যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে আরো কিছু কথা
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
প্রশ্ন উঠেছে, আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই, নাকি আগে পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস-দ্রব্যমূল্য-টেন্ডারবাজী-দুর্নীতি প্রভৃতি সমস্যার সমাধান চাই? কেউ বলছে, আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়ে যাক! দেশের সামনে এটাই এখন সবচেয়ে বড় জাতীয় ইস্যু। আর জনজীবনের দুর্যোগের ব্যাপারটা তো সেভাবে কোনো বড় জাতীয় ইস্যু নয়। এসব সমস্যা সমাধান করাটা গুরুত্বপূর্ণ বটে, কিন্তু সেটা তো প্রধানত কতগুলো অর্থনৈতিক-সামাজিক সমস্যার বিষয়। এগুলো তো তেমন কোনো গুরুতর জাতীয় রাজনৈতিক ব্যাপার নয়। আগে জাতীয় রাজনীতি ঠিক করতে হবে। তাহলে পারা যাবে ক্রমান্বয়ে অন্য সব সমস্যা সমাধান করা। দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা নিয়ে তাই পরে ভাবলেও চলবে। তাছাড়া, দেশ থেকে স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী নির্মূল হলে তখন জনগণের দুঃখ-কষ্ট লাঘবের জন্য কাজ করার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা আর থাকবে না। সেসব সমস্যা তখন ক্রমান্বয়ে সমাধান করা যাবে। ‘ভিশন টুয়েন্টি-টুয়েন্টি ওয়ানে’ তো সেসব লক্ষ্যের কথা সুন্দর করে লিখেই রাখা হয়েছে।
অন্যদিকে, আরেক তরফ থেকে বলার চেষ্টা হচ্ছে যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যু তো একটি অতীতের ইস্যু। এটা একটা নিছক আবেগের ইস্যু। এই ইস্যুতে তো পেট ভরবে না। দৈনন্দিন জীবনের ক্রমবর্ধমান বাস্তব সঙ্কটগুলো থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যেই সরকার এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয় নিয়ে মাতামাতি শুরু করেছে। আগে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাগুলো দূর হোক। সরকার আগে বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি-যানজট প্রভৃতি সমস্যা সমাধান করুক। তারপরে যুদ্ধাপরাধীদের ইস্যু নিয়ে কিছু করার থাকলে করা যাবে।
যারা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত ও স্বাধীনতার বিরোধীতাকারী শক্তি তারা তাদের অপরাধের বিচারের প্রক্রিয়া বন্ধ করার জন্য জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় যুক্তির পেছনে আশ্রয় ও আড়াল নিচ্ছে। ’৭১-এ গণহত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের সংগঠকরা এখন সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে মায়াকান্না জুড়ে দিয়েছে।
১৯৭০-এ ইয়াহিয়া খানের অধীনে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের ঠিক আগেও এই ধরনেরই একটি তর্ক উঠেছিল। প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, ভোট আগে না ভাত আগে? একদল বলতো যে, আগে ভোট দরকার। ভোট হলে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। একবার বাঙালির নিজস্ব সরকার গঠন করতে পারলে এবং পূর্ব বাংলার উপর পাঞ্জাবের জাতিগত শোষণ-বৈষম্য দূর করতে পারলে, বাঙালির ভাতের সমস্যা আর থাকবে না। কারণ বাংলার সম্পদ তখন তো আর বিদেশে পাচার হওয়ার সুযোগ থাকবে না। ফলে বাঙালির ভাত-কাপড়ের সমস্যা সমাধানের পথে কোনো বাধা আর থাকবে না, সব সমস্যা সহজেই দূর হয়ে যাবে। তারা শ্লোগান দিয়ে বলতো, ‘ভাতের আগে ভোট চাই’।
অন্যদিকে, অতি বিপ্লবী মহলের একাংশের পক্ষ থেকে পাল্টা শ্লোগান তোলা হয়েছিল- ‘ভোটের আগে ভাত চাই’। এই শ্লোগানকে ভিত্তি করে তারা বেশ জোরদার ক্যাম্পেইনও শুরু করেছিল। আওয়াজ তুলেছিল- ‘ভোটের বাক্সে লাথি মার, শ্রেণী সংগ্রাম-গড়ে তোলো’। সে সময়েও গণতন্ত্র ও বাঙালির স্বাধিকারের দাবির বিরোধিতাকারী শক্তি এই অতি বিপ্লবী শ্লোগানের আড়াল নিয়ে ষড়যন্ত্রের নানা চাল চালতে প্রয়াসী হয়েছিল।
