মায়ের মত মাটির কাছেও আমরা ঋণীঃ
মানুষ মাত্রই মায়ের কাছে ঋণী। কস্মিনকালেও কেউ মায়ের ঋণ শোধ করতে পারে না। সে মায়ের জন্য এ জীবনে যত কিছুই করুক না কেন। চাই সাত পাহাড় ডিঙ্গিয়ে মায়ের কাঙিক্ষত বস্তু এনে, সাগরের তল থেকে মুক্তা খুঁজে এনে মাকে দিয়ে কিংবা মাকে একটা টুকরিতে বসিয়ে মাথায় করে শত শহর চষে বেড়িয়ে মায়ের মনের সাধ মিটালেও মায়ের ঋণ শোধ করা যায় না। যে মা নয়-দশ মাস গর্ভে ধারণ করে সন্তানের জন্য সীমাহীন কষ্টকে আপন করে নেয়, দুই বছর বুকের দুধ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে, হাজার ঘাত-প্রতিঘাতের মাঝেও আঁকড়ে ধরে রাখেন আপন সন্তানকে, দিনে দিনে বেড়ে উঠার সকল যত্ন নেয়, সে মায়ের ঋণ কি কখনো শোধ করা যায়? গর্ভাবস্থায় মায়ের পেটে আর একটি মানব সন্তান তৈরি হয় অর্থাৎ"মানুষ থেকে মানুষ তৈরি" ব্যাপারটা খুব সহজ নয়। সন্তানের ভাল-মন্দের জন্য "মায়ের মন" সর্বদা উতলা থাকে। অসুখে-বিসুখে সেবা-যত্ন এবং শিয়রে বসে রাতের পর রাত জাগা মায়ের তুলনা কি কারো সাথে চলে? আমরা ঋণী মায়ের কাছে, চিরদিন ঋণী।
শিশুকাল পেরিয়ে কিশোর জীবনে এলে, মায়ের প্রতি আমাদের দায়িত্ব-সচেতনতা জাগে। আমরা চোখের সামনে দেখি আমাদের অনুজদের সেবা-যত্ন ও পরিচর্যা দিয়ে মা কিভাবে ওদের গড়ে তুলছেন, আর দিনে দিনে নিজেকে নিঃশেষ করছেন মা-মাকড়সার মত। মা আমাদের জন্মদাত্রী-জননী, জীবনের প্রথম অবলম্বন। মা আমাদের ধরনীর আলো প্রদর্শনকারিণী, পরম মমতার খনি। মা আমাদের অনন্যা সেবিকা। আর এ বোধোদয় থেকে আমরা দৈনন্দিন জীবনে মায়ের সেবা-যত্ন শুরু করি। হোক তা পারিবারিক কাজ বা মায়ের ব্যক্তিগত। মায়ের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি আমরা দিন দিন সজাগ হই। আমাদের যৌবনকালে কালের চক্রে কিংবা প্রয়োজনের তাগিদে মায়ের অনেক দায়িত্বই আমাদের গ্রহণ করতে হয়। মা অসুখী থাকুন তা কোনো সৎ-সন্তানের কাম্য হতে পারে না।
মায়ের মত জন্মভূমির মাটির কাছেও আমরা চিরদিন ঋণী। মাতৃগর্ভের সময় উত্তীর্ণ হবার সাথে সাথে আমরা এ মাটিরই কোলে আশ্রয় নিয়েছি। এ মাটির কোলে দিনে দিনে বেড়ে উঠেছি চন্দ্রকলার মত। এ মাটির ধূলো-বালিতে খেলা করে আমরা বড় হয়েছি। এর মুক্ত বায়ুতে নিঃশ্বাসের বিনিময়ে প্রশ্বাস ছেড়ে আমরা বেঁচে আছি দীর্ঘদিন ধরে। আমাদের শিশুকাল, কৈশোর-জীবন, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব আর বৃদ্ধকালের আশ্রয়দাতা আমাদের এ মাটি-আপন ভূ-খন্ডের মাটি। যেদিন আমরা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করব এ মাটিই আমাদেরকে সাদরে তার কোলে আশ্রয় দিয়ে ধরে রাখবে-সেই শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত, অনন্তকাল অবধি। মাতৃভূমির মাটিতে যেসব শস্যকণা, গম-চাল, ফল-মূল জন্মে তা আমাদের জীবন বাঁচায়। পুকুর, নদী, সাগর ও মাটির ভূ-গর্ভস্থ পানি আমাদের জীবন রক্ষা করে। এর মুক্ত বাতাস এবং গাছ-গাছালি আমাদের সুস্বাস্থ্য দান করে। এ মাটির বুকে আমরা ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মন্দির, গীর্জা ইত্যাদি তৈরি করে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন কাটাই। আপন মাতৃভূমির মাটিতে যখন স্বাধীন দেশের পতাকা উড়াই, তখন গর্বে বুক ফুলে ওঠে। এ মাটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বিস্ময়ভরা সবুজ-শ্যামলিমায় এ দেশের কোন সন্তানেরইবা হৃদয়-মন পুলকিত হয় না বা আত্মগর্বে বুক স্ফীত হয়ে ওঠে না? আরও হাজার হাজার কারণে আমরা ঋণী মাতৃভূমির মাটির কাছে। আমরা যত বড়ই দেশপ্রেমিক হই না কেন মাটি ও মাতৃভূমির ঋণ শোধ করা আমাদের সাধ্যাতীত।
আপন দেশের মাটির প্রতি, মাতৃভূমির প্রতি, এর চিহ্নিত ভূখন্ডের প্রতি আমাদেরও অনেক দায়িত্ব আছে। প্রথমত, আমাদের মাঝে থাকতে হবে গভীর দেশপ্রেম। দেশের মঙ্গলের জন্য থাকতে হবে আত্মত্যাগী মনোভাব। দেশকে সুরক্ষার দায়িত্ব পালন করতে হবে প্রতিটি নাগরিককে। কোনো বৈদেশিক শক্তি আমাদের স্বাধীন দেশের স্বাধীনতার মান-সম্মানে আঘাত করলে, সার্বভৌমত্বের হুমকি হয়ে দেখা দিলে তা প্রতিহত করতে হবে। আপন মাটিকে রাখতে হবে রাহুমুক্ত, সার্বভৌমত্বের সুরক্ষা করতে হবে। মায়ের অসুখ হলে আমরা যেমন সহ্য করে থাকতে পারি না, মায়ের ইজ্জতের উপর আঘাত এলে আমরা যেমন দাঁড়িয়ে তামাশা দেখতে পারি না, তেমনি মাতৃভূমি অসুস্থ হয়ে পড়লে, এর পরিবেশ নষ্ট হলে, জুলুম-অত্যাচার, অবিচার বেড়ে গেলে কিংবা রাজকোষ লুক্তিত হলে, জালিমদের স্পর্ধার মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে। এ মাটির সন্তান কেমন করে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখতে পারে?
নিজেদের ত্যাগের বিনিময়ে যেভাবে আমরা মায়ের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ হই, অনুরূপভাবে দেশের মাটির প্রতিও আমাদের হতে হবে ত্যাগী, কর্তব্যপরায়ণ। সঠিক সময়ে যথাযথ দায়িত্ব ও ভূমিকা পালন করে প্রকৃত দেশপ্রেমের পরিচয় রাখতে হবে। তবেই হয়ত মাটির কাছে আমাদের ঋণের ভার একটু হালকা হতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১১:৪৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



