somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছাত্র ইউনিয়নের অনন্য গৌরবগাথা

২৭ শে এপ্রিল, ২০১০ রাত ৮:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
ছাত্র ইউনিয়নের অনন্য গৌরবগাথা

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম | তারিখ: ২৬-০৪-২০১০
৫৮ বছর ধরে গড়ে উঠেছে যে ছাত্র ইউনিয়ন পরিবার, আমি সেই পরিবারের একজন সদস্য। এটা আমার আত্মপরিচয়ের অমূল্য সঞ্চয়, আমার পরম গৌরব।
আর মাত্র দুই বছর পরে ছাত্র ইউনিয়নের ৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হবে। ভিশন-২০১২ সামনে রেখে ছাত্র ইউনিয়ন পরিবারে এখন থেকেই জেগে উঠতে শুরু করেছে আবেগ-অনুভূতির গভীর স্পন্দন।
ছাত্র ইউনিয়নের ইতিহাস হলো এক অনন্য গৌরবগাথা। এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি বছর-পরম্পরায় লাখ লাখ তরুণ ছাত্রছাত্রীকে নির্ভেজাল দেশপ্রেম, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা, বিশ্ব শান্তি, আন্তর্জাতিকতাবাদ, প্রগতিশীলতা, সমাজতন্ত্র, মানবমুক্তি ইত্যাদি সুমহান আদর্শ ও চেতনায় দীক্ষিত করেছে। ঐক্য-শিক্ষা-শান্তি-প্রগতি—এই চারটি মূল মন্ত্রকে ভিত্তি করে ছাত্রসমাজের মধ্যে প্রজ্বলিত হয়েছে জাগরণের অগ্নি-মশাল। অজেয় ও অনির্বাণ সেই চেতনার আলোকচ্ছটায় বায়ান্ন থেকে দীপ্ত হয়েছে অগণিত ছাত্রছাত্রী। ছাত্র ইউনিয়নের শিক্ষা তাদের শ্রেষ্ঠ মানুষের গুণাবলি আত্তীকরণে ও নিজ নিজ পেশায় উত্কর্ষ অর্জনে পথ রচনা করে দিয়েছে।
ছাত্র ইউনিয়ন তার সদস্যদের শিক্ষা দিয়েছে প্রজ্ঞা, প্রগতিমুখিতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, সাহসিকতা, দৃঢ়তা, নিষ্ঠা, আত্মত্যাগের মনোবৃত্তি, উন্নত চারিত্রিক গুণাবলি, সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক বোধ, উন্নত রুচিশীলতা, শ্রমের প্রতি মর্যাদা, শোষিত-অবহেলিত মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসার বোধ ইত্যাদি। ছাত্র ইউনিয়ন শিখিয়েছে, বিদ্যমান প্রতিকূলতার কাছে মাথা নত না করে প্রতিক্রিয়াশীল স্থিতাবস্থাকে, অথবা গণশত্রুর আঘাত চ্যালেঞ্জ করতে। মাঝেমধ্যে নেমে আসা ঘোর কৃষ্ণপক্ষের মধ্যেই ছাত্র ইউনিয়ন সব সময় থেকেছে (এবং আজও আছে) আদর্শবাদের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকার অনন্ত প্রবহমান উৎস হয়ে। বর্তমানের মধ্যে ভবিষ্যতের প্রতিনিধি হয়ে বহন করে চলেছে মুক্তির পতাকা।
ছাত্র ইউনিয়ন সব সময় ছিল এবং আজও রয়েছে ছাত্রসমাজেরই সংগঠনরূপে। ছাত্রসমাজের প্রকৃত স্বার্থ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা, স্বপ্ন-সাধ অবলম্বন করেই ছাত্র ইউনিয়নের ভিত্তি রচিত। তাই শিক্ষার দাবিতে, উন্নত একাডেমিক পরিবেশের জন্য, উপযুক্ত শিক্ষানীতি রচনার জন্য, ছাত্র হিসেবে সমাজের কাছে প্রাপ্য অধিকার আদায়ের জন্য ও সমাজের প্রতি ছাত্রসমাজের দায়িত্ববোধ সৃষ্টির জন্য ছাত্র ইউনিয়ন সব সময় নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছে। হোস্টেলের পাতলা ডাল ঘন করতে হবে, টয়লেটের ভাঙা দরজা মেরামত করতে হবে, সিলেবাসকে জাতীয় প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে মিলিয়ে সুবিন্যস্ত করতে হবে, পরীক্ষাপদ্ধতি ঢেলে সাজাতে হবে, নকলের প্রবণতা বন্ধ করতে হবে—ছোট-বড় এসব প্রশ্ন সব সময়ই থেকেছে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু।
এসব কারণে ছাত্র ইউনিয়ন থাকতে পেরেছে ছাত্রসমাজের নিজস্ব স্বাধীন সংগঠন হয়ে। তাকে কখনোই রাজনৈতিক কোনো দলের অঙ্গসংগঠন হতে হয়নি অথবা কোনো রাজনৈতিক দল অথবা মতাদর্শের অনুষঙ্গ হয়ে থাকাটাকে তার উদ্দেশ্য করতে হয়নি।
