জীপে চড়ে আমাদের ভ্রমন শেষ হয়ে যাবে এখানেই। বাস গিয়ে আমাদের স্টেশনে নামাবে এর পর আমরা ট্রেনে চেপে কোলকাতা, অনেক লম্বা একটা ভ্রমন আবারও। সেই একই গল্প, সেই একই রকম গতিশীল কারাবাস, একই রকম এলুমুনিয়াম ফয়েলে ঢাকা খাওয়া, একই রকম জানালা দিয়ে ভারত দেখতে দেখতে যাওয়া। তবে মনে সামান্য ফুর্তির ভাব এসেছে, ঘরে ফেরার আনন্দ বলা যায় একে।
বাসে ব্যাগ উঠানো হচ্ছে, এত এত ব্যাগ, আমাদের প্রয়োজনের শেষ নেই, ছোটো ছোটো অলংকার থেকে শুরু করে তৈজস পর্যন্ত যা যা কেনা ও বহন করা সম্ভব আমরা কিনেছি। আইভির ব্যাগ ছিলো এক তলা, এখন ওটা সম্পুর্ন সটান, তিন তলা ব্যাগ হয়ে গেছে, তানভীর কিছু কিনে নি, শমিক শেষ মুহূর্তে কয়েক রোল ফিল্ম কিনেছে, ওর মূল কেনার জিনিষ হলো গাড়ী, হট হুইলজ কিনতে হবে ওকে, ওর ছোটো ভাইয়ের জন্য, আশফাক কিনেছে সুমির জন্য শাড়ী, বোনের জন্য শাড়ী, হাতঘড়ি, লিটু ভাই তেমন কিছু কিনে নি। আর বাকিদের কেনার পরিমান দেখে আমি ঘাবড়ে গেছি বলতে হয়। আমরা এই ভ্রমনে শুধু বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে রাত কাটাই নি, সব বাজার থেকেই কিছু না কিছু কিনেছি।
মিষ্টির স্বাদটুকু লেগে থাকলো জিভে, এর পর যদি কোনো দিন আসা হয় তাহলে রাজস্থানের মিষ্টি খেতে হবে, কোলকাতার সন্দেশ, রসগোল্লা অপূর্ব জিনিষ, তবে এখানের সন্দেশও কম যায় না, কোলকাতার সন্দেশের ছানাধিক্য, সাদা সাদা কিংবা বাদামি পাকা সন্দেশের উপর সাজানো পোস্তা বাদামের সাথে এখানের মিষ্টির তুলনা চলে না, এটা অনেকটা হালুয়ার মতো মিষ্টি, যদিও ময়রার ঘরে জন্মাই নি তবে খেয়ে আলাদা করতে পারি।
পেছনে পড়ে থাকলো নির্ঘুম অনেকগুলো রাত। মানালী যাওয়ার রাস্তায় সারা রাত ঘুম হয় নি, ফেরার পথে বেচারা একা সারারাত না ঘুমিয়ে গাড়ী চালিয়েছে, এবং সেই গাড়ী চালিয়েছি পরদিন রাত পর্যন্ত। শেষের দিকে ঝড়ের বেগে গাড়ী চলেছে, একবার দেখলাম গাড়ীর স্পিডোমিটারে 140 কিমি/ঘন্টা।কুয়াশা এড়িয়ে, এমন দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছে, হয়তো জীবিকার টানে এমনটা করাই নিয়ম। তবে জীপের আনন্দ মাটি হয়েছে সামান্য হলেও মেয়েদের আগমনে। স্বতঃস্ফুর্ততা কমে গিয়েছিলো। অনায়াসে বলে ফেলা যেতো অনেক কথাই সেসব কথা মেয়েদের সামনে যতই সহজ হোক সম্পর্ক বলা হয় না।
স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে বাস চলে যাবে, চলে যাবে চৌহান। বেচারা স্টেশনে আসার পর বেশ কিছুক্ষন থম ধরে বসে থাকলো। আমাদের বিয়ের দাওয়াত দিলো, আগামি অক্টোবরে ওর বিয়েতে যেনো আমরা সবাই আসি। বিদায় নেওয়ার সময়গুলো আবেগপ্রবন, এই সামান্য জীপযাত্রার সুবাদে যতটুকু ঘনিষ্ঠতা, এর বদৌলতে চৌহানের চোখের পানি পাওয়া যাবে এমনটা ধারনা ছিলো না। ছলছল চোখে আমাদের সবাইকে আলিঙ্গন করে অন্য দিকে তাকিয়ে চোখ মুছা চৌহানের জন্য হঠাৎ করে মায়া জন্মালো। আমরা সবাই কথা দিলাম, অবশ্য আমরা বিদায় মুহূর্তে অনেককে অনেক প্রতিশ্রুতি দেই, বিশ্বাস করেই দেই, আশা রাখি আমরা প্রতিশ্রুতি রাখতে পারবো। আগামি বছর আবার আমরা আগ্রা আসবো, সরাসরি গোলডেন ট্রাভেলস এ যোগাযোগ করবো, দেখা হবে চৌহান।
