somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

জুল ভার্ন
এপিটাফ এক নিঃশব্দ প্রচ্ছদে ঢাকা আছে আমার জীবনের উপন্যাস...খুঁজে নিও আমার অবর্তমানে...কোনো এক বর্তমানের মায়াবী রূপকথায়।আমার অদক্ষ কলমে...যদি পারো ভালোবেসো তাকে...ভালোবেসো সেই অদক্ষ প্রচেষ্টা কে,যে অকারণে লিখেছিল মানবশ্রাবণের ধারা....অঝোর

শ্রদ্ধা ভালোবাসায় লতা মঙ্গেশকর......

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ বিকাল ৫:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শ্রদ্ধা ভালোবাসায় লতা মঙ্গেশকর......

আমি লতা মঙ্গেশকরের গান যেমন পছন্দ করি তেমনি ওনার ধর্মীয় মূল্যবোধ, সকলের প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা এবং বিনয়ী তথা তাঁর জীবন চারিতাকে সম্মান করি। আমার অন্যতম প্রিয় শিল্পীর মৃত্যুতে শোকাভিভূতও। কিন্তু ওনার মৃত্যুতে আমাদের দেশের কতিপয় শিল্পী কুশলী ভক্তের মতো "নিজেকে মাতৃহারা" মনে করিনা।

একই সাথে আমি লতা মঙ্গেশকরকে "লতাজি" সম্বোধন করিনা। ভারতীয়রা ওদের দেশে ওনাকে সম্মান করে নামের শেষে 'জি' লাগায়(লতাজি)- সেটা ওদের দেশীয় সংস্কৃতি। আমরা ভালোবেসে, সম্মান করে শ্রদ্ধেয় বোন, দিদি, আপা, ফুফু কিম্বা খালা বলতে পারি। আমার অবাক লাগে, কৌতুকবোধ করি যখন দেখি আমাদের দেশের কতিপয় শিল্পী কুশলী ভক্ত "লতাজি লতাজি" বলে কান্নাকাটি করছে!
****************************************

লতা সম্পর্কে কিছু লেখার যোগ্যতা আমার নাই। তাই লতা মঙ্গেশকর সম্পর্কে আমার প্রিয় শিল্পী মান্না দে'র আত্মজীবনী থেকে কিছু অংশ আপনাদের সাথে শেয়ার করছিঃ-

'লতা মঙ্গেশকরের কথা বলে শেষ করতে পারব না। লতার সঙ্গে প্রথম আলাপ হওয়ার দিনটা আমার খুব মনে আছে। তখন অনিলদা মানে অনিল বিশ্বাস' জোয়ার ভাঁটা' ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার কাজ করছেন। একদিন আমার একটু দরকারে স্টুডিওতে গিয়েছিলাম অনিলদার সঙ্গে দেখা করতে। সেখানে গিয়েই প্রথম লতাকে দেখেছিলাম। তবে দেখেছিলাম বললে একটু ভুলই বলা হবে, আসলে সেভাবে আমি লক্ষ্যই করিনি। অনিলদাই ওর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেন। তারপর আমাকে শোনানোর জন্য অনিলদা ওকে একটা গান গাইতে বললেন। ওই কালো, রোগা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আমি খুব একটা উৎসাহীত হইনি। কিন্তু যে মূহুর্তে ও খালি গলায় গান ধরল, ওর গলার সুর আর সুর লাগানোর ধরন দেখে আমার শরীরের ভেতর দিয়ে যেন একটা বিদ্যুত শিহরণ খেলে গেল। আমি বিস্ময়াভিভূত হলাম ওর গান শুনে, ওর গানের সুরে আমি অবশ হয়ে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম এ কী শুনছি আমি! এ তো সাক্ষাৎ দেবী সরস্বতী ভর করেছেন ওর গলায়।

গান শেষ করার কিছু পরে লতা চলে গেল। তখন অনিলদা আমায় বললেন, 'কেমন শুনলি মানা?'
আমি উত্তর দেব কী, শুধু কোনওমতে আবেশ কাটিয়ে বললাম, 'এ যে অপূর্ব!'
অনিলদা বললেন - "সত্যিই অপূর্ব। দেখবি, এই লতা একদিন ওর গানে সারা পৃথিবীকে ভাসিয়ে দেবে।"