ছাত্রসমাজের মৌলিক স্বার্থগুলো পূরণ করার পথে প্রচলিত সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক বিধিব্যবস্থাগুলো যে প্রতিবন্ধক, সেই উপলব্ধি ছাত্র ইউনিয়ন তার জন্মলগ্ন থেকেই ব্যক্ত করেছে। এই উপলব্ধি থেকেই জাতীয় ঘটনাপ্রবাহে, সামাজিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়, শোষণমুক্তির সংগ্রামে, সমাজতন্ত্র ও মেহনতি মানুষের পক্ষে অবস্থান গ্রহণে রচিত হয়েছে ছাত্র ইউনিয়নের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা। ছাত্রসমাজের মধ্যে রক্ষণশীলতা, কূপমণ্ডূকতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা, সুবিধাবাদ, ক্যারিয়ারিজম প্রভৃতি প্রবণতার বিরুদ্ধে র্যাডিক্যাল বাম ধারার বিপ্লবী প্রেরণাকে সব সময় ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে ছাত্র ইউনিয়ন। এই মৌলিক বৈশিষ্ট্য অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে ছাত্র ইউনিয়নের প্রতি আকর্ষণ করেছে ছাত্রসমাজের একটি প্রধান অংশকে। ব্যতিক্রম ঘটেছে কেবল তখনই, যখন ক্ষমতাসীনদের মদদে জাতীয় ক্ষেত্রের পাশাপাশি ছাত্রসমাজের মধ্যে সুবিধাবাদ, ক্যারিয়ারিজম ইত্যাদি অবক্ষয়ের ধারা প্রবল হয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে, কিংবা যখন ছাত্র ইউনিয়ন তার ঐতিহ্যমণ্ডিত র্যাডিক্যাল বিপ্লবী ধারা অগ্রসর করতে দ্বিধা-দুর্বলতা দেখিয়েছে।
শিক্ষার দাবিতে, স্বৈরাচার-সাম্প্রদায়িকতা-সন্ত্রাস-সাম্রাজ্যবাদ-লুটপাটতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে, সর্বোপরি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়নের অগণিত নেতা-কর্মী শহীদ হয়েছেন, জেল-জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সত্য ও ন্যায়ের জন্য আত্মোৎসর্গের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে রেখেছে ছাত্র ইউনিয়ন।
ছাত্র ইউনিয়ন ঐতিহ্যগতভাবেই হয়ে উঠতে পেরেছে মননশীলতা, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার এক ফলবান ক্ষেত্র। যারা গভীর চিন্তা করে, মেধাবী, বই পড়ে, ভালো বিতর্ক করে, গান গায়, আবৃত্তি করে, নাটক করে, যারা সত্, ত্যাগী, সাহসী, গরিবের দুঃখ দেখলে যাদের মন কাঁদে, যারা দুনিয়ায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক খবর রাখে—তারা সবাই সাধারণভাবে ছাত্র ইউনিয়ন করে। ‘বিপ্লবের আবেগ’ শুধু নয়, উচ্ছ্বাসমুক্ত গভীর বাস্তব বিশ্লেষণ ও যুক্তি-চিন্তার পথ ধরেই গড়ে উঠেছে ছাত্র ইউনিয়নের বিপ্লবী ঐতিহ্যধারা।
তার বিপ্লবী ধারা সুদৃঢ়ভাবে অগ্রসর করার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়ন আশু সংস্কারমূলক কোনো কাজকে কখনোই অবহেলা করেনি। বরং ত্রাণের কাজ, দাঙ্গা প্রতিরোধ প্রভৃতি ক্ষেত্রে সব সময়ই ছাত্র ইউনিয়ন থেকেছে অগ্রবর্তী।
চেতনার যে দীপ্ত মশাল, ব্যাপক ও বহুমুখী কর্মযজ্ঞের যে ঐতিহ্য-অভিজ্ঞতা গত ৫৮ বছর গৌরবের সঙ্গে সমুজ্জ্বল রেখেছে ছাত্র ইউনিয়ন, তা চির-অম্লান, চিরঞ্জীব। প্রায় ছয় দশক ধরে গড়ে ওঠা ঐতিহ্য ও ধারাকে শুধু টিকিয়ে রাখাই নয়, তাকে আরও বিকশিত করেই এগিয়ে যাওয়ার পথ রচনা করতে হবে। আজকের দিনের ছাত্রসমাজের চাহিদা ও তাগিদ এবং জাতীয়-আন্তর্জাতিক বাস্তবতার চলমান বিকাশধারাকে বিবেচনায় নিয়েই সেই পথ রচনা করতে হবে।
ছাত্র ইউনিয়নের প্রগতিশীল বিপ্লবী চেতনা ঐতিহ্যের ধারাকে পরিত্যাগ নয়, কঠিন ও জটিল বাস্তবতার মুখেও তা আরও বলিষ্ঠভাবে এগিয়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। বর্তমান প্রজন্মের সাথিদের হয়ে উঠতে হবে আরও দক্ষ। সৃজনশীলতা আর মননশীলতার ছাপ রাখতে হবে নিত্যদিনের চিন্তায় ও কর্মে। আদর্শ ও ঐতিহ্যের মশাল বহন করে এগিয়ে যেতে হবে নব নব বিজয়ের পথে। বিজয় আসবেই একদিন। ‘আমরা করব জয়, নিশ্চয়ই!’ কারণ ছাত্র ইউনিয়ন এক অজেয় চিরঞ্জীব চেতনা।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদিকে গুলি করলো কে?

