২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, বন্ধ হয়ে গেলো প্রায় দেড়শ বছরের ঐতিহ্যবাহী প্যাডেল ষ্টীমার সার্ভিস।
তৎকালীন বৃটিশ সরকার ১৮৭৪ সালে প্রথম বাষ্পীয় প্যাডেল হুইল জাহাজের মাধ্যমে নারায়নগঞ্জ-চাঁদপুর-বরিশাল-ঝালকাঠী-খুলনা নৌপথে রকেট ষ্টীমার চালু করে। স্বাধীনতার পরে উভয় ষ্টীমারই নারায়নগঞ্জের পরিবর্তে ঢাকা থেকে চলাচল শুরু করে। বিগত প্রায় দেড়শ বছর ধরে বরিশাল ও পুরনো ঢকাবাসীর সকালে ঘুম ভাঙ্গতো রাষ্ট্রীয় যাত্রীবাহী রকেট ষ্টীমারের বিকট হুইসেলে। রকেট ষ্টীমারের বিকট হুইসালে বুড়িগঙ্গা তীরের নবাব বাড়ীর লোকজনের অতি প্রত্যুষে ঘুম ভাঙ্গার কারণে বৃটিশ যুগে বরিশাল থেকে বাদামতলী ঘাটে যাত্রীবাহী স্টিমারগুলোর হুইসেল দেয়া নিষিদ্ধ ছিল। ষাটের দশক থেকে সেই নিয়ম প্রত্যাহার হয়। এতদিন বরিশাল নগরবাসীর ঘুম ঠিকই ভেঙ্গে যেতো সরকারী এসব নৌযানের হুইসেলে।
বৃটিশ আমলে থেকে গোয়ালন্দ- নারায়ণগঞ্জ-গোয়ালন্দ ষ্টীমার সার্ভিস চালু ছিলো। তখন কোলকাতা-ঢাকার যাত্রীরা শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেনে রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ স্টেশন নেমে গোয়ালন্দ ঘাট থেকে ষ্টীমারে চাঁদপুর- নারায়ণগঞ্জ ঘাটে নামতো। ১৯৭১ সনে গোয়ালন্দ নারায়ণগঞ্জ ষ্টীমার বন্ধ হয়ে যায়।
প্যাডেল স্টিমার নৌযানের দুপাশে বিশালাকৃতির দুটি হুইল দিয়ে চালানোর জন্য এগুলোকে বলা হতো প্যাডেল ষ্টীমার। প্যাডেল ষ্টীমার সিরিজের প্রথম জাহাজ পি এস মাহ্সুদ ১৯২৮ সালে কলকাতার গার্ডেন রিচ শিপইয়ার্ডে নির্মিত হয়। ১৯২৯ সালে পি এস গাজী ও পি এস আস্ট্রিচ নির্মাণ করা হয়। ১৯৩৮ সালে পিএস লেপচা এবং পাকিস্তান আমলে ১৯৫০ সালে পিএস টার্ন নির্মাণ করা হয়। এসব ষ্টীমার প্রথম দিকে কয়লা থেকে উৎপন্ন বাষ্পে চলত। ১৯৮৩ সালে ডিজেল ইঞ্জিন প্রতিস্থাপন করা হয়। নব্বই দশকে গাজী ষ্টীমার আগুনে পুড়ে যায়। কয়েক বছর আগে টার্ন ও লেপচা সার্ভিস বন্ধ করে দেওয়া হয়। এসব ষ্টীমার এক সময় ঢাকা থেকে খুলনা পর্যন্ত যেত। প্যাডেল ষ্টীমারের দুই পাশে হুইল (পাখা) ঘোরার কারণে বড় ধরনের ঝড়-বৃষ্টিতেও এসব নৌযান ভারসাম্য ধরে রাখতে পারে, তাই ঝড় বৃষ্টিতে কোনো দিন এই জাহাজগুলো দূর্ঘটনা কবলিত হয়নি।
