ঘোওওল....মাখন.....মাঠায়ায়ায়া.....
আমার ছোট বেলায় আমাদের এলাকায় ২/৩ জন লোক বয়সে প্রায় বৃদ্ধ, ঘোল-মাখন বিক্রি করতেন ফেরি করে। তাঁদের পরনে থাকত ময়লা ধুতি মালকোঁচা দেওয়া কিম্বা ময়লা সাদা লুংগী। খালি পা। কখনো ছেড়া স্যান্ডো গেঞ্জি পরতেন অথবা কখনো খালি গায়ে। তবে দুইজনের শরীরে (বুক-পিঠে) পইতাটা ঠিকই থাকত- অর্থাৎ এরা সনাতন ধর্মাবলম্বী ব্রাম্মন। বড় একটা বাঁশের লাঠির দুই মাথায় দুটি বড় হাঁড়ি দড়ির শিকার মধ্যে ঝুলত। একটা হাঁড়িতে থাকত ঘোল আর অন্যটাতে থাকত পানির মধ্যে ভাসমান মাখনের ছোট ছোট দলা। ঘোলের হাঁড়ির ওপরে অ্যালুমিনিয়ামের থালার ওপরে থাকত দুটি ছোট কাচের গ্লাস। যেটা দিয়ে ঘোল মেপে বিক্রি করতেন।

প্রতিদিন সকালে আমাদের সদর দরজায় এসে হাঁক দিতেন, ‘ঘোল-মাখন, ঘোল-মাখন’। এই ডাক শুনেই চাচা/ চাচী বলতেন, "কে আছো- জগ প্লেট নিয়ে যাও...."।
ঘোল মাখন বিক্রেতা জানতেন- আমাদের বাড়ির জন্য কয় গ্লাস ঘোল মাঠা এবং কতো পিস মাখন দিতে হবে....ঘোল-মাখনওয়ালা হাত দিয়ে তাঁর হাঁড়ি থেকে সব মিলিয়ে ৮/১০ গ্লাস ঘোল মাঠা এবং ১০/১২ টুকরো মাখনের দলা তুলে দিতেন। হাইজিন বলে জিনিসটা তখন কেউ তেমন তোয়াক্কা করত না। সব মিলিয়ে ৪/৫ টাকা দাম হতো। বৃহত্তর যৌথ পরিবারের বয়স্করা সবাই ঘোল মাখন মাঠা খেলেও আমরা ছোটোরা ওগুলো খেতাম না। মাঝেমধ্যে মাখন মুখে দিয়ে বিস্বাদ লাগায় তাও খেতাম না।
ছেলে বেলা থেকেই আমি দুধ খাইনা, মানে খেতে পছন্দ করি না, তবে দুগ্ধ জাত রসগোল্লা আমার খুব প্রিয়। দুধের পায়েস ফিরনীও পছন্দ করি।

ছেলে বেলায় ওয়ারী বড়ো চাচার বাড়িতে এবং লালবাগ ডজ ইন্ডাস্ট্রিতে ছোট ফুফুর বাড়িতে গেলেই সকালে বাধ্যতামূলক ঘোল মাঠা খেতে হতো, যেহেতু আমি দুগ্ধ জাত খাবার খাইনা তাই ছোট ফুফুর বাড়িতে ঘোল মাঠা খাওয়া আমার জন্য বাধ্যতামূলক ছিলো না। অনেক আদি ঢাকাইয়াদের মতো ছোট ফুফুর বাড়িতে 'প্রায় তিন বেলাই' সবাই বিরিয়ানি খায়! ছোট ফুফু জন্মগত ভাবে বরিশালের হলেও বৈবাহিক সূত্রে 'পুরনো ঢাকার ঢাকাইয়া' হয়ে গিয়েছে সেই ৪৭ এর আগে। আমাদের ছোট ছেলেও প্রতিদিনই হয় বিরিয়ানি কিম্বা পোলাও খায়!
সামান্য বেশী লবনাক্ত খাবারও আমার অপছন্দ। মাঠা- ঘোল-মাখনে বেশ কিছু অতিরিক্ত লবণ দেওয়ার কারণে এই খাবারটা আমার অপছন্দের হলেও বড়ো চাচার সামনে না বলার উপায় ছিলো না। নাক-কান-চোখ বন্ধ করে গিলে ফেলতাম।
পূর্ণ ননিযুক্ত দুধ প্রথমে জ্বালিয়ে ঠান্ডা করে দীর্ঘক্ষণ ঘূর্ণন পদ্ধতিতে মাখন আলাদা করে ফেলার পর যে চর্বি ছাড়া জলীয় অংশ রয়ে যায়, তা–ই ঘোল। আমাদের দেশে যার নাম ঘোল ভারতের বিভিন্ন জায়গায় এই পানীয় ঘোল ছাড়াও 'চাস' নামেও পরিচিত। বহু যুগ আগে, বাণিজ্যিক পরিসরে মাখন তৈরির জন্য দুধের ননি ফেলে রাখা হতো প্রাকৃতিকভাবে সামান্য গাঁজিয়ে ফেনিয়ে তোলার জন্য। তারপর কম ননি বিহীন দুধের নামই ঘোল মাঠা। ঘোল হলো মাখন বা পনির উৎপাদনের একটি উপজাত। ঘোলের মাঝে দুধের প্রায় সকল উপাদানই বিদ্যমান।
গত ৩/৪ বছর যাবত পুরনো ঢাকার কোর্ট পাড়ায় যেতে হয় সকাল সাড়ে নয়টার মধ্যে.... ওখানে রাস্তার পাশে ঘোল মাঠা মাখন বিক্রি হয় হরদম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে খাচ্ছে অনেক মানুষ, কেউ কেউ ঘটি/জগে করে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে....খেতে ইচ্ছে করলেও নোংরা পরিবেশনের জন্য খাওয়া হয়নি।
বরিশাল শহরের কেন্দ্রস্থল বিবি পুকুরের উত্তর পাশের পূর্ব-পশ্চিম দিকের রোডের নাম গির্জা মহল্লা। এই রোডের উপর একটা সাদামাটা রেস্টুরেন্টের নাম দই ঘর, যা প্রায় শতবর্ষী। এই রেস্টুরেন্টের মূল আকর্ষন দই-চিড়া। সাথে আছে ঘোল-মাঠা-মাখন। প্রায় শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী রেস্টুরেন্টে নাই কোনো চাকচিক্য, জৌলুশ। কিন্তু আছে উল্লেখ্য খাবারের সুনাম। সেই শুরু থেকে রেস্টুরেন্টে পিতল কাসার তৈজসপত্র ব্যবহার করা হয়। গ্রাহকদের বসার জন্য এখনো লম্বা হাই বেঞ্চ। কোনো চেয়ার টেবিল নাই। দোকান মালিক/ক্যাশিয়ার বসেন তোশকের গতিতে, সামনে একটা ক্যাশবাক্স নিয়ে।
অল্প মিষ্টির দই আমার পছন্দের, সেটা বগুড়ার দই। বগুড়ার আরও একটা স্পেশাল দইয়ের নাম ক্ষীরসা দই, দুধেরসর দিয়ে বানানো- অসাধারণ সুন্দর ঘ্রাণ এবং সুস্বাদু। সম্প্রতি বরিশাল শহরের 'মেহেন্দী গঞ্জ দই ঘর' নামের একটা মিষ্টির দোকানের দই খেয়েছি, খুব ভালো স্বাদের।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১১:৩৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




