চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের খুনি জামি ধরা পড়েছে! জামিকে এখন পিটিয়ে ছাল তুলে দেয়া দরকার। হাড্ডিখুড্ডি ভেঙ্গে একাকার করে দেয়া দরকার। পারলে ঘাঁড় মটকে দেয়া দরকার। এই খুনিকে খুন করে একটা ‘দৃষ্টান্ত’ স্থাপন করা দরকার। তাহলেই জামিরের মতো খুনিদের শিক্ষা হবে। এরা বড়ই মূর্খ। বদের হাড্ডি। উশৃঙ্খল। এদের মতো ছোট-লোকেরাই যত সমস্যার গোড়া। এদের কারণে কোথায় নিরাপদ নই। না রাস্তা-ঘাটে, না বাসে-ট্রাকে, না ঘরে বাড়িতে।
তাই, দে, সবাই মিলে জামিকে বলি দে।
জামি হচ্ছে গাড়ির চালক। ড্রাইভার। এই ঘাতক জামি'রের চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স বাসের সাথেই সংঘর্ষে তারেক মাসুদের গাড়ি দুমড়ে মুচড়ে যায়। এই জামি'রের কারণেই তারেক মাসুদের মতো 'গুণী'জন আর আমাদের মাঝে নাই। র্দূঘটনা ঘটার ঘটনা যাই হোক না কেন, জামি'কে শূলে চড়ানো হোক। জামি'কে কোরবানী দেয়া হোক।
জামিকে পাকড়াও করা হয়েছে আজ(সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, নিচে লিংক দেয়া আছে)। শালা হারামজাদাটা পালিয়ে গিয়ে বোনের বাড়িতে উঠেছিল। আমাদের সাহসী সৈনিকেরা তাকে বোনের বাড়ির ইঁদুরের গর্ত থেকে তুলে এনেছে। এবার যাবে কোথায়? সোনার চাঁন পিতিলা ঘুঘু। কত বড় বুকের পাঠা ধরার পর আবার যুক্তি খাটায়, "যে কোনো দুর্ঘটনার পর সাধারণ মানুষ মারমুখী থাকে। এজন্যই পালিয়ে গিয়েছিলাম।" চোরের বাচ্ছা চোর তোর পালানো ছুটাই দেব আজকে। আমরা বুঝি-না মনে করেছিস না? -যে চোর সেই তো পালায়। জামিকে এখন পিটাবো হবে(৩ দিনের রিমাণ্ডে নেবে), কোপানো হবে, একটা দৃষ্টান্ত বানানো হবে। তাতে তোর পরিবার, বাল-বাচ্ছা, বউ-ঝিয়েরা জাহান্নামে যাক, না খেয়ে মরুক- আমাদের কি। (মধ্যবিত্ত গোস্বা করেছে, তোর বলি দিয়ে ওদের শান্ত করতে হবে)
কিন্তু, ঠিক কবে থেকে আমরা ঘটনা গুলোকে অন্যভাবে পাঠ করবো?
বিশ বছর ধরে গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা জামি’রের। বাংলাদেশের মতো দূর্ঘটনা ওৎ পেতে থাকে এমন রাস্তাঘাটে যে বিশ বছর গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞাতা রাখে সে তো ওস্তাদ লোক। ২০ হাজার লোককে সে গাড়ি চালানো শেখাতে সক্ষম। অথচ...
