উৎসুক চোখের সামনে দিয়েই বিচ্ছিন্ন হলাম, তানভীরে খর চোখ, অন্যান্যদের প্রশ্নবোধক দৃষ্টির সামনে দিয়েই হেঁটে শমিককে ফিরিয়ে দিলাম ট্রাইপড, এর পর খেতে গেলাম। আয়েশ করে সিগারেট টানতে টানতে পরবর্তি দিনের প্রস্তুতি।
চাঁদের দেখা পাওয়া গেছে কি না তাও জানি না, সামনে ঈদ, কোনো রকম ঝুঁকি না নিয়েই আগামি কাল বাংলাদেশ রওনা দেওয়া হবে। সকাল বেলাই উঠে যেতে হবে বর্ডারে। ঘুমাতে হবে তাড়াতাড়ি, মনটা উৎফুল্ল ভীষন রকম, ঘুম আসছে না। যে যার মতো মটকা মেরে পরে থাকার পর সকাল আসলো। বাসে চেপে যেতে হবে বেনাপোল। ইচ্ছা করছিলো যুঁথির পাশে বসতে তবে সেই ইচ্ছাকে খুন করতে হলো। এই এক রাত ছাড়া অন্য কোনো ঘনিষ্ঠতা উচিত হবে না। যুঁথির নিজস্ব প্রেমিক আছে, এর উপরে আমাদের তানভীর ওকে পছন্দ করে, সব মিলিয়ে আমার সামাজিক মন একটা সীমা টানতে চায়। সীমাবদ্ধ থাকাটাই সামাজিকতা।
আমরা বেনাপোলে পৌঁছানোর পর সেখানের বি এস এফ আর বি ডি আরের আনন্দের পরিমান নিশ্চিত ভাবেই বেড়ে যাবে। আমরা মোটামুটি 1000 জনের মার্কেটিং করে এসেছি, একেক জনের ব্যাগের আকৃতি সম্পুর্ন বদলে গেছে। প্রথমে বি এস এফকে জনপ্রতি 50 রুপি দিয়ে শান্ত করা হলো। সেখান থেকে নো ম্যানস ল্যান্ডের পুরোটা পথ এই জগদ্দল পাহাড় বয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমার ব্যাগ নিছক আবর্জনার মতো এই ব্যাগগুলোর পাশে।
আমাদের সবার উপকার করতে হবে টাই বিভিন্ন জনের কুলির কাজ করছি, ভ্যানে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো ব্যাগ। সামনের এক প্রাইমারি স্কুলের চত্ত্বরে রাখা হলো, আমরাও সেখানে গিয়া বসলাম। আমরা বাংলাদেশে, আর কোনো শালাই কিছু বলতে পারবে না, এইটা আমাদের দেশ, আমার দেশ, আমার সম্রাজ্য, মাথা উঁচু করে ঘুরবো, কোনো শালা একটু উলটাপালটা বললে ফর্দাফাই করে ফেলবো। এই স্বদেশের স্বাধীনতা বোঝার জন্য একটু ভিন্ন দেশে কাটানো দরকার।
তমাল আর ট্রাভেল এজেন্সির লোকজন বিগ্রেডিয়ার সাহেবের সাথে লেনদেন চুকানোর কাজে ব্যাস্ত। তিনি গড় হিসাবে বলেছেন 300 টাকা মাথা প্রতি। তবে এটা সম্ভব না, এই দরকষাকষির মাঝেই আমাদের উৎসব চলছে, ভারতে থাকার ফলে রোজা উপলক্ষে কোনো বিধিনিষেধ মানি নি, এখানেও সেই একই অবস্থা, সকালের নাস্তা করছি সদলবলে, লোকজন বেশ বিরক্ত চোখে তাকাচ্ছে। তবে আমাদের কিছু যায় আসে না, আমরা বাংলাদেশে।
ছবি তোলা হচ্ছে, বিভিন্ন ভাবে ছবি তোলা শেষে আর কিছু করার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, অবশেষে রফা হলো 7000 টাকায়। সেই টাকা দিয়ে আমাদের ভ্রমনের সর্বশেষ পর্ব সমাপ্ত। এবার ঢাকা যাওয়ার পালা।