লিটু ভাই বিব্রত, স্টুপিডটা কান্দে ক্যানো। আমরা বিব্রত সামান্য, আমাদের কথা আমরা রাখি নি, এর পরে আর যাওয়া হয় নি আগ্রা, চৌহানের বিয়ার দাওয়াত, তার কার্ড সবই ছিলো সাথে, সেই সাথে চৌহানের কথা, তুম লোগ কহতে হো মাগার আয়োগি নেহী।
আমরা জোড় দিয়ে বলি না আমরা আসবো, দেখো নিও আমরা আসবোই, এ শুধু কথার ফানুস না, দেখা হবে বন্ধু।
স্টেশনের অবস্থা থমথমে, সবাই এসে দাঁড়িয়ে আছে, ট্রেন আসবে, আমাদের বগির নাম্বার অনুযায়ী আমরা ব্যাগ সাজিয়ে বসে আছি, শমিক মাথায় পাগড়ী বেঁধে আছে শুধু, আমাদের সাধের সব পাগড়ী মানে আমাদের বন্ধু এবং বান্ধবীদের কেনা সব শাড়ী ও ওড়না আবার ব্যাগে চালান হয়ে গেছে।ওটা ফেরত পাওয়ার সম্ভবনা নেই। এক সাথে 47 জন মানুষ থাকলে যেমন হয়, সবার নানা রকম বাহানা চাহিদা, এখানের স্টেশনও বাংলাদেশের মতোই, চায়ের দোকান, সস্তা বিস্কুট পাওয়া যায়, সেসব কিনে খাচ্ছি, ক্ষুধার্ত না হলেও আসলে কিছুই করার নেই তাই কিছু একটা করা। ট্রেন আসবে কখন জানি না, অবশেষে ব্যাগ সরিয়ে সেখানেই তাসের আড্ডা বসালাম। স্পেডট্রাম্প খেলবো,29 খেলাটা আমাকে টানে না, আমার বাসায়ও কখনও এ খেলার ব্যাপারে কোনো উৎসাহ ছিলো না, এইটা গামছাবান্ধা খেলা, ট্রাকের ড্রাইভাররা খেলে, কোনো ভাবনা চিন্তার বিষয় নেই, আসলে কোনো আভিজাত্য নেই টুয়েন্টি নাইন খেলার, আমরা ঘরে বসে অনেক খেলাই খেলেছি, তাসের খেলায় আগ্রহ কম নেই, এখানেও বসে পড়লাম, স্পেডট্রাম্প অনেক ভাবেই খেলে, আমি অন্তত 3টা ধাঁচ দেখলাম, এখন যেভাবে খেলছে তাতে প্রথম হাত কেউ কোনো কল দিবে না, যে যা পাবে সেটা থাকবে তার একাউন্টে। এর পর যে সবচেয়ে পেশী পিট পাবে তাকে দিয়ে খেলা শুরু হবে, আরও একটা নিয়ম হলো প্রতি কল আমরা হিসাব করি 1, 2 করে এখানে করছে 10 ,20, 30, কেউ 3 পিট কল করলে তার ওখানে লেখা হচ্ছে 30, যদি কেউ বেশী পিট তুলে তাহলে সেই বাড়তিটা যোগ হবে 30এর সাথে।এসব হিসাবের কোনো সুবিধা হয়তো আছে। তবে আমার কাছে খেলা খেলাই, লিখতে হচ্ছে না, লিখতে হলে গেঞ্জাম বাঁধিয়ে ফেলতাম।