অথচ, সব ঐ ড্রাইভারে দোষ। আরে মিয়া ভাই(রাষ্ট্র/সরকার) তুমি রাস্তা আয়তন বাড়াবা না, মহা সড়ক গুলো ঠিকঠাক করবা না, রাস্তায় খানাখন্দ ঠিক করবা না, প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ টা নতুন গাড়ি রাস্তায় নামানোর অনুমতি দিবা, রাস্তায় জ্যাম বাঁধাই রাখবা, আবার দ্রুত গন্তব্যে পৌছানোর জন্য মালিকরা তাদের তাগাদা দেবে, গালাগালি করবে, হাগা-মুতারও টাইম দিবা না, ড্রাইভারদের মানসিক ভাবে অস্থির করে রাখবা, ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তা আটকাইয়া রাখবা এবং কাজে কাজেই ওভার টেক করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত করাবা - আবার সাধু সেজে বলবা, ড্রাইভাররাই খারাপ, এরা সচেতন না, এরা ট্রাফিক আইন মেনে চলে না। অতএব, যায় কৈ, এদের ধরে ধরে মার। পিটাই লাশ বানাও। দৃষ্টান্ত স্থাপন কর।
দেশ চালানোর আস্ত কাঠামোটাই যেখানে স্বার্থবাজি, খুনোথুনি, মারামরি, প্রতিযোগিতা মুখি, বিশৃঙ্খল, কে কার আগে বড় লোক হতে পারে, কে কার আগে গন্তব্যে পৌছাতে পারে - সেখানে একটা ড্রাইভারের কাছে কেন সচেতনাতা আশা কর, কেন শৃঙ্খলা আশা কর? সে কি ফেরেস্তা? সেও গরিব, বড় লোক হইতে তারও ইচ্ছা করে। তোমার আস্ত পচা গলা, দোজখের মতো দেশে সেও আগে আগে ফুলসেরাত পার হইবার তাড়না বোধ করে।
নিজেরাই যেখানে সচেতন ভাবে দেশটাকে অ-সচেতন থাকতে নিরবিচ্ছিন্ন ভাওতাবাজি করে যাচ্ছ, লুটপাটের সৃংস্কৃতি জারি রেখেছ- সেখানে জামিদের মতো ও দিন আনি দিন খাইয়ে লোকেদের একাই সব দোষ, তাই না? কোটি কোটি টাকা খচরা করে আড়িয়াল বিল নষ্ট করে, মানুষজনকে বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করে বিদেশী প্রভুদের দরকারে বিমানবন্দর করার জন্য লাঠিয়াল/বন্দুক বাহিনী পাঠাবা, অথচ হাইওয়েগুলো যে মৃত্যুফাঁদ হয়ে আছে তা ঠিক করার কোন যোগ্যতাই দেখাইতে পারবা না, ২ লেনের একটা রাস্তা করার হেডম নাই যাদের, ইচ্ছা নাই যাদের তাদের মুখে পাতালট্রেনের গল্পের বান্দ্রামিই শোভা পায়। (তোড়া বেঁধে গালিগালাজ হবে এখানে)।
তা শেষ পর্যন্ত যা হবার তাই হবে।
মেরুদণ্ডহীন মধ্যবিত্ত এসব প্রশ্ন তুলবে না। তারা সরকারের দোষ ধরলে ছিদ্রন্বেশন মনে করে। তারা রাষ্ট্রের গোড়া চিনতে ইচ্ছুক নয়, তা সমূলে উপড়াতে আগ্রহ নেই। শুধু বেড়ালের মতো মিউ মিউ করে ক্ষোভ প্রকাশ করে। (সংগঠিত হবে না, বিচ্ছিন্ন থাকবে, বিচ্ছিন্ন থেকে কথার প্যাককাঁদা ছিঁটাবে, মিছিলের স্রোতে ভাসবে না, স্লোগানের দিতে দিতে প্রতিরোধ গড়বে না। যদি তাই পারতো তবে 'তারেক ও মিশুক' কে যেই দিন শহীদ মিনারের বেদীতে রাখে অই দিনই যুদ্ধ লাগতো। ঢাকা তাহরীর স্কয়ার হয়ে যেত, লণ্ডনের মতো আগুন ধরতো চারপাশে।) মধ্যবিত্ত ঠিকই ঘুমাতেও যায়, হাগা মুতাও চালু রাখে। নাকি কোষ্টকাঠিন্য হয়ে গেছে, কে জানে? সব কিছুতে ধৈর্য্য ধরতে ধরতে মানসিক ভাবে যে বিকারগ্রস্থ হয়ে গেছে সে দিকে খেয়াল নেই। আর মাঝে মাঝে দুই একটা ইঁদুর ধরতে পারলেই খুশি। চোর বলে ডাকাত বলে কাউরো খুন হতে দেখলেই তারা নিশ্চিয়তা ও নিরাপত্তা বোধ করে। আহা, এই বুঝি সরকার সব ঠিক করে ফেললো। (তার উপর, সরকার গুলো আমাদের দেশের প্রগতিশীল/বুদ্ধিজীবী/সংস্কৃতি কর্মী/কবি/লেখকদের কাছে 'আফিম' বিশেষ। খোদা/আল্লাহতালা/ভগবান বা মুষ্কিল আছানকারী বলে গণ্য হয়। এ আফিমের ঘোর কবে কাটবে?)
