আমি কিছুই হতে পারিনি.....
স্বাধীনতার আগেই বাবা-চাচারা ছাড়াও আমাদের বৃহত্তর পরিবারের অনেকেই প্রতিরক্ষা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বাহিনীতে যোগ দেওয়ার বয়সী শিক্ষিত যারা তাদের প্রায় সবাইর টার্গেট প্রতিরক্ষা বাহিনীর গর্বিত অফিসার হওয়া। স্বাধীনতার পূর্বাপর বৃহত্তর যৌথ পরিবারের ৮ জন ক্যাডেট কলেজের ছাত্র। সকলেরই টার্গেট লেফট রাইট লেফট্... মাঝখান থেকে আমি এইচএসসি তে উঠেই ইচ্ছা প্রকাশ করছি বাংলা সাহিত্যে অনার্স-মাস্টার্স করবো এবং পেশা হিসেবে সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় যুক্ত থাকবো- যা ক্যাডেট কলেজের ছাত্রদের মধ্যে অকল্পনীয় ভবিষ্যৎ পেশা। আমার ফুফাতো ভাই অকাল প্রায়ত কবি আবুল হাসান আমার ধ্যানজ্ঞান। ছড়াকার তপংকর চক্রবর্তী, সেজান মাহামুদ, কবি মাহাবুব কবীর আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু... আমার কবি হবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার মূল অবিভাবক আব্বা/বুবু কেউ নন। বরং আব্বা আমার লেখা গল্প কবিতা পড়ে উৎসাহ দিতেন। একদিন বলেছিলেন, "Most of the people who have done very well in Bengali literature have studied in English literature (for example, many famous poets are named). If you study English literature, you will be able to learn by reading the writings of "রথী মাহারাথী" of world literature. So you can do Honors-Masters in English Literature
"। কিন্তু চাচা, মামারা আমার কবি হওয়ার ঘোর বিরোধী। আমার এক মামা যিনি তখন ঢাকা জেলা দায়রাজজ তিনি আমার হাত থেকে 'জীবনানন্দ দাশের কবিতা সমগ্র' বইটি নিয়ে কফি খেতে খেতে খানিকক্ষণ নাড়া চাড়া করে বলেছিলেন- "মিনিংলেস, ভবিষ্যৎ নেই"! স্পষ্ট মনে আছে আজও।
কলেজে আমি পিটি, ড্রিল, স্পোর্টস, ডিবেট এবং এক্সামে কারোর থেকেই খুব পিছিয়ে ছিলামনা। কিন্তু "মিনিংলেস, ভবিষ্যৎ নেই"-সেই ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎবাণী সারাক্ষণ আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখত। সেই মেলানকলিয়াকে অগ্রাহ্য করার জন্য রোজ ঘাম ঝরাতাম। বাস্কেটবল আর ভলিবল গ্রাউন্ডে সমস্ত বিষাদকে আছড়ে মেরে ফেলতাম। কিন্তু কবিতা গল্প লেখা আমি ছাড়তে পারিনি... রাতে পড়তে বসে হঠাৎ বইপত্র সরিয়ে রেখে রুল টানা খাতায় কবিতা লিখতাম।
তখন পড়েছিলাম নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত 'চিড়িয়াখানা' গল্পটি, যেখানে এক বাংলায় এম. এ. কোথাও চাকরি না পেয়ে চিড়িয়াখানার মৃত বাঘের খাঁচায় বাঘের চামড়া আর মুখোশ পরে দর্শকদের আনন্দ দেবার চাকরি করত। পাশের খাঁচায় থাকত একটি সিংহ। একদিন সে নকল বাঘের হাত কামড়ে ধরে লোহার রডের ফাঁক দিয়ে। বাংলায় এম. এ. মৃত্যুভয়ে চিৎকার করে উঠলে সিংহটি তাকে সতর্ক করে দিয়ে চিৎকার করতে বারণ করে- 'চুপ চুপ! আমিও বাংলার এম.এ."। এসব রসিকতার গল্পও আমাকে নৈরাশ্যের কিনারায় নিয়ে যেত(বাঘ / সিংহের ব্যাপারটা এখন আর মনে নেই। তবে নৈরাশ্যটা আজও ভুলিনি)।
আমাদের বাংলার শিক্ষকও একদিন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, "চাকরির বাজারে বাংলায় এম এ-র স্থান সবার পিছনে।" সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, 'যে ভাষার ভাত দেবার মুরোদ নেই সেই ভাষা নিয়ে আমরা আদিখ্যেতা করছি।' (২১ শে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে)- এসব কথা প্রতিদিন হতাশা বাড়িয়ে দিত গোপনে।
অনেক কিছু চিন্তা না করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক প্রশাসন বিভাগে ভর্তি হলাম। তারপর ৪০-৪৫ বছর কেটে গেল। আমার পরিচিতদের মধ্যে বাংলা সাহিত্যে অনার্স-মাস্টার্স অনেকেই এখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী অধ্যাপক। অনেকেই শিক্ষকতায় খুব সফল রয়েছেন। একদা আমার দুই সহপাঠী দুই ক্যাডেট কলেজের অধ্যক্ষ পদ থেকে এবং তিন সহপাঠী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। দুইজন সচিব পদ থেকে অবসর নিয়ে একজন এখন বিটিআরসি'র চেয়ারম্যান অন্যজন পিএসসি’র চেয়ারম্যান।
আর চারপাশে তাকিয়ে দেখছি, আমাদের প্রথম যৌবনের চাইতে অনেক বেশি সম্ভাবনাময় তরুণ তরুণী এখন কবিতা লিখছে, সাহিত্য সংস্কৃতির পুরোভাগে। তাদের ভাষা-ব্যবহার, ভাবনার গভীরতা, জীবনকে দেখার চোখ প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করে আমাকে। কবিতা বা সাহিত্য নিয়ে, খ্যাতি অথবা খ্যাতিহীনতা নিয়ে আমার আর কোনও নৈরাশ্য নেই। কিন্তু আমার বাংলা সাহিত্যে অনার্স-মাস্টার্স পড়া হয়নি, এমনকি সাহিত্য সংস্কৃতির সেবক হওয়া হয়নি।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ১২:০১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