সত্যিই তাই। লতা যখন গাইতে শুরু করেছে সে সময় ছায়াছবিতে স্ত্রী চরিত্রে গান করতেন, রাজকুমারী, পারুল ঘোষ, জোহরাবাঈ আম্বালেওয়ালী, আমিন ভাই কর্ণাটকি, নূরজাহান প্রমুখেরা। এই পারুল ঘোষ ছিলেন বিখ্যাত বাঁশিবাদক পান্নালাল ঘোষের স্ত্রী। লতার গান যত বাড়তে লাগল, আস্তে আস্তে এঁরা স্মৃতির আড়ালে চলে যেতে লাগলেন। নূরজাহান অবশ্য পাকাপাকিভাবে পাকিস্তানে চলে যান। যাঁরা আস্তে আস্তে লাইম লাইটের বাইরে চলে যেতে লাগলেন- তাঁরা নানাভাবে লতাকে হেয় প্রমাণ করার চেষ্টাও করেছেন। আমি তখন হিন্দি ছবির প্লেব্যাক আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি ছিলাম। আমার কাছে তাঁরা নানা ব্যাপারে কমপ্লেন করতেন। কিন্তু আমি বুঝেছিলাম, এইসব কমপ্লেন শুধুমাত্র লতার ওপর হিংসে করেই করছেন। তাই পাত্তাই দিতাম না সে সবে।
লতার নামে অনেক শিল্পী পরেও অভিযোগ করেছেন যে, লতার জন্যই নাকি তাঁরা ঠিকমতো গানের কেরিয়ারে সাফল্য পাননি। আমার মনে হয় এইসব নেহাতই রটনা। লতা তার নিজস্ব যোগ্যতার জোরেই সঙ্গীত সাম্রাজ্ঞীর আসন অধিকার করে আছে আজ পঞ্চাশ বছরেরও ওপর। ওর গলার সুর লাগানোর পদ্ধতি, গলার বৈচিত্র্য, গানের প্রতি নিষ্ঠা- এ তো অন্য কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়। ও রকম কোটিতে একটা হয় কিনা সন্দেহ।

লতার সাথে ঘনিষ্ঠতা হওয়ার পর দেখেছি- লতা রোজ পুজোর ঘরে অনেকটা সময় কাটায়। লতা স্বামী বিবেকানন্দের খুব ভক্ত। নিজে খুব বিনয়ী, নিরহঙ্কারী। যোগ্য ব্যক্তিকে সম্মান দিতে জানে। ওকে যখন শান্তিনিকেতনে দেশিকোত্তম সম্মান দেওয়া হয়- তখন মঞ্চে বসে থাকা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখতে পেয়েই আগে গিয়ে প্রণাম করেছিল। এছাড়াবিনয়ী লতাকে কোনও ব্যাপারে প্রশংসা করলেই ও বলত, 'মান্নাদা, আপনিও আমার প্রশংসা শুরু করে দিলেন! এবার দয়া করে থামুন।' লতা মাঝে মাঝে দারুণ সব জোকস বলত।

তবে আমার মনে হয়, লতাকে শুধু একজন সঙ্গীত শিল্পী বললে- একটু কমই বলা হয়। লতা হচ্ছে গানের একটা টোটাল ইনস্টিটিউশন। লতা নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান। ওর গানের সঙ্গে পৃথিবীর আর কোন গানেরই তুলনা চলে না। লতা প্রত্যেক ভারতবাসীরই গর্বের সম্পদ। আমার মনে হয়, সত্যজিৎবাবুর মতো লতাকেও ভারতরত্ন পুরস্কারে সম্মানিত করা উচিত সরকারের।

লতা একবার আমায় বলেছিল যে, আমার সঙ্গে ওর ডুয়েট গানের সংখ্যা একশো সত্তরটা। আমি জানি না, আমি এসব হিসেব টিসেব কিছুই রাখিনা। যখন গান গেয়েছি, মন প্রাণ দিয়ে গানই শুধু গেয়েছি। তখন তো আর কোনও লিস্ট রাখিনি। তখন কত গানই যে গেয়েছি- হিন্দি, বাংলা তো বটেই মারাঠি, গুজরাটি, ভোজপুরি, অসমিয়া, ওড়িয়া থেকে আরম্ভ করে তামিল, তেলেগু, মালায়ালাম ভাষায়। এখন গানের কথা বা সংখ্যা কেউ জানতে চাইলে কোনও কিছুই আর মনে রাখতে পারিনা। মারাঠি গানের উচ্চারণ শুনে লতাই একবার বলেছিল যে, আমি একজন মারাঠি সদাচারি ব্রাহ্মণের চেয়েও ভাল মারাঠি উচ্চারণ করতে পারি।

লতা মঙ্গেশকর যখন গান গাওয়ার জন্য প্রথম স্টুডিওতে আসে- তখন ওর নাম একই থাকলেও সে নামের অন্য কোনো মাহাত্ম্য ছিলনা। খুবই সাধারণ একটা শাড়ি আর হাওয়াই টাইপের একটা খোলা চটি পরে ও প্রথম স্টুডিওতে এসেছিল। কিন্তু বিধাতা ওর জন্য অন্য কিছু লিখে রেখেছিলেন। সেই ভাগ্যকে সম্বল করে নিজের একাগ্র সত্যনিষ্ঠ সাধনায় ও অচিরেই হয়ে উঠল কোকিল কন্ঠী। অসাধারণ ওর গলার পরিধি। যে গান গাইত একেবারে একাত্ম হয়ে গাইত। সিনেমার চরিত্রের প্রয়োজনে ও গলাটাকে যে রকম খুশি, যে কোন বয়সের উপযোগী করে গাইতে পারত।