স্যারেরা হিসাব করছে, আজকে যদি চাঁদ দেখা যায় তাহলে আগামি কাল ঈদ, ঈদের দিন সবাই বাসায় যাবে এমনটাই রীতি, তাই সবাই ঢাকা ফেরত যাবে না। অনেকের বাসাই দক্ষিন বঙ্গ, উত্তর বঙ্গ, তারা আলাদা ভাবে যাবে। ঢাকা শহরের আশেপাশে অনেকের বাসা, যশোরে যাদের বাসা তারা যশোরে নেমে যাবে। এভাবে পথে নামিয়ে দিতে দিতে যাবে বাস তবে উত্তর বঙ্গ যাদের বাসা তারা ঢাকা থেকে কিভাবে বাসায় ফিরে যাবে।
অবশেষে সিদ্ধান্ত হয় ওদের আলাদা মাইক্রোবাস ভাড়া করে দেওয়া হবে, সেই মাইক্রোবাস নিয়ে তারা রওনা দিবে বাড়ীর পথে। অন্যরা ঢাকায় ফিরে যাবে। সেই মতো মাইক্রোবাস ভাড়া হলো। সবার বাসায় নামিয়ে দিবে এই হিসাবে আমরা সবার কাছে বিদায় নিয়ে মাইক্রোবাসে চড়লাম, দেখা হবে বন্ধুরা ঈদের পরে। বাংলাদেশে নামার পর আর ভয় লাগে না কোনোই।
মাইক্রোবাস রওনা দিলো, ঝিনাইদহ হয়ে যাবে, সেখানে একজনের বাসা, সেই মতো ঝিনাইদহে একজন নামলো, এর পর কুষ্টিয়া, কুষ্টিয়া যাওয়ার পথে বাংলাদেশ দেখছি। আসলে এই দিকটাতে কখনই আসা হয় নি। সুন্দর ডিস্ট্রিক বোর্ডের রাস্তা। বাংলাদেশের সবুজ একটু অন্যরকম, তেমন কনকনে ঠান্ডে নেই এখন। হাসি ঠাট্টা করতে করতে আগাচ্ছি, তবে আমার সাথে সম্পর্ক এখনও সহজ হয় নি। প্রয়োজন কি? তারা তাদের মতো থাকুক, আমিও আমার মতো থাকি।
পদ্মা দেখলাম, দেখলাম হার্ডিং ব্র ীজ, এই একটা ব্র ীজের কথা শুনছি অনেক দিন তবে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেখা হয় নি, ইশ্বরদি আসা হয় নি, এখানে ফারাককার অভিশাপ নিয়ে পদ্মার প্রমত্ততা মৃত। পদ্মার পাশে এসে মাইক্রোবাস অপেক্ষা করছে, ফেরি আসলে ওপারে যাবে, অর্ধেক নদী জুড়ে সাদা বালির সমুদ্্র। ওর একটু দুরে সামান্য পানি, আধা ঘন্টা লাগে এ পার থেকে ওপারে যেতে আবার ফিরে আসতে। পানির অবস্থা এতটা খারাপ যদি মাইক্রোবাস একটু হিসাব করে চলে তাহলে কোনো রকম ফেরী ছাড়াই ওপারে চলে যেতে পারতো, তবে তেমনটা করার কোনো ইচ্ছা নেই ওদের।
অবশেষে ফেরী আসলো এপাশে, ফেরীতে চড়লাম, ক্ষুধায় কাতর, ফেরির মুড়ি মাখা খেলাম আয়েশ করে, যতক্ষন লেগেছিলো ফেরিতে উঠতে তার চেয়ে কম সময়ে ওপারে পৌঁছে গেলাম। আবারও রাস্তায়। এভাবেই চলছে মাইক্রো, বগুড়ায় নামলো মুকুল, এর পর রংপুর বগুড়ার মাঝে নামলো একজন, সমস্ত মাইক্রোবাসে আমি একা। বেশ আয়েশ করে বসে আছি, ড্রাইভার জানালো আর যাবে না, ওর সাথে চুক্তি হয়েছে এ পর্যন্তই যাবে। এরপর সে ফিরে যাবে। বললাম এমনতো কথা ছিলো না, আমাদের বাসায় পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিলো তোমার বন্ধু। মনোযোগ দিয়ে শুনলো, শুনে বললো যাবো না কেনো যাবো বন্ধু তবে 1500 টাকা লাগবে।