২০১৯ সাল থেকে মোংলা ঘষিয়াখালী চ্যানেলে নাব্যতা সংকটের কারণে খুলনা পর্যন্ত ষ্টীমার যেতে না পারায় বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ পর্যন্ত চলাচল করত। ঢাকা-মোড়েলগঞ্জ যাওয়ার পথে চাঁদপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, কাউখালী, হুলারহাট, চরখালী ও বড় মাছুয়া এবং বাগেরহাটের সন্ন্যাসী ঘাটে থামত। বিভিন্ন সময়ে প্যাডেল ষ্টীমার এ পথে চলাচল করলেও ধীরে ধীরে ষ্টীমারের সংখ্যা কমতে থাকে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে অস্ট্রিচকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অ্যাকর্ড রিসোর্সেসের কাছে ইজারা দেওয়া হয়। এরপর একমাত্র প্যাডেল ষ্টীমার মাহ্সুদ চলাচল করত মাঝেমধ্যে। সর্বশেষ ঢাকা-মোড়েলগঞ্জ-ঢাকা রুটে চলাচলকারী প্যাডেল স্টিমার সার্ভিস বন্ধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)।
চোখের সামনে ভেসে উঠছে কত জাহাজের স্মৃতি - ‘গাজী’, ‘অস্ট্রিচ’, ‘কিউই’, গারো’, ‘মাহসুদ’, ‘মোমেন’, ‘লেপচা’, ‘ইরানী’, ফ্লোরিকান’, ‘ফ্লেমিঙ্গো’ ‘টার্ন’, ‘টিল’, শেলা, লালী এবং আরো কত বড় বড় নৌ-যান। এগুলোর চলতি নাম ছিল ‘ষ্টীমার’।
ব্রিটিশ আমল থেকে প্রায় শতবছর ধরে স্টিমার সার্ভিসে যুক্ত থাকা পাঁচটি প্যাডেল স্টিমার ছিল পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়। ঐতিহ্যবাহী এসব স্টিমারে ভ্রমণ করেছিলেন সদ্য প্রয়াত ব্রিটেনের রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ দম্পতি, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সার্ক দেশগুলোর রাস্ট্রপ্রধানগনসহ বিশ্ববরেণ্য অনেক ব্যক্তিত্ব।
এসব ষ্টীমারের কিছু কিছু চলেছে ‘ঢাকা মেইল’ হিসেবে ঢাকা-বরিশাল পথে। আবার কোন কোনটি বিখ্যাত ‘রকেট সার্ভিস' হিসেবে ঢাকা-খুলনা নৌ-পথে। ‘ঢাকা মেইল’ ঢাকা-বরিশাল যাত্রাপথে সবগুলো ঘাট ধরত। আর ‘রকেট সার্ভিস’ খুলনা-ঢাকা যাত্রাপথে থামত বরিশাল, চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জ আর নারায়নগঞ্জ। বলা বাহুল্য, কৌলীন্যে ‘রকেট’ ছিলো অনন্য। অভিজাত ‘গাজী’, ‘কিউই’ আর ‘অস্ট্রিচ' এর ঐতিহ্য এবং ঐতিহাসিক খানদানী ভাবমূর্তি ছিল।
যাত্রীদের জন্য চার রকমের সীট-বিভাজন ছিল জাহাজগুলোতে। উচ্চবিত্তদের জন্য প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেনী, মধ্যবিত্তদের জন্য ‘ইন্টার ক্লাশ’ আর আম-জনতার জন্য তৃতীয় শ্রেনী- যা মূলত: জাহাজের ডেক। সম্ভ্রান্ত চোখ ধাঁধানো প্রথম শ্রেনী থাকত জাহাজের ডিম্বাকৃতি সামনের দিকে দু’ধারে সাজানো একাধিক কেবিনে, মাঝে প্রথম শ্রেনীর যাত্রীদের খাবার জায়গা, যাকে বলা হতো ‘সেলুন’। সে সেলুনের মাঝে সাদা কাপড় ঢাকা সুদৃশ্য টেবিল চেয়ার। সেলুনের সামনের দিকে দেয়াল ঘিরে মোড়ানো বেঞ্চি বসার জন্য। তার পাশ দিয়ে বাইরে বেরুনোর দরজা, যা দিয়ে বেরুলে প্রথম শ্রেনীর যাত্রীদের বসার ডেক। সেখানে ছিল সোফা আর আরাম কেদারার ছড়াছড়ি ছোট ছোট নীচু ফ্রন্ট /সাইড টেবিল সহ।
চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি অনেক বছর আগে ক্যাডেট কলেজের ছাত্র হিসেবে ছুটিতে ঢাকা-খুলনা কিম্বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে ছুটিতে দলে-বলে ঢাকা-বরিশাল করছি বেশীর ভাগ সময়ে ‘রকেটে’ এবং কদাচিৎ ‘ঢাকা মেইলে’- পাড়ি দিয়েছি দিনে-রাতে।
ছাত্রাবস্থায় আমাদের টিকেট থাকত তৃতীয় শ্রেনীর, কখনো সখনো বড়জোর মধ্যম শ্রেনীর। কিন্তু সদলবলে হুড়মুড় করে আমরা ঢুকে পড়তাম সেলুনে। মালপত্র সব সেলুনের মোড়ানো বেঞ্চিতে রেখে আমরা আস্তনা গাড়তাম সেখানেই। পুরো ব্যাপারটি বেআইনী নি:সন্দেহে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় তরুন ছাত্র হিসেবে একধরনের সস্নেহ প্রশ্রয় পাওয়া যেত সবার কাছ থেকে।
সব জাহাজেই সেলুনে আমাদের একজন ত্রানকর্তা থাকতেন - যেমন, গাজীর ‘মুন্সি’, অস্ট্রিচের 'চাচামিয়া', কিউই তে 'বাটলার চাচা'। সেইলর ইউনিফর্মড সুবেশী তাদের বুকে নেম ট্যাগ থাকলেও সবার কাছে তারা পরিচিত ছিলেন উল্লেখ্য সম্বোধনে। মূলত তারাই সেলুনে আমাদের দন্ডমুন্ডের কর্তা। আমাদের মত অর্বাচীনদের জন্য কতগুলো নিয়ম তারা বেঁধে দিয়েছিলেন - প্রথম শ্রেনীর যাত্রীরা সেলুনে থাকলে আমাদের বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে হবে, তাঁদের খাওয়া-দাওয়া শেষ হলেই তবে আমরা খেতে পাবো, ডেকে আমরা আরাম কেদারায় বসতে পারি, যদি না প্রথম শ্রেনীর যাত্রীরা সেখানে না বসেন, সেলুনে জোড়ে কথা বলা, গোলমাল করা সম্পূর্ন নিষিষ্দ্ধ ইত্যাদি ইত্যাদি।
দু’টো বিশেষ নিয়মও ছিল আমাদের জন্য। এক, টিকেট দেখতে আসলে তার আগেই আমাদের জাহাজের সাধারন জায়গায়(ডেকে) চলে যেতে হবে। দুই, কোন উচ্চপদস্হ সরকারী ভিআইপি যদি প্রথম শ্রেনীতে ভ্রমন করেন, তা’হলে আমরা বহিষ্কৃত হবো।
বেশীর ভাগ সময়ই আমাদের কাটত প্রথম শ্রেনীর ডেকে রেলিং এ ভর দিয়ে সবাই মিলে গল্প করে আর আড্ডা দিয়ে। কাপ কাপ চা উড়ে যেত, সঙ্গে থাকত কেক। সন্ধ্যায় ফিশ কাটলেট। প্রথম শ্রেণীর যাত্রীদের ডিনার শেষে বেশ রাতে আমাদের খাওয়ার ডাক পড়ত - সাদা জুঁই ফুলের মতো ভাত, ধোঁয়া ওঠা সবজি, শুরুয়া সহ সুগন্ধের ছোট মুরগীর মাংস, দুই ধরনের ডাল- ঘন এবং পাতলা। সঙ্গে সুন্দর করে কাটা কাগজী লেবু, কুঁচোনো শশা আর পেঁয়াজ সির্কাসহ। শেষে মধুরেন সমপায়েৎ হতো ‘রকেটের’ সেই বিখ্যাত ‘পুডিং’, যার স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে!