লতার সঙ্গে প্রথম ডুয়েট গান গেয়েছিলাম সেই ১৯৫১ সালে 'আওয়ারা' ছবিতে। ওই ছবির সেই বিখ্যাত গান- 'তেরে বিনা আগ ইয়ে চাঁদনি' তো এখনও সমানভাবে জনপ্রিয়। আর শঙ্কর জয়কিষণের সুরে এই গান গেয়েই তো আমারও রোমান্টিক গানের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল। তারপর সেই 'অমর ভূপালি' থেকে শুরু করে হাল আমলের এই 'পুষ্পাঞ্জলি' ছবি অবধি ওর সঙ্গে অনেক গানই দ্বৈত কন্ঠে গেয়েছি। বাংলা ছায়াছবিতেও 'শঙ্খবেলা' ছবির 'কে প্রথম কাছে এসেছি' দিয়ে শুরু হয়েছিল ওর সঙ্গে আমার ডুয়েট গান গাওয়া।

লতার বাবা দীননাথ মঙ্গেশকরও ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ মানুষ। ওঁদের পেডার রোডের বাড়ি 'প্রভুকুঞ্জ' এও আমার সেই প্রথম থেকেই যাতায়াত ছিল। লতার মা এবং বাবা দুজনেই আমায় খুব ভালবাসতেন, স্নেহ করতেন। আমাকে মাঈ বলেছিলেন, তুমি প্রত্যেক সপ্তাহে আমাদের বাড়ি আসবে। লতা মাঝে মাঝে আমাকে একটা কথা বলত, এখন সেটা খুবই মনে পড়ছে। ও বলত, 'দক্ষ কনে সাজিয়েরা যেমন বিয়ের সময় একটা অতি সাধারণ মেয়েকেও সাজিয়ে গুজিয়ে সুন্দর করে তোলে তুমিও সেইরকম যে কোন সঙ্গীত পরিচালকের যে কোন সুরকে সাজিয়ে গুজিয়ে নিজের মতো করে গেয়ে একেবারে সুপারহিট করে দিতে পারো।"

* জীবনের জলসাঘরে (মান্নাদের অাত্মজীবনী)।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১১:৪৯
৮টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গৃহবধূ থেকে প্রধানমন্ত্রী; অভিভাবক শূন্য হলো বাংলাদেশ |

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:১২


খালেদা জিয়া। ইস্পাতসম বজ্রকঠিন দেশপ্রেমের নাম খালেদা জিয়া। যিনি ভালো বেসেছেন দেশকে, নিজের জীবনের চেয়েও দেশকে ভালো বেসেছেন। দেশের বাহিরে যার নেই কোন লুকানো সম্পদ। নেই বাড়ি, গাড়ি অথবা... ...বাকিটুকু পড়ুন

২০২৫ সালের সেরা মশকরা কোনটি

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১৪



ইয়ে মানে বছর শেষ। ২০২৫ সাল বিদায় নিচ্ছে । তা আপনার কাছে ২০২৫ সালের সেরা মশকরা কোনটি ?


আমার কাছে সেরা মশকরা হচ্ছে- এনসিপির জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা করা।

আরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বেগম খালেদা জিয়াঃ এক দৃঢ়চেতা, সাহসী অধ্যায়ের সমাপ্তি

লিখেছেন সামহোয়্যারইন ব্লগ টিম, ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:৩৭



প্রিয় ব্লগার,
আমরা অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বেগম খালেদা জিয়া আর আমাদের মাঝে নেই, ইন্না লিল্লাহি ওয়া... ...বাকিটুকু পড়ুন

খালেদা জিয়ার মৃত্যু রাজনীতির মাঠে বিরাট শূন্যতা

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১৯

 
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়া এক উল্লেখযোগ্য চরিত্র। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর বিএনপির টালমাটাল পরিস্থিতিতে তিনি দলটির হাল ধরেন। সেনানিবাসে গড়ে উঠা দলটাকে রাজপথে বেড়ে উঠতে গৃহবধূ থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খালেদা জিয়া মরিয়া প্রমাণ করিলেন , তিনি মরেন নাই ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:৩৮


বেগম খালেদা জিয়া মারা গেছেন। এই খবরে জাতি শোকাহত। কিন্তু একদল মানুষ আছে যারা উনার মৃত্যুর পরেও নিজেদের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থে তার মৃত্যু নিয়ে ঘৃণ্য মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। বদনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×