somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্থানীয় সরকার দ্বিমুখী চাপে ত্রিশঙ্কু অবস্থা

৩০ শে এপ্রিল, ২০১০ সকাল ৭:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

স্থানীয় সরকার দ্বিমুখী চাপে ত্রিশঙ্কু অবস্থা

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

২৫ এপ্রিল আমি ঢাকার মুক্তাঙ্গনে উপস্থিত হয়েছিলাম। উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস-চেয়ারম্যান ঐক্য পরিষদ সেদিন গণঅনশনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়নের জন্য ১০-দফা দাবির ভিত্তিতে উপজেলার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও ভাইস-চেয়ারম্যানরা অনেক দিন ধরে যে সংগ্রাম করেছেন, তারই ধারাবাহিকতায় সংগঠিত করা হয়েছিল ঐক্য পরিষদের এই অনশন কর্মসূচি। তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানাতে ও আন্দোলনের সাথে সংহতি জানাতেই আমি মুক্তাঙ্গনে তাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছিলাম।

অনশনে ক্ষুৎপিপাসায় ক্লিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও পুরুষ ও মহিলা নির্বাচিত এসব সম্মানিত জনপ্রতিনিধিদের চোখে মুখে ছিল বলিষ্ঠ দৃঢ়তার ছাপ। শুধু অনশনের জন্যই নয়, নানামুখী আক্রমণে তারা যে বিধ্বস্ত, অসহায়- তার প্রতিচ্ছবি যেমন সেখানে প্রত্যক্ষ করা গেছে, তেমনি দেখা গেছে হতাশা ও অসহায়ত্তের কুজ্ঝটিকা ছাপিয়ে জনসমর্থনে পুষ্ট আত্মপ্রত্যয়ী দৃঢ়তার বলিষ্ঠ প্রকাশ। উপজেলা পরিষদের কাজে কর্তৃত্ব করবে কে, সেটা নিয়েই যতো দ্বন্দ্ব, বিবাদ ও গোলমাল। বিবাদ ত্রিমুখী। একদিকে নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস-চেয়ারম্যানগণ। অন্যদিকে আরেক কিসিমের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, মাননীয় সংসদ সদস্যগণ। আর তা ছাড়াও আছেন সর্বদা বিরাজমান মহাশক্তিধর আমলাতন্ত্র ও উপজেলায় তার প্রতিনিধি ইউএনও বা উপজেলা নির্বাহী অফিসার। এই ত্রিকোণ রশি টানাটানিতে উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস-চেয়ারম্যানরা আজ ত্রিশঙ্কু অবস্থায় নিপতিত। এমপি সাহেবরা আর ইউএনও সাহেবরা হাত মিলিয়েছে রাজনৈতিক সরকার ও আমলাতন্ত্রের এক ধরনের কৌশলগত ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে তারা দু’পক্ষ মিলে উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস-চেয়ারম্যানদের কর্তৃত্বকে কোণ্ঠাসা করে দিতে সক্ষম হয়েছে। ত্রিভুজের আকৃতিই এমন যে, তার দুই কোণ্ মিলে অবশিষ্ট এক কোণের চেয়ে বড় হতে মোটেই কষ্ট হয়নি। উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস-চেয়ারম্যানদের এখন তাই একেবারেই নাস্তানাবুদ অবস্থা।

এই অবস্থা শুধু উপজেলা পরিষদকে ঘিরে নয়। এটা গোটা দেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা- সব ক্ষেত্রেই স্ব-স্ব অবস্থানের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের এখন এমনই নাস্তানাবুদ অবস্থা। জেলা পরিষদের কাজ এখনো শুরু হয়নি। শুরু হলে সে ক্ষেত্রেও যে একই অবস্থা দাঁড়াবে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

