থনযোগ্য?
বর্তমান বিশ্বে যেখানে মৃত্যুদন্ডকেই বর্বর শাস্তি হিসেবে গন্য করা হয়, সেখানে বিচার ছাড়াই একটা মানুষ ধরে গুলি করে মেরে ফেলা মধ্যযুগীয় বর্বরতা ছাড়া আসলে আর কিছূই নয়। কিন্তু তারপরেও জনগনের একটা বিপুল অংশ একে সমর্থনের চোখে দেখে এসছেন। ক্রসফায়ারে মাঝে মাঝেই যে নিরপরাধ কেউ নিহত হচ্ছে না তেমনও না, খুব কম হলেও একটা দুটা অভিযোগ এসেছে। যেটা সবচেয়ে বেশী এসেছে সেটি হল লঘুপাপে গুরু দন্ড দান। এমন অনেকেই ক্রসফায়ারে পড়েছে যাদের অপরাধের দন্ড কোনমতেই মৃত্যু নয়।
সবচেয়ে যেটি বড় কথা, বিচার বর্হিভুত এইসব হত্যকান্ডে আমাদের আসলে জানার উপায় নেই যে মৃত লোকটির দোষ আসলে কি ছিল, তার মৃত্যুর পর তার পাশে রিভলবার রেখে তাকে পুরনো কটা কেসে রাতে রাতে ঢুকিয়ে দিলে পরদিনের পত্রিকায় মানুষ মৃত লোকটি নিরীহ হলেও তাকে বড় সন্ত্রাসীই ভাববে। এমনটি হয়ত ঘটে না বা খূব কম ঘটে , কিন্তু ক্রসফায়ারকে বৈধতা দিয়ে আমরা সেই কাজটিই করে যাচ্ছি।
রাজনৈতিক ভাবে ক্রসফায়ারকে ব্যবহার করলে এরচেয়ে বড় নির্মম অস্ত্র আর হয় না। বিএনপি আমলে এমন অনেক অভিযোগ আছে যে ক্রসফায়ারে সন্ত্রাসীর মৃত্যুর ফলে ওই সন্ত্রাসীর কাছ থেকে তার গডফাদারের অপরাধ সম্পর্কে তথ্য পাবার সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে গেল। এমন অভিযোগ ছিল যে বড় অপরাধ আড়াল করে দেবার জন্যে অনেককে হত্যা করা হয়েছে, বা রাজনৈতিক ভাবেও ব্যবহার করা হয়েছে।
নিউইয়র্কভিত্তিক প্রভাবশালী মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ১৮ মে বাংলাদেশ বিষয়ক এক প্রতিবেদনে র্যাব ও ডিজিএফআই'র বিচার-বহির্ভূত হত্যা ও অন্যান্য কার্যক্রমের তীব্র নিন্দা করে সংস্থা দুটি ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দেয়। সংস্থাটি 'অন্ততপক্ষে' তাদের কার্যক্রম তদারকের জন্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের পরামর্শ দেয়।
প্রতিবেদনে গত ৫ বছরে অন্তত এক হাজার বিচার-বহির্ভূত হত্যার সঙ্গে র্যাব ও পুলিশ জড়িত ছিল বলে উল্লেখ করা হয়।
একহাজারেরও বেশী মানুষকে হত্যা হয়েছে, তাদের সবাই কি আসলে সেরকম ছিল যে তারা সমাজে বসবাসের জন্য বিপদজনক?
আজকে রাতে যে দুজন মারা গেল, তাদের ক্ষেত্রে অস্ত্র উদ্ধারে যাবার ব্যাপার ছিল না। আসাদগেটের সামনে রাতে র্যাব চেকপোষ্ট বসিয়ে ছিল। রাত সাড়ে বারটার দিকে চেকপোষ্টের পাস দিয়ে দুই তরুন হেটে যাওয়াতে র্যাবের সন্দেহ হলে তাদের থামতে বলে, তাতে তারা গুলি চালাতে র্যাবও পাল্টা গুলি ছুড়ে দুজনকে হত্যা করে। এখনও র্যাব তাদের পরিচয় জানে না।
এরা সন্ত্রাসী ছিল কিনা, নাকি শুধুই দুজন নিরীহ নাগরিক ছিল তা আমরা জানি না, সহজে জানতেও পারব বলে মনে হয় না। আর জানতে পারলেই কি হবে? তাদের শীর্ষসন্ত্রাসী হিসেবে চিন্হিত করা হয় নি, এরেষ্ট করা হয় নি, এরেষ্ট করার পরে স্বীকারুক্তি অনুযায়ী অস্ত্র উদ্ধারে যাওয়া হয় নি, আর তাদের সঙ্গীরা র্যাবের উপর গুলিও চালায় নি। তারা রাস্তা দিয়ে হেটে যাবার সময় র্যাব থামতে বললে তারা গুলি চালিয়েছে। একই কাহিনী। তাদের মৃত্যুর পর তাদের লাশের পাশে ২ টি রিভলবার পরে থাকতে দেখা গেছে। রিভলবার রোপন করা র্যাবের পক্ষে কোন কঠিন কাজ নয়। সবকটি ক্রসফায়ারের পরেই লাশের পাশে রিভলবার পড়ে থাকতে দেখা যায়।
একই দিন সকালে মহাখালীতে একজন র্যাবের গুলিতে মারা গেল, র্যাব ইনফরমেশন পেয়েছিল খুব ভোরে দুই দল সন্ত্রাসীগ্রুপ মহাখালী এলাকায় বন্দুকযুদ্ধ করছে, সেখানে র্যাব উপস্থিত হয়ে গুলি চালালে একজনের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। সেখানেও রিভলবার।
এভাবে বিচারবর্হিভুত হত্যাকান্ডকে সমর্থন করার যৌক্তিক কোন কারন খুজে পাচ্ছি না। র্যাবের এমন হত্যাকান্ডের কোন কৈফিয়ত বা তদারকীর কোন ব্যবস্থা আছে বলেও চোখে পড়ে নি। তাতে করে আসলে সাধারন নাগরিক হিসেবে শংকিত হই। অস্ত্রহাতে ভয়ংকর সন্ত্রাসী আর অস্ত্রহাতে মানুষ মারার লাইসেন্সধারী বৈধ লোককে আলাদা করে কিছূ মনে হয় না।