খাওয়া-দাওয়া শেষে আড্ডা আরও ঘন হয়ে বসত। রাত বাড়ত- বন্ধুরা একজন দু’জন করে কুঁকড়ে-মুকড়ে শুয়ে পড়ত সেলুনের মোড়ানো বেঞ্চিতে। জার্নিতে আমার ঘুম পেতো না। আমি ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতাম ডেকে। রেলিংএর কৌচ টেনে নিয়ে রেলিংএ পা তুলে দিয়ে দিতাম রেলিং এ। শরীরটা ছাড়িয়ে দিতাম কেদারায়, তারপর দৃষ্টিটা ছড়িয়ে দিতাম দূরে, বহুদূরে....নীল নীলিমায়।
চারদিক আস্তে আস্তে শব্দ থিতিয়ে আসা শান্ত পরিবেশে চোখে পড়ত- মাথার ওপরের বিশাল তারা-খচিত আকাশ, নীচে প্রমত্তা নদী আর চারদিকের নিকষ কালো অন্ধকার। কালে-ভদ্রে চাঁদনী রাত পাওয়া যেত। অন্ধকারে দূরে দূরে নৌকোর মিটমিটে আলো দেখা যেত, কখনো কখনো সরু সরু জেলে নৌকোগুলো সাঁই করে স্টিমারের পাশ দিয়ে চলে যেত। জেলেদের জলে জাল ফেলার ঝপাং শব্দ শোনা যেত। নৌকা বা অন্যদিক থেকে আসা ছোট ছোট লঞ্চ দেখলেই আমাদের জাহাজটি ভোঁ বাজাত -যেন ধমকে উঠত, ‘এই সর্, সর্’।
নীচের দিকে তাকালেই দেখতাম, জাহাজের আলো পড়েছে নদীর পানিতে। জাহাজের সৃষ্ট ঢেউয়ে সে আলো ঠিকরে তৈরী হয়েছে রুপোলী তরঙ্গ। তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন ঘোর লেগে যেত। মাঝে মাঝে জাহাজের বিশাল সার্চ লাইটের নীলচে-সাদা আলো জ্বলে উঠত। তীব্র আলোর রশ্মি ছড়িয়ে পড়ত সামনের দিকে বহুদূরে। কখনো সখনো সে আলোর থিতু হতো নদীর পাড়ের ভাঙ্গনে। জাহাজের ক্যাপ্টেন সাহেব হয়তো দেখতেন পাড় কতদূরে।
সার্চ লাইটের সে আলো আমাকে এতো আকর্ষন করত যে আমি নেমে আসতাম স্টিমারের একতলায়। চলে যেতাম একেবার জাহাজের সামনে। বসতাম জাহাজের দড়ি বাঁধার কালো লোহার নীচু স্তম্ভে। পানির ঝাপটা এসে ভিজিয়ে দিত- ভ্রুক্ষেপ করতাম না। চোখ ধাঁধানো সার্চ লাইটের অজস্র পোকা উড়ে বেড়াত- ‘মরিবার তরে হয়তো’! জাহাজের ক্যাপ্টেন মাঝে মাঝে সার্চ লাইটের ঘাড় ঘুরিয়ে এ’দিক ও’দিক ফেলতেন - কেন তা তিনিই জানেন। নদীর হাওয়ায় শিরশিরে ঠান্ডার আলামত টের পেতাম। পাশ দিয়ে যেতে যেতে এক বর্ষীয়ান জাহাজ-কর্মী ভেতরে চলে যেতে বলতেন এক মায়াময় মমতায়।