তাই বলা যায়, দুই গালে দুই তরফের বিরাশি সিক্কা ওজনের চপেটাঘাত খেয়ে দেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার চিৎপটাং হওয়ার অবস্থা হয়েছে। অনেকেই অবশ্য এই আক্রমণকে চপেটাঘাত না বলে বক্সিং-এর ভাষায় ‘ ‘স্ট্রেইট পাঞ্চ’ বলে আখ্যায়িত করাটা অধিকতর উপযুক্ত বলে বিবেচনা করবেন। স্থানীয় সরকারের ওপর দু’দিক থেকেই শক্তিশালী এরূপ দুটি ‘পাঞ্চ’ একসাথে বর্ষিত হয়েছে। একদিক থেকে ‘এমপিতন্ত্রের’ দাড়াম্ ঘুষি, আর অন্যদিক থেকে ‘আমলাতন্ত্রের’ শক্তিশেল। এমপিতন্ত্রের ও আমলাতন্ত্রের তরফ থেকে এহেন দ্বিমুখী আক্রমণে পড়ে স্থানীয় সরকারের এখন মরণ দশা উপস্থিত হয়েছে।

স্থানীয় সংস্থার কর্তৃত্ব নিয়ে এতো টানাটানির কারণ কী? কয়েকটি কারণের কথা এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। স্থানীয় স্বশাসনের ব্যাপারটি আমাদের সমাজে সুপ্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত। রাজা-মহারাজারা রাজ্য চালাত। পরস্পর যুদ্ধ করত। রাজ্যের-স্রাাজ্যের উত্থান-পতন ভাঙা-গড়া চলত। এসবের মাঝেই প্রশান্ত লয়ে আপন তালে প্রবাহিত হতো গ্রামভিত্তিক ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র অর্থনৈতিক-সামাজিক এককগুলো। অনেকেই একে ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’ বলে বিশেষায়িত করে থাকেন। এসব গ্রামের প্রবাহমান ফল্গুধারা লালিত হতো তারই বৈশিষ্ট্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে গড়ে ওঠা স্থানীয় স্বশাষিত গণসংস্থাসমূহ দ্বারা। মাতব্বর, সর্দার ইত্যাদি ব্যবস্থাসহ পঞ্চায়েত ব্যবস্থার ধারণার মধ্যদিয়ে সেই প্রাচীন ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি এখনো আমরা কিছুটা খুঁজে পাই।

যুগ যুগ ধরে চলে আসা সেই স্বশাসিত স্থানীয় শাসনব্যবস্থার ওপর সবচেয়ে প্রথম বড় রকম ধাক্কা আসে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের হাত থেকে। রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বকে সর্বব্যাপী প্রসারিত করার রাজনৈতিক প্রয়োজনে স্থানীয় স্বশাসনব্যবস্থাকে তারা নিয়ন্ত্রিত করার পদক্ষেপ নেয়। ১৮৮৫ সালে তারা আমাদের দেশে প্রবর্তন করে ইউনিয়ন বোর্ড নামক সংস্থা। এর মাধ্যমেই ঘটেছিল প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত স্বশাসিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থার ক্ষেত্রে বড়রকম বিকৃতি সাধন। এর দ্বারা স্থানীয় স্বশাসিত ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক শাসন প্রক্রিয়ার আওতার মধ্যে নিয়ে আসা হয়। এগুলো হয়ে ওঠে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘স্থানীয় চৌকি’। তবে এতদসত্ত্বেও তৃণমূলের নিবিড় শাসন প্রক্রিয়ার যেসব কাজ প্রাচীনকাল থেকে স্বশাসিত সংস্থাগুলো পরিচালনা করত, সেসব কাজও ব্রিটিশদের তৈরি করা ইউনিয়ন বোর্ডসমূহকেও অব্যাহত রাখতে হয়। সেই ইউনিয়ন বোর্ড, জেলা বোর্ড ইত্যাদির উত্তরাধিকার বহন করেই সমকালীন ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পরিষদের গঠনধারা রচিত। আইউব আমলে মৌলিক গণতন্ত্রের ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে এদেরকে আরো বেশি করে দলীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় আরো একধাপ এগিয়ে দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর রচিত সংবিধানে ব্রিটিশ শাসকদের দ্বারা স্বশাসিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থার বিকৃতি সাধন রদ করে তাকে তার প্রকৃত গণতান্ত্রিক মর্মবাণীর ভিত্তিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া হয়। সংবিধানে এ বিষয়ে একটি পৃথক পরিচ্ছেদই অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু সেই সাংবিধানিক বিধান আজও বাস্তবায়ন হয়নি। বেসামরিক, সামরিক, নির্বাচিত, অনির্বাচিত- কোনো সরকারই তা রূপায়ণে অগ্রসর হয়নি। রাষ্ট্রের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ আজও যাদের হাতে রয়ে গেছে, তারা তা বাস্তবায়িত হতে দেয়নি। নিজের পায়ে কি সহজে কেউ কুড়াল মারতে রাজি হয়? আমলাতন্ত্র ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রের উপর তাদের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব হাতছাড়া করতে মরিয়া হয়ে বাধা দিয়েছে, ষড়যন্ত্র করেছে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার আগে এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিলেও একই কর্তৃত্ববান সেই শক্তিধর মহলের কারণে স্বশাসিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে কর্তৃত্ববান হতে দেয়নি।

