দুই দৃষ্টিতে মৃত সাগর.....
ইতিহাসখ্যাত ‘মৃত সাগর’। ইংরেজিতে বলা হয় ‘ডেড সি’ (Dead Sea) এবং আরবদের কাছে তা ‘বাহরুল মায়্যিত’ নামে পরিচিত। জর্দান নদীর সঙ্গে সংযুক্ত হলেও এটি মূলত একটি হ্রদ। ডেড সি বা মৃত সাগরের দৈর্ঘ্য ৬৭ কিলোমিটার, প্রস্থ ১৮ কিলোমিটার আর গভীরতা ১.২৪০ ফুট। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪২২ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এ সাগরের পশ্চিমে রয়েছে ইসরায়েল ও পূর্বে জর্দান। এখান থেকে পবিত্র জেরুজালেম নগরীর দূরত্ব মাত্র ১৫ মাইল।
মৃত সাগর নানা বিচিত্র খনিজ পদার্থে ভরপুর। এতে প্রচুর পরিমাণে পটাসিয়াম, সালফার, ব্রোমাইন ও কলগেন রয়েছে। মৃত সাগরের পানিতে ম্যাগনেশিয়াম ক্লোরাইড (MgCl2) ও সোডিয়াম ক্লোরাইডের (NaCl) পরিমাণ যথাক্রমে ৫০.৮ ও ৩০.৪ শতাংশ। এ সাগরের পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ ৩৩.৭ শতাংশ। পৃথিবীর অন্যান্য সাগর ও মহাসাগরের তুলনায় লবণাক্ততা বেশি হওয়ায় মৃত সাগরে কোনো মাছ জন্মায় না। জর্দান নদী থেকে মাছ এই নদীতে আসার সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। তবে আশ্চর্যজনকভাবে রয়েছে বিপুল ব্যাকটেরিয়া (Microbe) এবং ক্ষুদ্রকায় ছত্রাক (Encyclopadia Encarta, Chapter-Dead Sea)।
ধর্মীয় দৃষ্টিতেঃ-----
পবিত্র কোরআন ও হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী সমকামিতার মতো জঘন্য পাপ ও অপরাধে লিপ্ত হওয়ার কারণে সডম ও গোমাররাহ নামের লোকালয় মহান আল্লাহর হুকুমে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। ঘটনাটি আজ থেকে প্রায় ছয় হাজার বছর আগের। ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থানটি বর্তমানে মৃত সাগর নামে পরিচিত। আল্লাহর নবী হজরত লুত (আ.)-এর বারবার সাবধান বাণী সত্ত্বেও সে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী অবৈধ যৌন সম্পর্ক ও সমকামিতার অভ্যাস পরিত্যাগ করেনি। পৃথিবীর বুকে একমাত্র তারাই যৌন ক্ষুধা চরিতার্থের উদ্দেশ্যে মহিলাদের বাদ দিয়ে পুরুষদের ওপর উপগত হতো। কোরআনুল কারিমে অত্যন্ত চমৎকারভাবে এই ঘটনা বিধৃত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি লুতকে পাঠিয়েছিলাম। তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, তোমরা এমন কুকর্ম করছ, যা তোমাদের আগে বিশ্বে কেউ করেনি। তোমরা তো কামতৃপ্তির জন্য নারী ছেড়ে পুরুষের কাছে গমন করো, তোমরা সীমা লঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৮০-৮১)
ফলে শাস্তি হিসেবে আল্লাহ তাআলা এ জনপদের চার লাখ মানুষকে বাস্তুভিটাসহ বিধ্বস্ত করে দেন। বর্তমান বিশ্বের খ্যাতনামা ইসলামী স্কলার মুফতি তাকি উসমানি মৃত সাগর পরিদর্শনের পর লেখেন, ‘আমেরিকার বিজ্ঞানীরা সমুদ্রের তলদেশে খননকার্য চালিয়ে মানুষের ব্যবহার্য পাথরের ঘটি, বাটি, চামচ উদ্ধার করেন। বিভিন্ন দেশ থেকে শত শত পর্যটক প্রতিদিন মৃত সাগর দেখার জন্য আসে এবং শিক্ষা গ্রহণ না করে বিনোদন ও ফুর্তিতে মেতে ওঠে।’ (মুফতি তাকি উসমানি, জাহানে দিদাহ, মৃত সাগর অধ্যায়)
অবৈধ যৌনমিলন, অনৈতিক যৌন সম্পর্ক ও সমকামিতার মতো অমানবিক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার জন্য আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে হুঁশিয়ার করেছেন। মানবগোষ্ঠীকে অশ্লীলতা, ব্যভিচার ও সমকামিতা থেকে বিরত থাকার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কঠোর নির্দেশ প্রদান করেছেন। মহানবী (সা.) কিশোর-বালকদের চেহারার দিকে কুদৃষ্টিতে না দেখার নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ তাদের চেহারায় বেহেশতের হুরের দীপ্তি আছে। তিনি বলেন, ‘আমার উম্মতের ব্যাপারে যেটা সবচেয়ে বেশি ভয় করি, তা হলো লুত সম্প্রদায়ের অনুরূপ পাপাচার। আমার উম্মতের কিছু লোক লুত জাতির অপকর্মে লিপ্ত হবে। যখন এরূপ হতে দেখবে তখন তাদের ওপরও অনুরূপ আজাব অবতরণের অপেক্ষা কোরো।’