একেজনের ন্যাকামির দেখে বিরক্ত হলেও করার কিছু নেই, প্রায় মরে গেলাম মরে গেলাম ভাব নিয়ে পাশাপাশি আছে স্বর্ণা আর আইভি, অবশ্য খেদমতগার পেলে সবাই একটু এমন এলিয়ে পড়া ভাব নেয়, ঘোড়া দেখলে খোঁড়া হওয়ার স্বভাব আসলে স্বাভাবিক। সঞ্জয় একটু দুরে দাঁড়িয়ে সোনিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে,দেখতেই পারে, একজন ছেলে একজন মেয়েকে পছন্দ করবে তার সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করবে এমনটাই রীতি। গা টিপাটিপিও চলছে, দেখ দেখ কিভাবে তাকিয়ে আছে- আসলে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া তোরাতো কদর বুঝলি না, দেখ আমাকেও ভালোবেসে লোকজন দেখে।
ট্রেন থামবে কতক্ষন জানি না, চলতি ট্রেন, যেটুকু সময় থামবে সেইটুকু সময়ের ভেতরেই লটবহর সব উঠিয়ে ফেলতে হবে। অবশ্য মাশাল্লা জিনিষ কম নেই, বাড়তি ব্যাগ কেনা হয়েছে, সেসব ব্যাগও টইটুম্বুর, মানুষের চেয়ে ব্যাগের ওজন বেশী। যদি ঘাড়ে করে কোলকাতা হেঁটে যেতে হতো তাহলে আমরাই সবচেয়ে সুখী ব্যাক্তি হতাম। আমার ব্যাগে তেমন কিছুই নেই, সুনীলের কবিতা সংগ্রহ আর শক্তির কবিতা সংগ্রহ।সব মিলিয়ে 5টা বই, অনেক ভাব নিয়ে এনেছিলাম, পড়া হয়েছে একদিন মাত্র, এইসব ঝুটঝামেলা মিটমাট করতে গিয়ে আমার কবি ক্যারিয়ারে 12টা বেজে গেলো।
ট্রেন আসার খবর পেয়ে আমরা তাস খেলা থামিয়ে রণে জন্য প্রস্তুত হলাম। যদিও মেয়েদের এই ভারী ব্যাগ নিয়ে আমার 101টা আপত্তি আছে এর পরও আজকে সবার হয়ে কুলির কাজ করতে হবে, ললাট লিখন,ঝটপট হাত লাগিয়ে তুলেও ফেললাম সব ব্যাগ, ট্রেনেও চড়ে গেলাম ঠিকঠাক মতো, এখানে সুবিধা একটাই মাটির ভান্ডে চা দেয়, ঐ চায়ে মাটির গন্ধ লেগে থাকে, চমৎকার ব্যাবস্থা, চা খেয়ে কাপ ফেরত দেওয়ার ঝামেলা নেই, ছুড়ে ফেলো।
ট্রেনে ছাড়ার পর সবাই সাবর সীট খুঁজে বসেও পড়লাম। এবার আরও বিদিকিচ্ছিরি ব্যাবস্থা, পাশাপাশি নেই, একএকটা বার্থ পাওয়া গেছে, একসাথে 8টা, এক সাথে 6টা, এভাবে 2 বগি জুড়ে ছড়িয়ে আছে আমাদের আসন।
আমাদের হলবাসী ভাইয়েরা চমৎকার উপভোগ করেছে এখন বোঝা যাচ্ছে, ট্রেন টিহক মতো ছাড়ার সাথে সাথেই তারা তাস নিয়ে বসে পড়লো, দিব্যি তাস চলছে,হলের ছেলেরা তাস খেলার উস্তাদ মনে হয়, আমরা নিজেরা নিজস্ব গ্রুপে বসে আড্ডা দিচ্ছি, আড্ডা হচ্ছে বিভিন্ন লেভেলে। একের উপরে এক এভাবে 3টা ঘুমানোর জায়গা আছে, মাঝেপ্যাসেজ, প্যাসেজের ও পাশে একটার উপরে আরেকটা েইভাবে 2টা শোবার জায়গা। এরকম করে 8টা বাস্ক আছেম আর আছে টয়লেটের সামনে 2টা করে 4টা শোবার ব্যাবস্থা, 68 সীট। আমাদের কপাল মন্দ, এবার একজনের সীট পড়েছে সেই টয়লেটের সামনে। সারাদিন বসে বসে দেখতে হবে কে কয়বার টয়লেট গেলো।