স্থানীয় সরকারের সংস্থাগুলো সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ক্ষমতার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ইউনিয়ন, উপজেলা, কর্পোরেশন, পৌরসভা ইত্যাদি ক্ষেত্রে নির্বাচিত সংস্থাগুলো বৃহত্তর ক্ষমতার রসদ সংগ্রহের কাজে লাগে। জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য নয়, ক্ষমতার পিরামিডে অবস্থান উন্নত করার সোপান হিসেবে স্থানীয় সংস্থাগুলো আগাগোড়া ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক তৃণমূলে খুঁটি স্থাপনের চিন্তা থেকেই এগুলোকে কাজে লাগানো হয়েছে। তাই, ক্ষমতার দড়ি টানাটানির খেলায় একদিকে আমলাতন্ত্র আর অন্যদিকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি প্রভৃতি বড় বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো স্থানীয় সংস্থার ওপর তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে এতো মরিয়া। স্থানীয় সংস্থাকে পূর্ণ স্বশাসন ক্ষমতা দিলে তাদের ক্ষমতার দাপট তারা কতোটা আর বজায় রাখতে পারবে, এই ভয়ে তারা ক্ষমতার গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের চেষ্টাকে নস্যাৎ করতে এতো তৎপর ও বেপরোয়া।

এরশাদী স্বৈরাচারের আমলে উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তন করে বলা হয়েছিল যে, এটা প্রশাসন ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে করা হচ্ছে। কিন্তু সেই বিকেন্দ্রীকরণ গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের পদক্ষেপ ছিল না। সেটা ছিল স্বৈরতন্ত্রের শাখা-প্রশাখা তৃণমূলে বিস্তৃত করার একটি দুরভিসন্ধিমূলক প্রয়াস মাত্র। জেলখানায় আটক রেখে বন্দীদের স্বশাসন প্রদানকে যেমন মুক্তি প্রদান বলা যায় না, সামরিক স্বৈরশাসন বহাল রেখে উপজেলা পরিষদ গঠনকেও তেমনই ক্ষমতার গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ বলা নিছক তামাশা বৈ অন্য কিছু নয়।

ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে চলে সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়নের নানা কার্যক্রম। প্রজেক্টের কাজ, বিধবা ভাতা, স্কুল-কলেজের শিক্ষক নিয়োগ, রাস্তা-কালভার্ট নির্মাণ ইত্যাদি হরেক রকমের কতো কাজ সেখান থেকে করতে হবে। এগুলোই তো ‘পাওয়ার’ দেখানোর জায়গা। এই পাওয়ার স্থানীয় সংস্থার হাতে ছেড়ে দিলে এমপি হওয়ার কিংবা আমলা হওয়ার চার্ম আর থাকে কি? এসব বিষয়ে চূড়ান্ত কর্তৃত্ব ছাড়তে তাই তারা নারাজ।