লিখেছেন নতুন নকিব, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:২৬

হাদিকে গুলি করলো কে?

ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা ৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজপথের অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলিবিদ্ধ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জীবনের চেয়ে তরকারিতে আলুর সংখ্যা গণনা বেশি জরুরি !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:১৭


বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশবাসী একটা নতুন শব্দ শিখেছে: রুট ভেজিটেবল ডিপ্লোম্যাসি। জুলাই আন্দোলনের পর যখন সবাই ভাবছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইতিহাসের সেরা ম‍্যাটিকুলাস ডিজাইনের নির্বাচনের কর্মযজ্ঞ চলছে। দলে দলে সব সন্ত্রাসীরা যোগদান করুন‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৪:৪৪



বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ব নিকৃষ্ট দখলদার দেশ পরিচালনা করছে । ২০২৪-এর পর যারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী দিয়ে দেশ পরিচালনা করছে । তাদের প্রত‍্যেকের বিচার হবে এই বাংলার মাটিতে। আর শুধুমাত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির হত্যাচেষ্টা: কার রাজনৈতিক ফায়দা সবচেয়ে বেশি?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১৮


হাদির হত্যাচেষ্টা আমাদের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে একটি অশনি সংকেত। জুলাই ২০২৪ আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের দ্বিধাবিভক্ত সমাজে যখন নানামুখী চক্রান্ত এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অন্তর্কলহে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আয়-উন্নতির গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×