শক্তির নিত্যতা সূত্রের দিকে চোখ রেখে যদি শুরু করি, দেখবো, এর জন্ম নেই, মৃতু্য নেই, আছে শুধু রূপান্তর। অস্ত্র একে কাটতে পারে না, জল একে ভেজাতে পারে না, রোদ একে শুকাতে পারে না ... এ এক দারুণ হ্যাপার জিনিস। গীতায় ছিঁচকাঁদুনে অজর্ুনকে যেন শক্তির কথা শুনিয়েই ভুলিয়েছেন শ্রীকৃষ্ণ। আমাদের কাজকারবারের আত্মাই যেন শক্তি।
একেবারে বিসমিল্লাতেই শক্তির রূপান্তর নিয়ে ব্যস্ত মানুষ। পূর্ব আফ্রিকার হোমিনিডদের দিয়ে যদি শুরু করি, আমরা দেখবো, রূপান্তরের জন্য বেচারাদের একমাত্র ভরসা ছিলো কাঁচা খাবার [আগুন আবিষ্কার করে উঠতে পারেনি বেচারারা]। পাওয়ার হাউজ তখন ছিলো পাকস্থলী। দৈনিক মাথাপিছু শক্তি ভোগের পরিমাণ, বিশেষজ্ঞদের হিসাবমতে, প্রায় 2000 কিলোক্যালরি।
সময়ের সাথে হোমিনিডরা বিবর্তিত হয়, শারীরিক বিবর্তন আর সাংস্কৃতিক বিবর্তন হাত ধরাধরি করে চলে, বুনো হোমিনিড থেকে আমাদের চোখ পড়ে শিকারী-টোকারী হোমোস্যাপিয়েন্স এর ওপর। প্রায় একলাখ বছর আগে ইয়োরোপ আর লেভান্ট অঞ্চলের শিকারী-টোকারী মানুষের গোষ্ঠী [নিয়ান্ডাটর্াল] এই মাথাপিছু দৈনিক শক্তি খরচের গড় পরিমাণ প্রায় আড়াই গুণ বাড়িয়ে তোলে। এই বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম কারণ, আগুনের ব্যবহার। কাঁচা খাবারকে বেশ পাকিয়ে তোলা ছাড়াও এই দলবদ্ধ গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে নিচুস্তরের বিনিময়ও শুরু হয়, শুধু আহারের পেছনেই যাবতীয় শক্তিক্ষয়ের বুনো হোমিনিডপনার একটা অবসান ঘটায় তারা।
প্রায় 5,000 বছর আগে যখন কৃষিজীবী মানুষের আদিস্তর শুরু হয়, তখন শক্ষিভোগের হার বাড়ে প্রায় আরো আড়াইগুণ। এবার মানুষ যে শুধু আগুনকেই বশ করেছে, তা-ই নয়, তার নিয়ন্ত্রণে এসেছে ভারবাহী পশু। ষাঁড়, ঘোড়া, গাধা, হাতি, এরা ঘাসলতাপাতা চিবিয়ে যা কিছু শক্তি আয় করতো, তা ব্যয় হয় মানুষের কাজে। ভারবাহী পশুর শক্তি কৃষি ও আদিম শিল্পের অন্যতম প্রাইমমুভার হয়ে দাঁড়ায়।
খ্রিষ্টপূর্ব 1400 সাল থেকে চৌকস কৃষিজীবী মানুষ মাথা তুলে দাঁড়ায় উত্তর-পশ্চিম ইয়োরোপে। সময়ের সাথে কৃষিপণ্য হয়ে দাঁড়ায় বিনিময়ের প্রধান বস্তু, আর কৃষিসফল অঞ্চলের মধ্যে এই বিনিময় বৃদ্ধি পায় ভারবাহী পশুটানা পরিবহনের মধ্য দিয়ে। মানুষ তখন জীবাশ্মজ্বালানি ব্যবহারের প্রথম ধাপ হিসেবে অল্পস্বল্প কয়লাও পোড়াতে শুরু করেছে শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্যে, নদীতে চাকা আর বায়ুকল বসিয়ে শুরু করেছে নবায়নযোগ্য শক্তির প্রথম ব্যবহার। কৃষি আর শিল্পে শক্তির ব্যবহার তখন বেড়ে গেছে অনেক।
1875 সাল নাগাদ এই শক্তির ব্যবহার ত্রিগুণিত হয় বাষ্পীয় এঞ্জিনের আবিষ্কারের পর। শক্তিভোগের ঢিমেতালা মৃদুমন্দ বৃদ্ধির পালে যেন জোর হাওয়া বইয়ে দেন জেমস ওয়াট। মানুষের হাতে তখন কয়লা, গ্যাস আর তেলও চলে এসেছে, পৃথিবীতে সঞ্চিত বিপুল জীবাশ্মজ্বালানির ট্যাঁকে আগুন ধরিয়ে দিয়ে সে পানিকে বাষ্পে রূপ দিয়ে ঘুরিয়ে চলছে শিল্পবিপ্লবের চাকা। শিল্পচৌকস মানুষ আর প্রাকৃতিক শক্তিস্রোতের পরোয়া করে না তখন।
1970 এ এসে প্রথম বিশ্বের প্রযুক্তিচৌকস মানুষ গালিভারের মতো পেছনে তাকায় লিলিপুট হোমিনিডদের দিকে। তার মাথাপিছু দৈনিক গড় শক্তিভোগ তখন 230,000 কিলোক্যালরি [হোমিনিডদের তুলনায় প্রায় 115 গুণ]। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই শক্তির 26% আসে তড়িৎশক্তি হিসেবে [এর মাঝে কেবল 10% সে কাজে লাগাতে পারে, বাকি 16% নষ্ট হয় উৎপাদন, সঞ্চালন আর বিতরণে]।
তথ্যসূত্র: E. Cook, "The Flow of Energy in an Industrial Society" Scientific American, 1971 p. 135.

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


