১. সাবিনা বসার ঘরে অপেক্ষায় আছে। আক্ষরিক অর্থেই সে কান পেতে আছে কখন কলিংবেলটা বেঁজে উঠবে, রফিক বাসায় ফিরবে। তার সময় কাটছেনা, অপেক্ষার মুহুর্তগুলো অসহ্য মনে হচ্ছে। বাসায় কেউ নেই, সে, এমনকি রফিকও জানে এরচেয়ে ভালো সুযোগ আর আসবেনা।
২. - সাবিনা, সাবিনা! কোথায় গেলি?
- চাচা আসছি, এক মিনিট।
- গ্রাম থেকে ফোন এসেছে বাবা খুব অসুস্থ্য। আমি আর তোর চাচী ফরিদপুর যাচ্ছি। রহিমার মা সেই যে গেলো আর এলোনা। এদিকটা তুই-ই দেখিস।
হ্যা, সাবিনা এ বাড়ির প্রায় সবকিছুই দেখে। আদিল চাচা তার আপন কেউ নয়, দূর সম্পর্কের চাচা। ঢাকায় নার্সিং পড়তে এসে সে তাদের বাসায় উঠেছিল। তারপর নার্সিং কোর্স শেষ হয়েছে, সে নার্স হিসেবে যোগও দিয়েছে একটা হাসপাতালে। বাবা-মা না থাকায় সম্ভবত বিয়ের আগে তার আর এই ঠিকানা বদলের কোন সম্ভবনা নেই। এমন নয় যে সে এখানে একদম "ফাও" থাকছে। বাসার টুকটাক থেকে শুরু করে প্রায় সব কাজই সে নিজে করে। ছুটা বুয়া রহিমার মা শুধু একবেলা আসে, দূপুরে। তাই ঘর কন্যার বেশিরভাগ কাজ সাবিনাকেই করতে হয়।
৩. এইডস রোগের নাম সাবিনা অনেক শুনেছে, বইয়ে পড়েছে। গ্রামে তাদের বাড়িতে টিভি ছিল ভাইয়ের ঘরে। ভাবীর সাথে তার সম্পর্ক ছিল বেশ খারাপ, ভালোমাত্রায় খারাপ। তাই বাড়ির ১৪ ইন্চি নতুন কেনা রঙীন টেলিভিশনটা তার দেখার সুযোগ হত কালেভদ্রে। কিন্তু ঢাকায় আসার পর সিনেমা, টিভির অ্যাড মিলিয়ে "এইডস" কি জিনিস সে জেনেছে ভালোমতই। নার্সিং কোর্স করতে গিয়ে এই জানার পরিধি আরো বেড়েছে, সরাসরি এইডস রোগীর দেখভালও করতে হয়েছে। এইতো মাস ছয়েক আগে এইচআইভি পজিটিভ এক ভদ্রমহিলা তাদের হাসপাতালেই মারা গেলেন।
৪. সাবিনা যখন প্রথম ঢাকায় আসে তখন তার জন্য মনে হয়েছিল এটা একটা আশির্বাদ। ভাই আর ভাইয়ের বউ তার উপর শারীরিক অত্যাচার করতো এমন নয়, কিন্তু তারা আপনও ছিলনা। আদিল চাচা আর চাচী তাকে কখনো কষ্ট দেননি, ছোট নজরে দেখেছেন এমনও নয়। তারা তাকে ভালোবাসেন - এটা বলাও ভুল হবেনা। আরো একজন তাকে ভালোবেসেছিল ঢাকায়; রফিক। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া আধুনিক ছেলে। প্রথমে তাদের ভেতর দূরত্ব ছিল। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পরে দূরত্ব কমে আসে। বছর ঘুরতেই তাদের দুরত্ব কমে আসার মাত্রা ভয়ঙকরভাবে বেড়ে যায়। তখন রফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে। তারা দুজনেই কাছে আসার, হ্যা, ভালোবাসার অনেক সময় ও সুযোগ পেয়েছে। রফিক তাকে ভালোবাসতো!
৫. রফিকের পড়া শেষ হলো। চাকুরী পেতেও খুব একটা বেগ পেতে হলোনা। সাবিনা তখন স্বপ্ন বুঁনছে, সংসারের। একদিন হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে কি মনে করে সাবিনা গিয়েছে চাচীর ঘরের দিকে। রফিক চাচীর সাথে কথা বলছে। সে ঘরে ঢুকবে ভাবছে এমন সময় থমকে দাঁড়ালো।
- হ্যা, মা তোমরা যখন চাইছো বিয়ে করবো, আপত্তি থাকবে কেন?
- তোর কোন পছন্দ টছন্দ আছে কিনা! তোর বাবা বলছিলো...
সাবিনার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো তখন। ওখান থেকে চলে আসতে পা সরছিলোনা। এভাবে লুকিয়ে কারো কথা শোনা ঠিক না। তবু এ তো অন্য কারো কথা। এ তো তারই ভবিষ্যতের কথা!
- না, মা আমার কোন পছন্দ নেই। তোমরা মেয়ে দ্যাখো...
সাবিনার পৃথিবী কেঁপে উঠলো। না, সে ভুল শুনেছে। এ হতে পারেনা। না!!
৬. সেদিন চাচা-চাচী গেছেন মার্কেটে। বাসার বাজার সপ্তাহে একবার নিজের হাতে করতে পছন্দ করেন আদিল চাচা। গাড়ি নিয়ে চলে যান দুজনে মোহাম্মদপুর মার্কেটে।
- রফিক...
- হুম!
- চাচীকে আমাদের কথা বললেনা কেন?
সাবিনার চোখে জল, গলা কেঁপে উঠে। রফিক পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে সাবিনার দিকে, জড়িয়ে ধরে আলতো করে। শরীরে চাপ বাড়ে সাবিনার। সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চায়। কিন্তু...
রফিক হাপাচ্ছে, তার সারা শরীরে ঘাম। সে কাপড় গোছাতে গোছাতে বলে-
- খবরদার কাউকে বলবেনা। আর বললে তোমারই অপমান। তুমি কি ভেবেছো মা বাবা তোমাকে মেনে নেবে?
- না নিক। তুমি বলতে পারতে।
- আমরা একজন আরেকজনকে শুধু কিছু ভালোসময় দিয়েছি। এতে দোষ কোথায়। চাইলে সামনের দিনেও তো তোমাকে আমি পাবোই।
চোখ মুছতে মুছতে শরীরের কাঁপুনী থামাতে চায় সাবিনা। তার সারা শরীর ঘৃণায় রী রী করে উঠছে। সে অপবিত্র। রফিক বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে।
৭. - আপনার সাথে কেউ এসেছেন?
- না!
- প্লিজ একটু শান্ত হয়ে বসুন। পজিটিভ। ইউ আর সারটেনলি এইচআইভি পজিটিভ। কিভাবে হলো বলতে পারেন?
না, ডাক্তারকে সাবিনা কিছুই বলেনি। তার নাম ঠিকানা সে সবই ভুল দিয়েছিল। এইচআইভিতে মারা যাওয়া সেই রোগি আর তার শরীর থেকে নেয়া এক সিরিন্জ রক্তের কথা ডাক্তারকে বলার কোন মানে নেই।
৮. সাবিনা অপেক্ষা করছে রফিকের জন্য। তার মুখে এক টুকরো হাসি...