somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

জুল ভার্ন
এপিটাফ এক নিঃশব্দ প্রচ্ছদে ঢাকা আছে আমার জীবনের উপন্যাস...খুঁজে নিও আমার অবর্তমানে...কোনো এক বর্তমানের মায়াবী রূপকথায়।আমার অদক্ষ কলমে...যদি পারো ভালোবেসো তাকে...ভালোবেসো সেই অদক্ষ প্রচেষ্টা কে,যে অকারণে লিখেছিল মানবশ্রাবণের ধারা....অঝোর

ভোঁদর দিয়ে মাছ শিকার......

১৯ শে নভেম্বর, ২০২২ সকাল ১০:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভোঁদর দিয়ে মাছ শিকার......

আমাদের দেশে মাছ শিকারের রয়েছে অনেক পদ্ধতি। ছিপ ফেলে বড়শিতে গেঁথে কিংবা বিভিন্ন ধরনের জাল ফেলে। এই দুই পদ্ধতি বেশি প্রচলিত হলেও অঞ্চলভিত্তিক রয়েছে আরো বেশকিছু পদ্ধতি। এর মধ্যে জনপ্রিয় টেটা বা কোঁচ, পলো, ঘূর্ণি। এছাড়াও পৃথিবীর নানা দেশে মাছ ধরার অভিনব সব পন্থা রয়েছে।

পাখি দিয়ে মাছ শিকার করা হয় চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া এবং জাপানে। প্রায় ১৩০০ থেকে ১৫০০ বছর ধরে তারা মাছ শিকারের এই পুরনো প্রথা মেনে আসছে। জাপানে ঐতিহ্যবাহী এই পদ্ধতিকে করমোর‍্যান্ট বা উকাই বলা হয়। আমাদের দেশে কিন্তু একসময় ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার করা হতো। কেতাবি নাম এশীয় উদ্বিড়াল বা ছোটনখী ভোঁদড়। স্থানভেদে ছোট এ প্রাণীটি উদবিলাই, উদ, ধেরে, ধারিয়া ইত্যাদি নামেও পরিচিত। ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার করা বেশ পুরনো ও প্রাকৃতিক পদ্ধতি। প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্য এটি। তবে কালের বিবর্তনে এ পদ্ধতি আজ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।

বাংলাদেশে এক বিলুপ্তপ্রায় মাছ ধরার প্রকরণ- ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার। হারিয়ে যেতে বসা এই ইতিহাসপ্রাচীন কৌশল এখন শুধু বেঁচে আছে বাংলাদেশের খুলনা আর নড়াইলের গোটা দশ-বারো গ্রামে। যারা ভোঁদর দিয়ে মাছ শিকার করে তাদের বলা হয়- মালো জেলে। এই মালো জেলেরাই এই পদ্ধতিতে মাছ শিকারে পারদর্শী। সম্প্রতি বরিশাল থেকে পিরোজপুর-বরগুনা জেলা থেকে ঢাকা ফেরার সময় আমুয়া নামক একটা যায়গায় ভোঁদর দিয়ে মাছ ধরতে দেখলাম। স্থানীয়রা এই মাছ শিকারীদের "ব্যাবাইজ্জা" সম্প্রদায় নামে অভিহিত করে। এরা আজীবন নৌকাতেই ঘর সংসার করে। পেশা মাছ ধরা।


প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বয়স্ক দুটি ভোঁদরকে খুঁটির সাথে দড়িতে বেঁধে ছেড়ে দেওয়া হয়। কমবয়সী একাধিক ভোঁদরগুলো মুক্ত অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হয়। খুঁটিতে বাঁধা ভোঁদরটিকে কেন্দ্র করে মুক্ত ভোঁদরগুলি একটি ত্রিভুজাকৃতি ক্ষেত্র তৈরী করে। জেলেরা নৌকায় বাঁধা জাল নদীতে ফেলে অপেক্ষা করে। লাঠির সঙ্গে এদের শরীর এমনভাবে বাঁধা থাকে, যেন ছুটে হারিয়ে যেতে না পারে। নৌকা নদীর তীরে আসতে থাকে আর ভোঁদড়ের তাড়া খেয়ে মাছগুলো জেলেদের জালে এসে ধরা পড়ে। বয়স্ক ভোঁদর দুটিকে বাঁধা দড়ি ধরে কিছুক্ষণ পর পর টান দিয়ে তাড়া দেওয়া হয়, ফলে এরা মাছের ঝাঁককে জালের দিকে তাড়া করে নিয়ে আসে।