ব্যাপারটা শুধু ‘পাওয়ারের’ বিষয় মাত্র নয়। এই পাওয়ারের সাথে যুক্ত হয়ে আছে আর্থিক স্বার্থের ব্যাপারও। রাস্তা-ঘাট নির্মাণের টেন্ডার থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগ, ছাত্র ভর্তি, গমের প্রজেক্ট অনুমোদন- সবকিছুর সাথে জড়িত রয়েছে লেনদেন আর বিপুল পরিমাণের উপরি-আয়ের ব্যাপার। এরূপ মোহনীয় আর্থিক সুযোগ কে স্বেচ্ছায় ছাড়তে রাজি হতে পারে? তাইতো উপজেলা পরিষদের কর্তৃত্ব নির্বাচিত চেয়ারম্যানের হাতে দিতে এতো আপত্তি। কর্তৃত্ব রাখতেই হবে এমপি মহোদয় ও ইউএনও সাহেবের হাতে।

একটি বিভ্রান্তিকর যুক্তি এই মর্মে হাজির করা হয়ে থাকে যে, মাননীয় সংসদ সদস্যগণ সংবিধান মোতাবেক নিজ নিজ আসন (ঈড়হংঃরঁবহপু) থেকে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। নিজ এলাকার জনগণের ভালো-মন্দ দেখার প্রধান দায়িত্ব তো তাই তারই। সরকার ও রাষ্ট্র বরাবর নিজ এলাকার জনগণের সার্বিক স্বার্থের মূল প্রতিনিধি তিনিই, কারণ তিনিই রাষ্ট্র পরিচালনার কেন্দ্রীয় অবস্থানে একমাত্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। স্থানীয় সব কর্মকান্ডের বিষয়ে চূড়ান্ত খবরদারীর এক্তিয়ার সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যের- এই দাবি প্রমাণ করার জন্য এ ধরনের যুক্তি দেয়া হয়।

সরকারের তরফ থেকে আরেকটি খেলো যুক্তি আজকাল দেয়া হচ্ছে একথা বলে যে, যেহেতু স্থানীয় সংস্থা সম্পর্কে আইন তো পাস করতে হবে জাতীয় সংসদে। তাই, সংসদকে অবজ্ঞা করা ঠিক হবে না। সংসদ সদস্যদের আবেগ-আকাক্ষাকেও দাম দিতে হবে। সংসদ থাকলে উপজেলা চেয়ারম্যানরা থাকবে। সংসদ না থাকলে কেউ থাকবে না। এ ধরনের কথা যে একাধারে একটি হুমকি ও সাথে সাথে ব্ল্যাক মেইলের ভাষার মতো, তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন হয় না। আইন প্রণয়ন করার ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের সন্তুষ্ট রাখার প্রতি নজর দেয়াটাই যদি কর্তব্য হয় তাহলে দেশের সংবিধান আছে কী করতে?

এখন তাই নজর দেয়া যাক সংবিধানের দিকে। প্রথমেই দেখা যাক, সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি শিরোনামে এ বিষয়ে কী লেখা আছে? এখানে ৯ নং ধারায় লেখা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিগণ সমন্বয়ে গঠিত স্থানীয় শাসন-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহকে উৎসাহ দান করিবেনঃ’। এখানে ‘ সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিগণ’ এবং তাদের ‘সমন্বয়ে গঠিত স্থানীয় শাসন-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান’ শব্দগুলো থেকে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিতে এ বিষয়ে মর্মকথা স্পষ্ট হয়ে যায়। তারপরে ১১ নং ধারায় গণতন্ত্র প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- ‘ঃ এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ এখানে বিষয়টি আরো সুনির্দিষ্ট হয়েছে ‘সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে’ শব্দগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে। অবশ্য সংবিধানের এসব বয়ান সম্পর্কে কেউ বলার চেষ্টা করতে পারেন যে, এগুলো তো রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি সম্পর্কিত কথা। এসবই রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। এসব এখনই অনুসরণ করার আইনগত কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কথা সত্য। তাহলে দেখা যাক, সংবিধানের অন্যত্র কী বলা আছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সংবিধানের চতুর্থ ভাগে (নির্বাহী বিভাগ সংক্রান্ত ভাগ) তৃতীয় পরিচ্ছদটি ‘স্থানীয় শাসন’ শিরোনামে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখানে যা বলা হয়েছে, তা আইনত বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণীয়। এখানে ৫৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনভার প্রদান করা হইবে।’ এখানে ‘প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় ভার’ শব্দের দ্বারা স্পষ্টতই স্ব-স্ব ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, পৌর এলাকা ইত্যাদির কথাই বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থানীয় শাসনের ভার কার ওপর অর্পণের কথা বলা হয়েছে? সে সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশনা হলো, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর।’ অর্থাৎ ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ ইত্যাদি, যেগুলো নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত হতে হবে। এসব থেকে একথাই প্রতীয়মান হয় যে, ইউনিয়নে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য সদস্য, উপজেলায় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস-চেয়ারম্যান ও অন্য সদস্য ইত্যাদির ওপর সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থানীয় শাসন ভার অর্পিত হবে। এখানে সংসদ সদস্য অথবা ইউএনও-কে কর্তৃত্ব প্রদানের প্রশ্ন কোনোক্রমেই আসতে পারে না।