অবশ্য রাতের সামান্য সময় ছাড়া কে বা ঐখানে গিয়ে থাকবে, রাতের খাবার দিয়ে গেছে,ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঝাপিয়ে পড়লাম, চেটে পুটে খেলাম, তারপর সুযোগ বুঝে ছুড়ে ফেলো। ডিসপোজেবল ব্যাবস্থা। সিগারেট নিয়ে মৃদু আপত্তি করছে কেউ কেউ, এসব আপত্তি আমলে আনলে আধুনিক হওয়া যাবে না। মানুষের সুখের জীবনে ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য উৎসাহি এমন স্বাস্থ্যপ্রিয় মানুষের কমতি নেই, দিনরাত ট্রাফিকের ধোঁয়ায় নাক ডুবিয়ে পড়ে থাকবে অথচ একটা সিগারেট ধরাও 1 কোটি বিধি শোনাবে, ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, প্যাসিভ স্মোকিংএ ক্যান্সারের সম্ভবনা আছে, ইতং,বিতং কারে বলে, এইসব পরিসংখ্যান দিয়া কিছু হয় না, প্যাসিভ স্মোকিং এ মরে যাওয়া মানুষের সংখ্যা যতটা এর চেয়ে বেশী ঝুঁকি রাস্তায় চলাফেরা করার, তাই বলে লোকজন রাস্তায় চলাফেরা থামিয়ে দিয়েছে, যতসব আউলফাউল। ঐ শালাদের আমলে আনলে জীবন বরবাদ। একটু চেপে চুপে সিগারেট চলছে।
এক পাশে মজমা জমেছে, পাশের লোকের চোখ এড়িয়ে মদ চলছে, এখানে এখনও প্রকাশ্যে মদপান নিষিদ্ধ, বড়ই আজব দেশ, মদ বেচা বৈধ্য, সবাই মদ কিনতে পারে কিন্তু মদ খেতে হবে লুকিয়ে, ঘরের চিপায় বসে মদ খেতে হবে, তবে সবাই সহনশীল, কেউ কারো নামে অভিযোগ করে না।
পরদিন সকালের আড্ডা দিয়ে এলাকা দেখতে বের হলাম, কে ক্যামোন আছে, সারারাত ঠান্ডার কষ্ট নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই, তবে এবার একজনের কাছে একটা শাল ধার নিয়েছিলাম, কষ্ট হলেও ঠিক সেই মাত্রার কষ্ট হয় নি।
গিয়ে দেখি এলাহী কারবার, তমাল আর আইভি জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে। না তেমন বিশ্রি, অশ্ল ীল ভঙ্গিতে না এর পরও সবার সামনে এভাবে জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকাটা ক্যামোন যেনো।তার পাশে স্বর্ণা রুবেলের ঘাড়ে মাথা দিয়ে বসে আছে, প্রেমিককুঞ্জ ছেড়ে সামনে গেলাম, আমাদের স্যারেরাও এইভাবেই বসে আছে, ওখানে বসে মানুষের বিরক্তইর কারন হতে চাই না। সামনে আগাও, এইসব ট্রেনে চড়লে একটার পর একটা বগি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাও সামনে, উঠতি বয়েসের ছেলেরা যা করে এমন সব কাজই চলছে,
শমিক এসে খবর দিলো সামনের এক কম্পার্টমেন্ট আগ্গুন সুন্দরি আছে একজন, হেভী সেক্সী, অতএব আমরা সবাই সেই কম্পার্টমেন্ট অভিমূখে যাত্রা করলাম, মাঝে একজন জিজ্ঞাসা করলো কই যাস, বললানভেভী সেক্সি একটা মাইয়ার খোঁজ পাওয়া গেছে চল গিয়া দেইখা আসি। এইভাবে এক জন 2 জন করে বেশ বড় একটা দল তৈরি হলো। সাথে মেয়েরাও। যদিও আমাদের ক্ষীন আপত্তি ছিলো মেয়েরা সেক্সি মেয়ে দেখে কি করবে ওরাতো এখনও সমকামী হয়ে যায় নি, তবে ওদের সোজা জবাব ট্রেনে আনাচা কানাচে কোথাও সেক্সি কোনো ছেলে পাওয়া যায় কি না এই খোঁজ করবে। শালার কপাল এই কয়েক দিনের টানা ভ্রমনে আমাদের সেক্স আপীল একেবারে মাটিতে মিলিয়ে গেলো।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০০৬ রাত ১:৪৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