উঠতাম এক সময়ে। আস্তে আস্তে ইঞ্জিন ঘরের দিকে যেতাম। দৈতাকৃতি ইঞ্জিনের চেহারা দেখে আর শব্দ শুনে চমক লাগতো। কয়লা ঘরে দেখতাম খালাসীরা বেলচা ভরে গনগনে আগুনের ভেতর কয়লা ফেলছে। কয়লা ঘরের তীব্র গরমে মনে হতো কেমন করে সেখানে ক’জন মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করে যাচ্ছে - আমি তো ১২ ফুট দূরেও পাঁচ মিনিট দাঁড়াতে পারছিনা। জাহাজের পুরো নীচতলায় মুরগী রান্নার মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যেত। সে গন্ধে চনমন করে উঠতাম। নীচতলায় জাহাজের ঢেউগুলোকে আরো বড়, আরো তীব্র মনে হতো। সেদিকে তাকাতে তাকাতে সিঁড়ি বেয়ে দো’তলায় উঠে যেতাম।
রাতের তৃতীয় প্রহরে দূর থেকে চাঁদপুরের আলো দেখা যেত। সারা জাহাজে একটা সাড়া পড়ে যেত। বাঁধা-ছাঁদা শুরু হয়ে যেত যাঁরা নামবেন। জাহাজ তার ভোঁ বাজানো শুরু করত এবং নদীতে জায়গা করে নিত নৌকা আর লঞ্চের ভিড়ে। অনেকেই ঘুম চোখে এসে দাঁড়াতেন রেলিং এর পাশে - ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে চাইতেন সবকিছু।
এক সময় জাহাজ এসে ভিড়ত চাঁদপুরে। চারদিকে চেঁচামেচি, হৈ চৈ, হাঁকডাক। খালাসীদের চিৎকার শোনা যেত জাহাজ ভিড়ানোর কালে, গালাগালিও চলত প্রায়শ:ই। চাঁদপুর এলেই কোনো না কোনো যাত্রীর কিম্বা যাত্রীদের ব্যাগ, ঘড়ি টান মেরে নদীতে ঝাপিয়ে পড়তো ছিনতাইকারী, যাদেরকে বলা হতো "জাম্পার পার্টি'! জাহাজ ভোঁ বাজাত অনবরত, গোঁ গোঁ করতে করতে ভিড়তে চেষ্টা করত ঘাটে। দুড়দাড় করে কুলিরা উঠে আসত জাহাজে, ধরত মালামাল, তারপর সেই বিখ্যাত দর কষাকষি। দো’তলার রেলিং এ ভর দিয়ে দেখতাম ফল, মাছ আর পারাপারের নৌকো এসে লাগছে জাহাজের গায়ে। মাঝে মাঝে ইলিশের নৌকো এসে ভিড়ত - সদ্য ধরা রুপোলী ইলিশের ছটায় উজ্জ্বল হয়ে উঠত চারদিক।
চারদিক দেখতে দেখতে ভাবতাম, চাঁদপুর ছাড়ালেই দীর্ঘ মেঘনা পাড়ি। ঘড়ির দিকে তাকাতাম। ভোর হতে বেশ বাকী আছে -বরিশাল পৌঁছুতেও। এ সব ভাবতে ভাবতে পা বাড়াতাম দরজা পেরিয়ে সেলুনের ভেতরে।বাকী রাতটা একটু ঘুমানো যাক।
না, আর কখনো এ সব ঘটবে না। কারন, লোকসানের অজুহাতে ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, বন্ধ করে দিয়েছে দেড়শ বছরের ঐতিহ্যবাহী প্যাডেল ষ্টীমার সার্ভিস। বিলুপ্তি ঘটেছে শতাধিকবর্ষের একটি ঐতিহ্যের। মৃত্যু ঘটেছে আমার কৈশোর-যৌবনের একটি অনন্য সাথীর।
ষ্টীমার সার্ভিস নিয়ে ৬ এপ্রিল, ২০০৯ তারিখ এই ব্লগেই একটা পোস্ট লিখেছিলাম। লিংক- Click This Link