অথচ, দেশ চাকালের সিটে কে বসে আছে, সে কেমন ভাবে কোন গতিতে কোন নিয়মে দেশ চালাচ্ছে তা না দেখে জামিদেরকেই দোষি করে আমরা খুশি থাকবো। যেন জামিদের দু'ঘা লাগাতে পারলেই হলো। তারেক মাসুদের মৃত্যুর বদলা নেয়া হয়ে যাবে। আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়ে যাবে।
আর এই বেকুব মধ্যবিত্তের সীমাবদ্ধতা, মন-মানসিকতা বুঝে সরকারও ভালোই ভালোই টের পেয়েছে দু'একটা গাড়ির চালককে ধরে পিটাইতে পারলেই সব আবার অনেক-অনেক-অনেক দিনের জন্য ঠাণ্ডা হয়ে পড়বে। এই সুযোগ আমরাই দেই, সব সময়। এই 'আমরা' মধ্যবিত্ত।
অতএব, এই মুহূর্তেই চালকদের গ্রেফতারের কর, পিটানোর সব খররাখবর পেপার পত্রিকায় ছাপাই দে। দেখুক, জনগণ দেখুক, আমারা কত্ত ভালো। দায়িত্বশীল। সড়ক দুর্ঘটনার বিরোদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। কঠোর হস্তে সব দমন করছি। (পেপার পত্রিকার ভাষায় যা ‘দৃষ্টান্ত’ স্থাপন করা, এটা লুতুপুত প্রগতিশীলদেরই ভাষাই। বৃহৎ কোন দৃষ্টান্ত স্থাপনে যাদের ইচ্ছে নেই। আবার, সরকার আশ্রিত মিডিয়া গুলো 'ঘাতক ট্রাক' গ্রেফতার, 'ঘাতক চালক' গ্রেফতার ইত্যাদি বিশেষণ যোগ করে সরকারের দোষ চালকদের ঘাড়েগর্দানে চাপাতে মরিয়া।)
আর এভাবেই মধ্যবিত্ত ভুলে যাবে 'মূলে' কে দোষি। ক্ষোভ, প্রতিবাদের অগ্নিলভা গুলো প্রতিরোধের দিকে গড়াবে না।
আহা, চমৎকার, 'ধরা যাক দু'একটি ইঁদুর এবার'।
_________________________________________________
* তারেক মাসুদের মতো দু'একজন 'অসাধারণ' মরলেই আমারা হাউমাউ কাউ করি। অথচ, প্রতি দিন বহু 'সাধারণ' মরছে তাতে আমাদের কিচ্ছু যা আসে না। বড়ই ভোঁতা আমরা। সমকালীন এই ঘটনাকে কেন্দ্র্র করে আরো একটি লেখা, পড়ুন: সাধারণের মৃত্যু ও অসাধারণের মৃত্যু বা মৃত্যু নিয়ে যখন মশকারা করতে ইচ্ছা করে- যিশু মহমমদ
_________________________________________________
মধ্যবিত্তের মনোযোগ আর্কষণ ও গা বাচাতে সরকার কেমন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। স্রেফ বিডি নিউজের খবরের শিরানম গুলো দেখুন।
ধমক শুনে সড়কে যোগাযোগমন্ত্রী । 'যোগাযোগমন্ত্রী না বুঝে বলেছেন' । সড়ক সংস্কার ঈদের আগেই: মন্ত্রী । ঈদের আগেই সড়ক সংস্কারের নির্দেশ । চালক জামির তিন দিনের রিমান্ডে । সড়ক বিভাগে ঈদসহ সব ছুটি বাতিল । সড়ক উন্নয়নের ফিরিস্তি চেয়েছে হাইকোর্ট
সব দোষ তো চালকদের। অথচ, রাস্তা সংস্কার করার জন্য চালকরাও প্রতিবাদ করেছে, মন্ত্রীর আশ্বাসে(?) এখন প্রতিবাদ তুলে নিয়েছে। দেখুন বিডি নিউজ- সাত দিন পর বাস চলাচল শুরু।
এই লেখাটি যখন উন্মোচনে...দেখুন
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০১১ বিকাল ৪:১৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




