বাংলায় নীলচাষ ও ফরাসি বিপ্লব.....
আমাদের দেশে আমরা যারা নীল চাষ দেখিনি, তাদের কাছে দীনবন্ধু মিত্রের 'নীলদর্পণ'ই নীল চাষের প্রতিচ্ছবি হলেও নীল গাছের অস্তিত্ব এখনো রাজশাহী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন হর্টিকালসেন্টারে দেখা যায়। নীল গাছের পাতা অনেকটাই সজনে পাতার মতো। খুব সুন্দর ফুলে মৃদুমন্দ সুবাস আছে। নীলগাছ হল উষ্ণ ক্রান্তীয় অঞ্চলের এক রকম ঝোপ জাতীয় উদ্ভিদ। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির আমলে বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলে এবং ভারতের বিহার অঞ্চলে নীলচাষ ব্যপক প্রসার লাভ করে। কারণ ইওরোপের বাজারে ভারতীয় নীলের চাহিদা ছিল দীর্ঘ দিন ধরে, দামও ছিল যথেষ্ট ভালো। প্রাচীন কাল থেকেই ভারতে অল্প-বিস্তর নীলচাষ হয়ে এসেছে।
ভারতীয় মশলার মতো ভারতীয় নীল ভেনিসের ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে প্রথমে ইতালিতে ঢুকেছিল ত্রয়োদশ শতকে। ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডে আকাশচুম্বী দামে বিক্রি হত ভারতীয় তথা বাংলার নীল। খরচ কমানোর জন্য বস্ত্র ব্যবসায়ীরা ইওরোপের ঠাণ্ডা অঞ্চলে চাষ হয় এক রকম কম গুণমানের নীলের (woad) ব্যবহার করত, কিন্তু তা গুণে নিম্ন মানের হওয়ায় বাজার পায়নি।
কিন্তু ভারতীয় নীলের চাহিদা বাড়তে থাকায় স্থানীয় চাষীরা রাজার কাছে দরবার করে ভারতীয় নীলের আমদানি বন্ধ করার আর্জি জানায়। প্রচার করা হয় ভারতীয় নীল ব্যবহার করলে জামা-কাপড় দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। জার্মানিতে ভারতীয় নীলকে 'শয়তানের রং' ( Devil's dye) নাম দিয়ে ১৫৭৭ সালে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ১৬০৯ সালে ফ্রান্সের রাজা ৪র্থ হেনরি ঘোষণা করেছিলেন ভারতীয় নীল বিষাক্ত এবং তা ব্যবহার করলে যন্ত্রণাদয়ক চর্মরোগ হয়ে মৃত্যু হতে পারে।
কিন্তু বস্ত্র প্রস্তুতকারকরা বার বার রাজাদের কাছে উল্টো আর্জি জানায়- ভারতীয় নীলের আমদানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে।
ইতিমধ্যে আবিষ্কার হয়েছে আটলান্টিকের অপর পাড়ে নতুন দু'টি মহাদেশ। ইওরোপীয়ানরা ভিড় জমাতে শুরু করেছে সেখানে উপনিবেশ তৈরি করতে। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের আবহাওয়া ভারতের মতো ক্রান্তীয় হওয়ায় ফরাসিরা প্রথম সেন্ট ডোমিনিকে ভারতীয় নীলচাষ শুরু করে সপ্তদশ শতক নাগাদ। তাদের দেখাদেখি পর্তুগিজরা ব্রাজিলে, ইংরেজরা জামাইকাতে এবং স্পেনীয়রা ভেনেজুয়েলায় নীলের চাষ শুরু করে। ফলে ইওরোপের দীর্ঘ দিনের চাহিদা পূরণ হতে থাকে।

নীলচাষের জন্য দরকার ছিল প্রচুর শ্রমিক। পাশাপাশি ঐ অঞ্চলে কফি, তামাক, আখের চাষও বাড়তে থাকে। শ্রমিকের জোগান আসতে থাকে আফ্রিকা থেকে দাসব্যবসায়ীদের মাধ্যমে। ইংলণ্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলে কারখানায় প্রচুর কাপড় তৈরি হতে থাকে তার সাথে বাড়তে থাকে এই নীলের চাহিদা। কিন্তু বাদ সাধল ফরাসি বিপ্লব। ১৭৮৯ সালে যে ফরাসি বিপ্লব হয় তার মূল মন্ত্র ছিল- সাম্য, মৈত্রী এবং স্বাধীনতা। তাছাড়া ১৭৯১ সালে ফরাসি অধিকৃত সেন্ট ডোমিনিকে দাস বিদ্রোহ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বিদ্রোহীরা জমির ফসল পুড়িয়ে দেয়, অনেক প্ল্যান্টারকে হত্যা করে। ভলতেয়ার, রুশোর মন্ত্রে দীক্ষিত ফ্রান্স তাদের উপনিবেশগুলিতে দাসপ্রথা বন্ধ করে এবং ভাটা পড়ে নীল চাষে।
কপাল পোড়ে বাংলার চাষীদের। ইংরেজরা খুব ধূর্ত জাত। আমেরিকার উপনিবেশে দাসপ্রথা থাকলেও ১৭৭৬ সালেই আমেরিকা স্বাধীনতার ঘোষণা করেছে। ইংরেজদের 'নৈতিকতা'বোধ বাদ সাধল। ইংরেজরা কখনো সরাসরি দাস ব্যবসার সঙ্গে জড়ায়নি । তারা পার্লামেন্টে আইন করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করে ১৮০৭ সালে। শস্তার শ্রমিকের খোঁজে তারা ভারতের দিকে নজর দেয়। এখানে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ব্যবসার সাথে সাথে দেশের শাসনভারও পেয়েছে। তার ফায়দা তুলতে তারা ভারতের পূর্বাঞ্চলে (বাংলা এবং বিহার) নীলচাষ করতে শুরু করে অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে। তৈরী হল নীলকুঠি আর নীলকর সাহেব। ১৮১০ সালে ইওরোপে ভারতীয় নীল ৯৫ শতাংশ বাজার দখল করেছিল, ১৭৮৮ সালে যা ছিল মাত্র ৩০ শতাংশ।
তারপর বাকিটা লেখা আছে ইতিহাসের পাতায় আর 'নীলদর্পণে'। নীলচাষীরা আইনের চোখে দাস নাহলেও বাস্তবে প্রায় ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছিল।
(স্বয়ং উইলিয়ম কেরি এক সময় ছিলেন নীল কুঠির ম্যানেজার। অবশ্যই তিনি ব্যতিক্রমি চরিত্র। মুচির কাজ শিখেও তিনি খ্রিস্টান মিশনারি হয়ে এদেশে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন শিক্ষাপ্রসারে নিবেদিত প্রাণ।)
গত দুই মাসে বেশ কয়েকবার রাজশাহী এবং বৃহত্তর বরংপুর জেলায় আসা যাওয়ার মধ্যে রাজশাহীর হর্টিকালচার সেন্টারে গিয়েছিলাম মূলত নীল গাছ এবং রেশম চাষ বিষয়ে ধারণা পেতে গিয়েছিলাম। তখন ফুল-ফল সহ নীল গাছ এর ছবিটা তুলেছিলাম রাজশাহীর হর্টিকালচার সেন্টার থেকে। নিতান্তই কৌতূহল বশত ওখান থেকে নীল চারা এনে টবে লাগিয়েছি)
তথ্যসূত্রঃ প্রমোদ সেনগুপ্তঃ নীল বিদ্রোহ ও বাঙ্গালি সমাজ
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১১:১৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