১৯৭০ সালের প্রেক্ষাপটে, ভোট আর ভাতের মধ্যে যে তর্ক সৃষ্টি করা হয়েছিল সেক্ষেত্রে সঠিক জবাবটি অবলম্বন করে আমরা পাল্টা শ্লোগান তুলেছিলাম- ‘ভোট চাই-ভাত চাই, বাঁচার মতো বাঁচতে চাই’। আমরা বলেছিলাম, কোন্টার আগে কোন্টা চাই,- প্রশ্নটাই ভুল। এভাবে প্রশ্ন করার অর্থ দাঁড়ায়, ভোট আর ভাত- এ দু’টি বিষয় হল পরস্পরের প্রতিপক্ষ, না হলেও সম্পূর্ণ পৃথক বিষয়। তার মধ্যে একটি হলো মুখ্য, আর অন্যটি হল গৌন। এভাবে প্রশ্ন উত্থাপনের মধ্য দিয়ে একথা ধরে নেয়া হয় যে- সবাইকে হয় ‘ভোটপন্থী’ হতে হবে, না হলে ‘ভাতপন্থী‘ হতে হবে। ‘ভোটপন্থী’ হলে ‘ভাতপন্থী’ হওয়া যাবে না, আর ‘ভাতপন্থী’ হলে ‘ভোটপন্থী’ হওয়ার সুযোগ নেই। প্রকৃত জনদরদী, দেশপ্রেমিক, শুভবুদ্ধি সম্পন্ন, যুক্তিবাদী মানুষের কিন্তু বলার কথা- আমি একইসাথে ভোটপন্থী এবং ভাতপন্থী।
বর্তমানে যে বিতর্ক এখন তোলা হয়েছে, সেক্ষেত্রেও সঠিক জবাবটি হবে- যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই, সাথে সাথে দৈনন্দিন জীবন সঙ্কটের সমাধানও চাই। একটির জন্য অপরটিকে বিসর্জন দেয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। বরঞ্চ একটি অপরটির পরিপূরক। বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি-যানজট-দুর্নীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে যে তীব্র সঙ্কট জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে তা সমাধানে যতো বেশি অগ্রগতি ঘটানো যাবে, ততো বেশি করে জনগণের মাঝে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য উৎসাহ সৃষ্টি করা যাবে।
যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় না তাদেরই বরঞ্চ সুবিধা হয় যদি জনজীবনের সঙ্কট বাড়ে অথবা জিইয়ে থাকে। কারণ তাহলে জীবন যন্ত্রণায় কাতর মানুষ তাদের দৈনন্দিন সঙ্কটের মধ্যে হাবুডুবু খেতে থাকবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, গণতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের নানা খেলা- এসবের দিকে তাহলে সঙ্কট জর্জরিত মানুষ নজর দেয়ার অবসর পাবে না। অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সমর্থনকারী শক্তির সুবিধা হবে যদি গণজীবনের সঙ্কটগুলো অব্যাহত থাকে ও আরো গভীর হয়। তারা বেকায়দায় পড়বে, যদি মানুষের দৈনন্দিন জীবন যন্ত্রণা লাঘব হতে থাকে। তারা আত্মরক্ষার মরিয়া প্রচেষ্টায় পারলে জনজীবনের সঙ্কট বৃদ্ধি করার জন্যই বরং চেষ্টা করবে। নানা রকম অন্তর্ঘাত চালাবে। সঙ্কটের তীব্রতা বাড়িয়ে তোলার জন্য ষড়যন্ত্র করবে।
একথা তাই পরিষ্কার যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য যেসব কাজ করা একান্ত প্রয়োজন তার মধ্যে অন্যতম হল পানি-গ্যাস-বিদ্যুৎ-দ্রব্যমূল্য প্রভৃতি সমস্যাসহ জনজীবনের সমস্যাগুলো সমাধান করা। সরকার কর্তৃক এসব কর্তব্য সঠিকভাবে পালন না করতে পারায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজটিও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অন্যদিকে, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাগুলো সমাধান করার প্রয়োজনেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া দরকার। কারণ, এরাই সেই ভয়াল শক্তিধর বর্বর শক্তি যারা ‘পূর্ব বাংলার’ সম্পদ লুটপাট করে পাঞ্জাবি ২২ পরিবার ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে সেসব কুক্ষিগত করতে দেয়ার জন্য আমাদেরকে চিরস্থায়ীভাবে পাকিস্তানের জিঞ্জিরে আবদ্ধ করে রাখতে চেয়েছিল। বাঙালির উপর পরিচালিত জাতিগত শোষণের ফলে বাংলার সম্পদ বিদেশে (পশ্চিম পাকিস্তানে ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দেশে) পাচার হয়ে যেত। এই শোষণ অবসানের জন্য বাঙালি মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী গণহত্যা চালিয়ে এই জাতিগত শোষণের হাত থেকে মুক্তির জন্য বাঙালির সংগ্রামকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল। জামাত-ই-ইসলামসহ এদেশেরই কিছু উগ্র সম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ও ব্যক্তি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে মিলে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনা সংগঠনের কাজে সরাসরি যুক্ত হয়েছিল।