আমি শুকনো মুখে তাকালাম ওর দিকে, বিকাল হয়ে গেছে, শেষ ইফতারির বাজার চড়া,অনেক মানুষে গিজগিজ করছে রাস্তা, সবাই আড়চোখে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে, চাঁদ দেখা যাওয়ার কথা। কিছুক্ষন হিসাব করে ঠিক করলাম বগুড়া ফিরবো, তাই মাইক্রোবাস ফেরার পথে বগুড়ায় নেমে গেলাম। আশা একটা বাস পেয়েই যাবো বগুড়া থেকে সরাসরি বাস যায় দিনাজপুর।
বগুড়া বাসস্টান্ডের পাশেরমসজিদের সামনে বসে আছি। অবশ্য একটা হোটেলে, সবাই ইফতারি শুরু করার পর বেশ আয়েশ করে খেলাম, ভালোই লাগলো। সামনে একটা বাস হাঁক ডাক দিচ্ছে, এই ছেড়ে দিলো দিলো বলে, তড়িঘড়ি টিকেট কাটলাম, বাসে চড়লাম, এর পর শুরু হলো অপেক্ষা, বাস আর ছাড়ে না। বিষম ফাঁদে পড়ে আছি। টিকিটের পয়সা ফেরত দেয় না, বলে ইচ্ছা না হইলে নাইমা যান গিয়া, আপনেরে কে আটকায়া রাখছে, মেজাজ খারাপ হলেও বাসস্ট্যান্ডের সামনে বাস শ্রমিকদের সাথে কোনো রকম গা জোয়ারি বুদ্ধিমানের কাজ না, বরং স্বাস্থ্যহানীর সমুহ সম্ভবনা।
অবশেষে 8টায় বাস ছাড়লো। বাস চললো কিছুক্ষন আবার থামলো এক জায়গায়, আরও কিছু যাত্রি উঠালো। সবাই যেভাবে পারছে জায়গা করে নিচ্ছে, গরমে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার অবস্থা, জানালার উপর পা দিয়ে ঝুপঝাপ উঠে যাচ্ছে ছাদে। কন্ডাকটর তরতর করে উঠে যাচ্ছে ছাদে, ভাড়া নিয়ে নামছে নীচে।
তবে বেশীর ভা লোকাল যাত্রি, মিঠাপুকুর যাওয়ার পর মোটামুটি সবাই নেমে গেলো। বাস আর কিছু দুর এগিয়ে খান্তি দিলো, আর যাবে না। সবাই কে নেমে যেতে হবে, হাতে 20টাকা ধরিয়ে দেওয়া হলো। রাত 9টা 30এ আবার বাসের জন্য অপেক্ষা, একটা বাসে কোনো মটে ঝুলে গেলাম রংপুর। রংপুরে খালেকের কাউন্টার আছে, হানিফের কাউন্টার আছে, তবে টিকেট নাই কোনো। রংপুর বাসস্ট্যান্ডে গেলাম, গেলাম মডার্ন মোড়ে, মেডিক্যালের সামনে কিছুক্ষন হাত পা ছুড়লাম, ওখানে বাস থামেই থামে, কিছুই হলো না, এদিকে খবর এসেছে কাল ঈদ, ঈদের উপলক্ষে মানুষের উৎসাহ হয়েছে 2 গুন।
অবশেষে রংপুর টার্মিনাল থেকে একটা বাস পেলাম যাবে সৈয়দপুর। পরের ভাবনা পরে ভাবা যাবে আগে সৈয়দপুর পৌঁছাই। তবে ঈদের দিন শেষ ট্রিপ শেষ ট্রিপ বলে বাসটা আরও 1 ঘন্টা থেমে থাকলো, অন্য কোনো উপায় নেই, অন্ধের শেষ অবলম্বন এখন এটা। সেটা করেই পৌঁছালাম সৈয়দপুর রাত 1 টায়। মাথায় হিসাব চলছে, বাসায় ফোন করবো এত রাতে, ফোন করে কি বলবো, মামাকে বলবো মোটর সাইকেল করে নিয়ে যেতে, নাকি মাইক্রো নিয়েই চলে যাবো শালার, ভয়ও লাগছে , মাইক্রো কত নিবে জানি না, 500 হলে একটা চলনসই হিসাব কিন্তু যদি 1000-1200 চায় তাহলে খুন করে ফেলবে আম্মা। মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞাসিলাম এক মাইক্রোওয়ালাকে, আমার দিকে তাকয়ে সুন্দর করে হাসলো হেসে বললো 1000, আমিও হাসলাম, হেসে বললাম দেখেন ভাই আপনের মাইক্রোটে সীট 10টা, যদি এইখান থেকে 10 সীট ভাড়া করে যাই বাসের লাগবে 400 টাকা, আপনের মাইক্রো ধরলাম আরও 100 বেশী নিবেন কিন্তু 1000। সে বললো হিসাবতো ঠিকই আছে যাওয়ার 500 কিন্তু ঐখান থেকে তো খালি ফিরতে হবে, ঐটার ভাড়া কে দিবে।
আমিও হিসাব শুনে হাসি মুখে অপেক্ষা করতে শুরু করলাম। শালার বাস একটা আসবে রাত 3টায়, অন্য নাইট কোচ গুলো আসবে আরও পরে। মোটামুটি নাইট কোচ পৌঁছানোর সময় হইলো 4টয়া, এই 2 ঘন্টা কি করে কাটাবো। সৈয়দপুর ভালো শহর, তবে রাত 2টায় এমন কোনো আকর্ষন নেই এখানে, এর পরও চাঁনরাত বলে সরগরম। জাকিরুল হক রোডে মানুষের ভীড়। পাশের রাস্তা ফাঁকা, সেখান কিছুক্ষন হাঁটলাম, কিছুক্ষন বসে থাকলাম এক হোটেলে।চা-সিগারেট চলছে, তবে সময় আর কাটে না কোনো মতেই। এখানে যতগুলো পরিচিত বাসের কাউন্টার আছে সবগুলোতে একবার করে হেঁটে যাওয়া হয়েছে। একজন বললো অন্য একটা টার্মিনাল আছে, ওখানে বাস পাওয়া যেতে পারে। রিকশা নিয়ে সেই বিশ্বরোডের ওখানে চলে গেলাম, তবেঅভাগা যেদিকে চায় সাগর ফুরায়, আবারও ফিরলাম জাকিরুল হক রোডে।
অবশেষে 3টায় একটা বাস আসলো, ভীড় কমে নি, সৈয়দপুরে নামলো 4 জন, তবে আমি উঠার পর জায়গা হলো সেই ইঞ্জিন কভারে। সেখানে বসতে গুনতে হলো 50 টাকা, তাই সই, শালার এর পরও সময় মতো পৌঁছালে হয়।
অবশেষে ইঞ্জিন কভারে বসে সিদ্ধ হতে হতে কালিতলায় নামলাম যখন তখন 4টা 30। রিকশা নিয়ে ফেরার পথে দেখি মামা মসজিদের পথে রওনা দিয়েছে। তাকে দেখে থামলাম, কিছুক্ষন কথা বলে রিকশাকে বললাম চলো নিউ হোটেল।
আমার অনেক প্রিয় আকটা আড্ডার জায়গা, এখানে 2টাকার ঘন দুধের চা এককালে আমার প্রিয় ছিলো সেই সাথে 1 টাকার সমুচা। এই হোটেলে বসে আমি আমি একটা সময় সন্ধ্যা থেকে রাত করেছি। সেখানে আবার এই ভোর বেলা আসার অভিজ্ঞতাই অন্য রকম। এই শহর আমি আমার হাতের তালুর মতো চিনি, কোন রাস্তায় কোন গর্তটা কি রকম এটাও আমার জানা। এখানে এসে আর কিছুতেই আনন্দ কমছে না, বরং শনৈ শনৈ বাড়ছেই আনন্দ। মামু চা লাগাও একটা সিগারেট নিয়ে আসো মামু।
কি খবর এত দিন পর,ক্যামোন আছেন, এই পরিচিত সম্বোধনটাই বাকি ছিলো, আপাতত আয়েশ করে চা সিগারেট শেষ করি, আলো একটু ফুটলে বাসায় যাবো।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