জাতীয় সংসদের সদস্যরা যেমন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস-চেয়ারম্যান কিংবা ইউনিয়ন পরিষদ অথবা পৌরসভার চেয়ারম্যানবৃন্দও তো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। সবাই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, কোন্্ জনপ্রতিনিধি তাহলো কোন্ দায়িত্ব পালন করবে? উত্তর অতি সহজ। যে প্রতিনিধি যে কাজের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন, তিনি সেই দায়িত্ব পালন করবেন। সংসদ সদস্যগণ নির্বাচিত হয়েছেন তার এলাকার জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে দেশের আইন প্রণয়ন ও কেন্দ্রীয় সরকারের কাজের তত্ত্বাবধানের জন্য। এ দুটি কাজ সম্পাদন করা তার দায়িত্ব। তিনি উপজেলা পরিষদের দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচিত হননি। উপজেলা পরিষদের কাজে নাক গলানো (কর্তৃত্ব করা তো দূরের কথা) মোটেও তার দায়িত্ব নয়। এমপি সাহেবকে এলাকার সব কাজ করতে হবে- মানুষের মনে, এমন একটি ভুল ধারণা ঢুকে আছে। স্থানীয় সরকারের কার্যক্রম রুদ্ধ হয়ে থাকাটা এমন ভুল ধারণা সৃষ্টির জন্য অনেকটা পরিমাণে দায়ী। এই ভুল ভাঙাতে হবে। কিন্তু মানুষের ভুল ধারণার অজুহাতে সংবিধানের দিক-নির্দেশনা অমান্য বা অবহেলা করে আইন প্রণয়ন করাটা মোটেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

স্থানীয় সরকার নিয়ে যে তামাশা চলছে তা বন্ধ করা আবশ্যক। সংবিধানের নির্দেশ অনুসরণ করে প্রকৃত ‘গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের পথে অগ্রসর হওয়া এই মুহূর্তের জরুরি কর্তব্য। গণতন্ত্রকে গভীরতা প্রদান ও দৃঢ়মূল করার জন্য এটা অপরিহার্য। এক্ষেত্রে কতগুলো বিশেষ করণীয়র কথা এখানে উল্লেখ করছি।

১. সংশ্লিষ্ট এলাকার সংসদ সদস্যকে উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করে তাঁকে যে সব কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়েছে তা রদ করা।

২. উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে উপজেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসাবে যে দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছে তা রদ করা।

৩. উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ইত্যাদি স্থানীয় সংস্থাসমূহের প্রধান নির্বাহী হিসেবে সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান যেন দায়িত্ব পালন করতে পারেন তা নিশ্চিত করা এবং এই দায়িত্ব ও ক্ষমতা প্রয়োগে প্রতিবন্ধকতা দূর করা।

৪. সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ ধারা অনুসরণ করে স্থানীয় সংস্থাসমূহের কার্যাবলীর এক্তিয়ার প্রসারিত করে গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের ব্যবস্থা করা।

৫. পর্যাপ্ত কর্তৃত্ব ও ক্ষমতাসম্পন্ন বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকার কমিশন প্রতিষ্ঠা করা। প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণসহ সমন্বিত জাতীয় বিকেন্দ্রীকরণ নীতিমালা প্রণয়ন করা।