’৭১-সালে তাদের দ্বারা সংগঠিত অপরাধের বিচার যাতে বন্ধ হয়ে থাকে সেজন্য এই অপরাধী চক্র প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে তৎপর থেকেছে। বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ রাখতে সক্ষম হয়ে তারা দেশের রাজনীতিতে নিজেদেরকে পুনর্বাসিত করেছে। শুধু তাই নয়, বিএনপি’র মদদে তারা রাষ্ট্রক্ষমতায়ও অধিষ্ঠিত হতে পেরেছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সূচিত জাতীয় মুক্তির ধারাকে নস্যাৎ করে আবার বাঙালির উপর পাকিস্তানি ধারার শাসন ও শোষণ বহাল করাটাই তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল ও এখনো আছে। যদিও একথা ঠিক যে, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং এমনকি আওয়ামী লীগ যে অর্থনৈতিক নীতি-দর্শন অনুসরণ করছে তাতে দেশের সম্পদ যে এখনো পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দেশে পাচার হওয়া থেমেছে কিংবা দেশের অভ্যন্তরে অবাধ লুটপাটের সুযোগ বন্ধ হয়েছে, সেকথা বলা যায় না। কিন্তু জামায়াত সেই দেশি-বিদেশি শোষণ-লুণ্ঠনের ব্যবস্থাকে পাকিস্তানি আমলের মতো আরো শক্তিশালী ও নিরঙ্কুশ করে রাখতে চায়। বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি-দ্রব্যমূল্য প্রভৃতি সমস্যা সমাধানের স্বার্থে নিরঙ্কুশ লুটপাটের বিপদ দূর করা দরকার, তা করার জন্য পাকিস্তানি ধারার চীড় অবসান দরকার, আর তা নিশ্চিত করার জন্য জামায়াত ইসলামসহ পাকিস্তানপন্থী স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তির তৎপরতার অবসান ঘটানো দরকার এবং তা করতে হলে ’৭১-এ সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা দরকার। এ কারণেই জনগণের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্কট দূর করতে যারা প্রকৃতভাবেই আগ্রহী ও আন্তরিক, তারা যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ইস্যুতে নিরব অথবা নিরপেক্ষ থাকতে পারে না। বরঞ্চ, এই বিচারের জন্য তাদেরই হতে হবে সবচেয়ে দৃঢ় ও আগ্রহী শক্তি।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টিকে হাল্কা করে দেয়ার জন্য ’৭১-এর ঘৃণ্য অপরাধীরা নানা বিভ্রান্তি ছড়ানোর পথ গ্রহণ করেছে। তারা বলার চেষ্টা করছে যে, যে বিচার হতে যাচ্ছে তা যুদ্ধাপরাধের বিচার নয়। কারণ, সেটাই যদি হতো তাহলে তো যুদ্ধবন্দী হিসাবে আটক লক্ষাধিক পাক-বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে যে ১৯৫ জনকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, তাদের বিচার সবচেয়ে আগে করতে হতো। অথচ ’৭৪ সালে স্বাক্ষরিত ত্রিদেশীয় চুক্তি অনুসারী এই ১৯৫ জনকে বিচার না করেই পাকিস্তানে ফিরে যেতে দেয়া হয়েছে। তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি এখন অপ্রাসঙ্গিক তথা তামাদি হয়ে গেছে। বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য তারা আরো বলতে চেষ্টা করছে যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা এখন আর সম্ভব নয় একথা বুঝতে পেরেই সরকার ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’-এর নামে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে উদ্যত হয়েছে। সেজন্যই সরকার এখন মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ গঠন করেছে। তাদের আরো কথা হলো, মানবতাবিরোধী কাজের জন্য তো সাধারণ আইনেই বিচার সম্ভব। সেজন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে কেন? আর যদি ট্রাইব্যুন্যাল বিচার করতেই হয় তাহলে ’৭২-সালের পরে যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সেসবেরও বিচার এই ট্রাইব্যুনালেই করা হচ্ছে না কেন? এর দ্বারাই প্রমাণিত হয় যে গোটা ব্যাপারটার সাথে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কোনো সম্পর্ক নেই। ট্রাইব্যুনালে বিচার প্রক্রিয়া পরিচালিত হচ্ছে নিছক প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করার হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। এই মিথ্যা অভিযোগও তারা প্রচার করছে যে, এই দুরভিসন্ধিমূলক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই সরকার নতুনভাবে বিশেষ আইন প্রণয়ন করে বিচার প্রক্রিয়া অগ্রসর করছে।
এসব বিভ্রান্তিকর প্রচারণার জবাবে
বলা যায়;-
(১) সরকার নতুন করে কোনো আইন এখন প্রণয়ন করেনি। সংবিধানের ৪৭ ধারার ৩ উপধারা মোতাবেক ১৯৭৩ সালে প্রণীত আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন অনুসারেই বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেই আইনের কয়েকটি জায়গায় সম্প্রতি সামান্য কিছু সংশোধন করা হয়েছে মাত্র। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নতুন করে আইন পাস করিয়ে বিচার করার অভিযোগ তাই ভিত্তিহীন। বরঞ্চ উল্টো অনুযোগ উঠতে পারে এই মর্মে যে, ৩৭ বছর আগে প্রণীত আইনের প্রয়োগ এতো বছর পরে সূচনা হলো কেন? এই বিলম্ব করাটাই ছিল রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির প্রকাশ। উপরন্তু সেই রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির স্বরূপ ছিল স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ও রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক।
(২) একথা ঠিক যে, পাক-যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে যে ১৯৫ জনকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, তাদেরকে পাকিস্তানে ফেরত যেতে দেয়া হয়েছিল। ত্রিদেশীয় চুক্তি অনুযায়ী তা করতে হয়েছিল। চুক্তি স্বাক্ষরের সময় পাকিস্তান কথা দিয়েছিল যে এই ১৯৫ জনকে পাকিস্তান নিজেই যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করার অপরাধে বিচার করবে। পাকিস্তান তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেনি। পাকিস্তান তার কথা রাখেনি। সেই কারণে, যুদ্ধবন্দীদের বাইরে যেসব বাংলাদেশের নাগরিকরা আল-বদর, আল-শামস, রাজাকার প্রভৃতি বাহিনীর সদস্য হিসাবে অথবা সাধারণ সিভিলিয়ান হিসাবে ’৭১-এ যুদ্ধাপরাধ অথবা সমতুল্য অপরাধ করেছে তাদেরকে দেশের আইনে বিচার করার কাজ বন্ধ হবে কেন?
(৩) ’৭৩-সালের আইনটি ’৭৪ সালের ত্রিদেশীয় চুক্তি স্বাক্ষরের আগেই প্রণীত হয়েছিল। সুতরাং এই আইনের আওতা থেকে পাক-যুদ্ধবন্দীদের মধ্যকার যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিতরা ত্রিদেশীয় চুক্তির সুযোগে রেহাই পেলেও এই চুক্তির আওতার বাইরে বাংলাদেশের কোনো নাগরিক রেহাই পেতে পারে না।
(৪) ’৭৩ সালের আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যার মধ্যে যুদ্ধাপরাধও অন্তর্ভুক্ত। তাই বলা যায় যে, এখন যা হচ্ছে তা যুদ্ধাপরাধসহ সব ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার।
(৫) ’৭১-এ সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মধ্যে যুদ্ধাপরাধ ছাড়াও পরিকল্পিত ও সংঘটিত গণহত্যার অপরাধ অন্তর্ভুক্ত। সে সময়ের অপরাধ হিটলারের গণহত্যাসহ নানা অপরাধের চরিত্র ও ব্যাপ্তির সমতুল্য। যারা এধরনের হিটলারীয় চরিত্রের অপরাধের সাথে ’৭২-পরবর্তীকালের অপরাধমূলক কাজকে সমতুল্য বলে আখ্যায়িত করতে চায় তারা শুধু পাপই নয়, তারা অনুতাপহীন মানুষরূপী দানব ছাড়া অন্য কিছু নয়।