লুত সম্প্রদায়ের মতো যারা সমকামিতায় লিপ্ত হবে, তাদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, জিনা, ব্যভিচার, সমকামিতা ও মাদক গ্রহণের মতো ঘৃণিত ও অশ্লীল কাজের ধারেকাছেও না যাওয়ার জন্য ইসলামের রয়েছে কঠোর হুঁশিয়ারি। পাপাচার শুধু নিষিদ্ধ করা হয়নি, বরং যেসব বিষয় ব্যভিচারের দিকে প্রলুব্ধ করে, তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় ইসলাম ধর্মে এগুলো গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। অপরাধ যেমন ঘৃণ্য, শাস্তিও তদ্রূপ কঠিন ও কঠোর। (তাফসিরে মা’আরেফুল কোরআন, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা ৮০৬; মাওলানা হাকিম আখতার (রহ.), রুহ কি বিমারিয়াঁ, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা ১৯)
অনৈতিক যৌন সম্পর্ক ও সমকামিতার শাস্তিস্বরূপ সাম্প্রতিককালে দেখা দিয়েছে এইডস বা এইচআইভি। ‘এইডস’ মানে নিশ্চিত মৃত্যু। আজ পর্যন্ত এর কোনো কার্যকর ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। ২০১৭ সাল পর্যন্ত এইডসে আক্রান্ত হয়ে তিন কোটি ৫০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়েছে তিন কোটি ৭০ লাখ মানুষ। বাংলাদেশে এইডস রোগী শনাক্ত হয়েছে সর্বপ্রথম ১৯৮৯ সালে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে এইডসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১১ হাজার ৭০০। এর মধ্যে মারা গেছে এক হাজার ২২ জন। প্রায় ছয় হাজার ৪৫৫ ব্যক্তি এইচআইভির জীবাণু বহন করছে। এইচআইভি সংক্রমণের প্রধান কারণ হচ্ছে অবৈধ যৌনমিলন ও সমকামিতা।
আল্লাহর এই শাস্তির হাত থেকে বাঁচার পথ হলো একনিষ্ঠ মনে তাওবা করা, তাকওয়া অর্জন, নফল রোজা পালন ও আল্লাহর ওলিদের সান্নিধ্য লাভ করা। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) বলেন, কোনো জাতির মধ্যে যদি অবৈধ ও বিকৃত যৌনাচারের প্রকোপ বৃদ্ধি পায় তখন আল্লাহ তাআলা লুত সম্প্রদায়ের মতো বা এর চেয়ে আরো ভয়াবহ শাস্তি প্রদান করেন।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতেঃ------
প্রায় তিন মিলিয়ন বছর পূর্বে বর্তমান জর্দান নদী, মৃত সাগর এবং ওয়াদি আরাবাহ অঞ্চল লোহিত সাগর এর পানিতে বারবার প্লাবিত হত। এর ফলে একটি সরু উপসাগরের সৃষ্টি হয় । উপসাগরটি জেজরিল উপত্যকায় একটি সরু সংযোগের মাধ্যমে লোহিত সাগরের সঙ্গে যুক্ত ছিল। প্রাকৃতিক তত্ত্ব অনুযায়ী প্রায় ২ মিলিয়ন বছর পূর্বে উপত্যকা এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যবর্তী স্থলভাগ যথেষ্ট উচ্চতা লাভ করে। ফলে মহাসাগরের প্লাবনে এই অঞ্চলে সৃষ্ট উপসাগরটি পরিবেষ্টিত হয়ে হ্রদে পরিণত হয়।
এই সাগরে কোনো প্রাণী বাস করতে পারে না। কোনো মানুষ চাইলেও এর পানিতে ডুবে যেতে পারবে না। যতই চেষ্টা করবে ডুবে যাওয়ার ভেসেই থাকবে। কারণ, পানির লবনাক্ততা এত বেশি হওয়ার কারণে পানির প্লবতা অনেক বেশি। প্লবতা হচ্ছে বস্তুর উপর প্রযুক্ত পানির উর্ধ্বমুখী বল। কোনো বস্তু পানিতে ডুবানো হলে বস্তুর ওজন নিচের দিকে একটা বল প্রয়োগ করে। পানিও বস্তুকে উপরের দিকে বল প্রয়োগ করে। যদি বস্তুর ওজন বেশি হয় বস্তু ডুবে যায়, আর প্লবতা বেশী হয় তবে বস্তু ভেসে থাকে। কিন্তু মৃত সাগরের পানির প্লবতা এতই বেশি যে বস্তুর ওজন অনেক বেশি হলেও বস্তুকে ডুবানো বেশ কঠিন।
বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মহাসাগরের পানির তুলনায় ডেড সির পানিতে মিশে থাকা খনিজ উপাদানগুলোর পার্থক্য আছে। মৃত সাগরের পানিতে মিশে থাকা লবণে ১৪% ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড, ৪% পটাশিয়াম ক্লোরাইড, ৫০% ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড এবং ৩০% সোডিয়াম ক্লোরাইড রয়েছে। এই পানির ঘনত্ব ১.২৪ কেজি/লিটার। এই সকল উপাদানের কারণে ডেড সি’র পানির প্লবতা শক্তি পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের পানির চেয়ে অনেক বেশি। আর এই উচ্চ প্লবতা শক্তির কারণে এই সাগরে কোনো কিছু ডুবে না। প্রাচীনকাল থেকে এই হ্রদটি মিশরের মমি তৈরির জন্য, সার উৎপাদনের জন্য পটাশসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক খনিজ পদার্থের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এই হ্রদ থেকে প্রাপ্ত লবণ ও খনিজ পদার্থ বিভিন্ন প্রসাধনী ও সুগন্ধি দ্রব্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
ডেড সি’তে কোনো মাছ বাস করতে পারে না। প্রায় একইভাবে এর পাশে জর্ডান নদীতেও কোনো মাছ নেই। এই সাগরের পানিতে কোন উদ্ভিদ বা মাছ বাঁচতে পারে না বলেই মূলত এই সাগরকে ডেড সি বা মৃত সাগর বলা হয়ে থাকে। এই সাগরের পানিতে শুধুমাত্র সামান্য কিছু ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক অণুজীবের সন্ধান পাওয়া যায়। ডেড সি তীরবর্তী পাহাড়ি অঞ্চলে উট, খরগোশ, খেঁকশিয়াল, চিতাবাঘ দেখতে পাওয়া যায়। অতীতে জর্ডান নদীর বদ্বীপ অঞ্চলে প্যাপিরাস এবং পাম গাছে সমৃদ্ধ বনভূমি ছিল। রোমান এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সময় ইক্ষু, সিকামোর এবং হেনা এ অঞ্চলের উদ্ভিদ বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধি এনে দিয়েছিল। জেরিকোতে বেলসাম গাছের রস থেকে প্রস্তুত করা হত উন্নত মানের পারফিউম এবং সুগন্ধি।
বর্তমানে মৃত সাগর অঞ্চলটি চিকিৎসা শাস্ত্রের গবেষণাস্থল হয়ে উঠেছে। এর মূলে রয়েছে হ্রদের পানিতে খনিজ দ্রব্যাদির বিপুল উপস্থিতি, বাতাসে এলার্জি উৎপাদক দ্রব্য এবং পরাগরেণুর স্বল্পতা, উচ্চ ভূ-মণ্ডলীয় চাপ, সৌর বিকিরণে অতি বেগুনি উপাদানের কম উপস্থিতি। উচ্চ বায়ুমণ্ডলীয় চাপ, শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকা রোগীদের জন্য বেশ উপকারী। চর্মরোগ সোরিয়াসিস (psoriasis) এর জন্য দীর্ঘসময় সূর্যস্নান বেশ উপকারী। এ অঞ্চলে অতি বেগুনি রশ্মির স্বল্পতা সূর্যস্নানের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে বেশ সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া রোগটি নিরাময়ে জন্য মৃত সাগরের লবণও বেশ উপকারী বলে বৈজ্ঞানিকদের গবেষণায় দাবী করা হয়েছে।
* (Historical Studies in the Natural Sciences থেকে ভাষান্তর করে তিন বছর আগে ফেসবুকে লিখেছিলাম)
* (ধর্মীয় দৃষ্টিতে মৃত সাগরের তথ্য উপাত্ত নিয়েছি- তাফসিরে মা’আরেফুল কোরআন, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা ৮০৬; মাওলানা হাকিম আখতার (রহ.), রুহ কি বিমারিয়াঁ, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা ১৯)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৫:১০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