৬. জাতীয় বাজেটের সুনির্দিষ্ট অংশ (কমপক্ষে ৩৩%) বিধিবদ্ধভাবে স্থানীয় সংস্থাসমূহের জন্য বরাদ্দ রাখার ব্যবস্থা করা।

৭. জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্থানীয় সংস্থার তত্ত্বাবধানে তৃণমূল থেকে স্থানীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার খসড়া প্রণয়ন এবং সে সব প্রস্তাব সমন্বিত করে জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার ব্যবস্থা চালু করা।

৮. রাষ্ট্রের সেবামূলক কাজকর্ম (১৭টি মন্ত্রণালয়ের ২১টি দপ্তর সংশ্লিষ্ট কাজ) বাস্তবায়নের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের কাছে প্রকৃতভাবে ন্যস্ত করার বিধান বাস্তবায়ন করা।

৯. স্থানীয় সংস্থার মাধ্যমে অনগ্রসর অঞ্চল, প্রতিবন্ধী, আদিবাসী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী প্রমুখের জন্য বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করা।

১০. সকল স্তরে সংশ্লিষ্ট সংস্থার জন্য গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব নিশ্চিত করা। সকল কাজের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়নের বিষয়টি যে ছোটখাটো কোনো বিষয় নয়, অভিজ্ঞতায় তার প্রমাণ মিলেছে। অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ক্ষমতার প্রশ্নের সাথে এটি সরাসরি সম্পর্কিত। রাষ্ট্রক্ষমতাকে কেন্দ্র করে যেভাবে শ্রেণীদ্বন্দ্ব পরিচালিত, স্থানীয় সরকারে ক্ষমতায়নের বিষয়টিও সেই শ্রেণীসংগ্রামের আওতার বাইরে নয়। তবে মনে রাখা প্রয়োজন যে, রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্বের পেছনে একই শ্রেণীর বিভিন্ন অংশের মধ্যে লুটপাটের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়েও হতে পারে। এই দ্বন্দ্বের সাথে সাধারণ মানুষের স্বার্থ ও গণতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক নেই। পক্ষান্তরে আসল দ্বন্দ্ব হলো শোষকশ্রেণীর কায়েমি স্বার্থ বনাম শ্রমজীবী মানুষসহ ব্যাপক জনগণের মধ্যেকার সংগ্রাম স্থানীয় সরকারের প্রকৃত ক্ষমতায়নের সংগ্রামকে সেই আলোকে এগিয়ে নিতে পারলেই কেবল গণস্বার্থ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতে পারে।

[লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)]
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদিকে গুলি করলো কে?

লিখেছেন নতুন নকিব, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:২৬

হাদিকে গুলি করলো কে?

ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা ৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজপথের অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলিবিদ্ধ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জীবনের চেয়ে তরকারিতে আলুর সংখ্যা গণনা বেশি জরুরি !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:১৭


বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশবাসী একটা নতুন শব্দ শিখেছে: রুট ভেজিটেবল ডিপ্লোম্যাসি। জুলাই আন্দোলনের পর যখন সবাই ভাবছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইতিহাসের সেরা ম‍্যাটিকুলাস ডিজাইনের নির্বাচনের কর্মযজ্ঞ চলছে। দলে দলে সব সন্ত্রাসীরা যোগদান করুন‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৪:৪৪



বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ব নিকৃষ্ট দখলদার দেশ পরিচালনা করছে । ২০২৪-এর পর যারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী দিয়ে দেশ পরিচালনা করছে । তাদের প্রত‍্যেকের বিচার হবে এই বাংলার মাটিতে। আর শুধুমাত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির হত্যাচেষ্টা: কার রাজনৈতিক ফায়দা সবচেয়ে বেশি?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১৮


হাদির হত্যাচেষ্টা আমাদের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে একটি অশনি সংকেত। জুলাই ২০২৪ আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের দ্বিধাবিভক্ত সমাজে যখন নানামুখী চক্রান্ত এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অন্তর্কলহে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আয়-উন্নতির গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×