(৬) কিন্তু সবকিছুর আগে একটি বড় প্রশ্ন রয়ে যায়। ’৭১-এ যারা যুদ্ধাপরাধ ও সমতুল্য মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে, মুক্ত অবস্থায় থেকে জনগণের মধ্যে প্রচারণা চালানোর অধিকার তাদের আছে কি? ট্রাইব্যুনালের সামনে তারা তাদের যুক্তি-তর্ক তুলে ধরার অধিকার রাখে বটে। কিন্তু জনগণের মধ্যে কোটি কোটি টাকা খরচ করে প্রচারণা করার অধিকার কি তাদের থাকতে পারে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যখন নাৎসী নেতাদের বিচার শুরু হয়েছিল, তখন কি অভিযুক্ত অপরাধীদের প্রেস অথবা মিডিয়ার সামনে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য-বিবৃতি দেয়ার অধিকার দেয়া হয়েছিল। নাৎসী পার্টিকে কি তখন জেলায়-জেলায় গিয়ে কর্মীসভা, জনসভা করার সুযোগ দেয়ার কথা কারো কল্পনায়ও আসতে পারতো? সে দেশের কথা না হয় বাদই দিলাম। পঁচাত্তরের আগে পর্যন্ত আমাদের দেশেই কি কেউ ভাবতে পারতো যে জামায়াত ইসলামী ও তার নেতারা এখন যেভাবে সরবে প্রচারণা ও কাজ-কর্ম করছে তা তখন করার অধিকার রাখতো? সে সময় তারা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ অবস্থায় ছিল। সেটাই ছিল স্বাভাবিক, ন্যায়সঙ্গত, আইনসঙ্গত, গণতন্ত্রসম্মত ও মানবতাসম্মত। কিন্তু তার পরে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তারা আজও পর্যন্ত (বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরেও) স্বাধীনভাবে যে তৎপরতা চালাতে পারছে সেটাই অন্যায়, অস্বাভাবিক, অগণতান্ত্রিক ও মানবতা পরিপন্থী।
যুক্তি দেয়া হয় যে, বিচারে অপরাধী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে যুদ্ধাপরাধী বলে বিবেচনা করা যায় না। কথা ঠিক। কিন্তু অভিযুক্ত হিসেবে তো কাউকে বিবেচনা করা অবশ্যই যায়। কোনো অভিযুক্ত অপরাধীর অধিকার, বিশেষত তার অপরাধ যদি যুদ্ধাপরাধের সমতুল্য হয়, কখনই একজন সাধারণ স্বাধীন নাগরিকের সমান হতে পারে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হিটলারের দল, এস.এস, গেস্টাপো প্রভৃতি বাহিনী এবং সে সবের মূল নায়কবৃন্দ তথা হারমেন গেয়েরিং, রাডলফ হেস, রিবানট্র, মার্টিন, বোরম্যান, উইলহেলম কেটেল, আইকম্যান প্রমুখকে কি তাদের গণতান্ত্রিক নাগরিক অধিকারগুলো ভোগ করে তাদের সপক্ষে জনমত সৃষ্টি করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল? তাদেরকে যদি সেটা না দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে গোলাম আজম-নিজামী-মুজাহিদগংকে কেন তা দেয়া হবে?
গণহত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ যারা করেছে, তারা কি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কোটি জনতার মতো সমান অধিকার দাবি করতে পারে? পারে না। যদি তাই হতো তাহলে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা নিয়ে গল্প, উপন্যাস, নাটক, সিনেমা, চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, যাদুঘর- কতকিছু হয়। কিন্তু রাজাকারদের ‘কাজকে’ স্মরণীয় করে রাখার জন্য সেসব করা হয় না কেন? মন্ত্রিত্বসহ কয়েক দশক ধরে ক্ষমতার মদদ পাওয়ার পরেও গোলাম আজম-নিজামী-মুজাহিদরা ‘মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের’ মতো তাদের একটা ‘রাজাকার যাদুঘর’ প্রতিষ্ঠা করলো না কেন? কারণ অতি সহজ। তারা নিজেরাই জানে যে, ’৭১-এ তাদের সব কাজকর্ম ছিল অপরাধমূলক, মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীমূলক, পৈশাচিক ও বর্বর।
সুবিচারের স্বার্থেই যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির মুখ এখনই বন্ধ করে দিতে হবে। তাদের স্থান এই মুহূর্তেই হওয়া উচিত কারাগারে। কিছু বলার থাকলে তারা তা বলুক ট্রাইব্যুনালের সামনে। নাৎসী শক্তির কর্ণধারদের যতটুকু সুযোগ আমেরিকা-ইউরোপ-সোভিয়েতের মিত্র শক্তি প্রদান করেছিল, তার সবটুকু জামায়াতীদের দেয়া হোক, তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু তার একবিন্দু বেশি নয়। সরকারের উচিত, সেভাবেই অগ্রসর হওয়া।
[লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।]

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