কৈবর্ত, তিয়র এবং মালো- এই তিন জনগোষ্ঠীকে ভাটি বাংলার আদি বাসিন্দা হিসেবে ঐতিহাসিকরা স্বীকার করে নিয়েছেন। এরা সবাই মৎসজীবী। মালোরাই এদের মধ্যে সেরা নৌয়ায়িক(নৌকায় বসে মাছ শিকার করে যারা তাদেরকে নৌয়ায়িক বলা হয়)। তবে এরা শুধু মাছ শিকারেই দক্ষ নয়, যুদ্ধবাজ বীরের জাত হিসেবেও এরা পরিচিত। যে হাতে কৃষ্ণকীর্তনের খোল বাজায়, সেই হাতেই সড়কি, লাঠি তুলে শত্রুর সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়। আদি বাঙালি মারপিটের সময় যে মালকোঁচা মেরে ধুতি এঁটে বাঁধত, তা এসেছে মালোদের নাম থেকেই।


চিত্রা নড়াইল জেলার প্রধান নদী। প্রাক-বর্ষায় এবং শীতকালে মালোরা ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার করে সুন্দরবনের নদীতে, আর বাকি মাসগুলোয় এই নড়াইলের চিত্রা ও আশেপাশের নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে। ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার মানে এই নয় যে- ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরিতে ঢোকা মাসমাইনের স্টাফের মত ভোঁদড়রা মান্থলি টার্গেট মাফিক মুখে করে মাছ ধরে এনে মাঝির পায়ের কাছে জড়ো করবে! মালোদের এই অধীত বিদ্যে তাদের সাতপুরুষের অনুশীলনের ফসল যা প্রাচীনকালে প্রচলন ছিল দক্ষিণের করমন্ডল উপকূলে। কোন সুদূর অতীতে দাক্ষিণাত্যের মাটি ছেড়ে এই জনগোষ্ঠী চলে এসেছিল নিন্মগাঙ্গেয় বঙ্গদেশে।

মালোদের এক বড় উৎসব রাসপূর্ণিমা। সুন্দরবনের দুবলার চরে রাসমেলা বাংলাদেশের খুব জমকালো উৎসব। বৈষ্ণব ঘরানার এই উৎসবে সুন্দরবনের সন্নিহিত গ্রাম গ্রামান্তর থেকে কৃষিজীবী, মৎসজীবী থেকে প্রান্তিক মানুষজন সহ অনেকেই এই একফালি দ্বীপটিতে জড়ো হলেও আসলে এ মেলায় আগে ছিল ভাটি বাংলার 'ঝালো-মালো'দের আধিপত্য। 'ঝালো' এসেছে জেলে/ জালো থেকে, মানে যারা জাল ফেলে তাদের বোঝাতে। এখন মালোরা তো আদিতেই মৎসজীযে, তাহলে তাদের নামের আগে ঝালো জুড়তে হল কেজ? কারণ, গত দুশো-আড়াইশো বছরে মালোদের একটা বড় অংশ জালি থেকে হালিতে (মানে কৃষিজীবী/হালুটি) রূপান্তরিত হয়েছে। জাউল্ল্যা বা জালো (ঝালো) মানে তারাই যারা আদি পেশায় রয়ে গিয়েছে।



আজকের দুবলার চরে রাসপূর্ণিমা এক আদ্যন্ত হিন্দু পার্বন। দেবদেবীর মূর্তি, বর্ণহিন্দু নৈষ্ঠিকতা, ব্রাহ্মণের পৌরোহিত্য- সনাতন ধর্মের নিগড়ে বাঁধা এক উৎসব, কিছু লোকায়ত অভ্যাস সত্ত্বেও। কিন্তু মালোরা কি আদতে হিন্দু? বল্লালসেনের প্রকরণের মাপকাঠি অনুসারে তো নয়ই এমনকি ঐতরেয় ব্রাহ্মণ যে বঙ্গকৌমকে হীন জ্ঞানে (বিতর্ক আছে ) ‘বয়াংসী’ বলে ব্রাত্য করে দিয়েছিল, মালোরা সেই কৌমেরই অংশ। বাগদি, কেওট, তিয়রদের মতো মালোরাও টোটেম উপাসক। যে টোটেম পূজাকে হিন্দুধর্ম অনুমোদন দিয়েছে। মালোদের টোটেম হল গঙ্গানদী। দুবলার চরের রাস পার্বণ আদিতে এই টোটেমেরই অর্চনা।

একসময় বৌদ্ধ তান্ত্রিক ধর্ম নিন্মবঙ্গের অন্ত্যজদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। নিত্যানন্দ মহাপ্রভু বৌদ্ধ বামাচারী ১২০০ নেড়া আর ১৩০০ নেড়িকে গৌরমন্ত্র দিয়ে জাতে তুলে দৃপ্ত ঘোষণা করেন-
নিত্যানন্দ স্বরূপ সে নাম যদি ধরো।
আচন্ডাল যদি আমি বৈষ্ণব না করোঁ।।
জাতিভেদ না করিমু চন্ডাল যবনে।
প্রেমভক্তি দিয়া সভে নাচামু কীর্তনে।।

কার্তিক পূর্নিমার সারা রাত আধো জাগরনে আধো ঘুমে কাটিয়ে জলস্রোতের সীমানা ছুঁয়ে সার বেঁধে বসে নারীরা, তাদের প্রত্যেকের সামনে রাখা থাকে ডাব যার মধ্যে তাদের মনোকামনা পুরে রাখা আছে। সাগরের ঢেউ এসে তাদের কোলে মৃদু ঠেলা দিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় নিয়ে যায় ডাবগুলোকে। এরপর প্রতিক্ষা। যদি ফিরতি ঢেউ আবার সে ডাব ফিরিয়ে দেয় , তবে তার মনোস্কামনা পূর্ণ হবে- নয়তো আবার অপেক্ষা পরের রাসপূর্ণিমা অবধি।

এই নিরুচ্চার প্রতিক্ষা, ডাবের অনুষঙ্গ, গঙ্গার টোটেম, জল আর প্রান্তিক মানুষজনের এক প্রকৃতি পূজারি আদিম বঙ্গকৌমের যুগান্ত লালিত বিশ্বাস মনে পড়ায় যাদের নিত্যানন্দ-চৈতন্য ব্রাহ্মণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে বৈষ্ণব করেছিলেন। টোটেমিক নৃ-গোষ্ঠীকেও নিয়ে এসে ফেলেছিলেন বেদ-ব্রাহ্মণের দ্বারে। তাই ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ -এ প্রথম পরিচয়পর্বে মালো সাধু মালো কিশোরচাঁদকে প্রশ্ন করে- তারা কি কৃষ্ণমন্ত্রী, নাকি শিবমন্ত্রী? নতুন শ্বশুর নাম জিজ্ঞাসা করলে কিশোর জবাব দেয়- ‘শ্রীযুক্ত কিশোরচাঁদ মূল্যব্রাক্ষ্মণ। পিতা শ্রীযুক্ত রামকেশব মূল্যব্রাক্ষ্মণ।'

বিলুপ্তপ্রায় ভোঁদর নামের এই প্রাণীর চামড়ার মূল্য অনেক বেশী হওয়ায় পাচারকারী চক্র ভোঁদর শিকার করে চামড়া বিক্রি করে। নগদ টাকার লোভে জেলেদের অনেকেই চার পাঁচ হাজার টাকা মূল্যে বিক্রি করে দেন ভোঁদর। আবার স্থানীয় মানুষের নানা কুসংস্কার আর অসচেতনতার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে এই প্রাণীটি। পুকুরের মাছ খেয়ে ফেলবে এই ভয়ে অনেকেই লোকালয়ের আশেপাশের ভোঁদর মেরে ফেলে। বর্তমানে বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এ পেশায় জেলেদের টিকিয়ে রাখতে হলে তাদেরকে দিতে হবে সরকারি সহায়তা।

তথ্যসুত্রঃ
(১) 'তিতাস একটি নদীর নাম' অদ্বৈত মল্লবর্মণ,
(২) Book of Traditional Fishing Techniques Around the World.
(ছবিগুলো নিয়েছি গুগল থেকে)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৯
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৩২

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে[

স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, মব-রাজনীতি ও এক ভয়ংকর নীরবতার ইতিহাস
চরম স্বৈরশাসন বা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রেও সাধারণত সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ে আগুন দেওয়ার সাহস কেউ করে না। কারণ ক্ষমতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

=হিংসা যে পুষো মনে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৮


হাদী হাদী করে সবাই- ভালোবাসে হাদীরে,
হিংসায় পুড়ো - কোন গাধা গাধিরে,
জ্বলে পুড়ে ছাই হও, বল হাদী কেডা রে,
হাদী ছিল যোদ্ধা, সাহসী বেডা রে।

কত কও বদনাম, হাদী নাকি জঙ্গি,
ভেংচিয়ে রাগ মুখে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণমাধ্যম আক্রমণ: হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিলেন নূরুল কবীর ও নাহিদ ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:০৫


জুলাই গণঅভ্যুত্থানের রক্তস্নাত পথ পেরিয়ে আমরা যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম, সাম্প্রতিক মব ভায়োলেন্স এবং গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণ সেই স্বপ্নকে এক গভীর সংকটের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। নিউ এজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপিকেই নির্ধারণ করতে হবে তারা কোন পথে হাটবে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:০৫




অতি সাম্প্রতিক সময়ে তারেক রহমানের বক্তব্য ও বিএনপির অন্যান্য নেতাদের বক্তব্যের মধ্যে ইদানীং আওয়ামীসুরের অনুরণন পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিএনপি এখন জামাতের মধ্যে ৭১ এর অপকর্ম খুঁজে পাচ্ছে! বিএনপি যখন জোট... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় আগ্রাসনবিরোধী বিপ্লবীর মৃত্যু নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৩৭



শরিফ ওসমান হাদি। তার হাদির অবশ্য মৃত্যুভয় ছিল না। তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, আলোচনা ও সাক্ষাৎকারে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি অনেকবার তার অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা বলেছেন। আওয়ামী ফ্যাসিবাদ ও ভারতবিরোধী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×