"ঘানি ভাংগা খাঁটি সরিষার তেল".....
স্বাধীনতার আগে আমাদের দেশে ভোজ্য তেল বলতেই ছিলো ঘানিতে ভাংগা সরিষার তেল। এই ধারা অব্যাহত ছিলো গোটা সত্তুর দশক পর্যন্ত।
যতদূর মনে পরে ৭০ সনের প্রলয়ঙ্কারী বন্যার পর এদেশে প্রথম সায়াবিন তেলের আগমন হয়েছিলো মার্কিন সরকারের ত্রাণ(ইউএস এইইড) সাহায্য হিসেবে। এর আগে শুধু গ্রামের মানুষই নয়, খোদ ঢাকাবাসীও সায়াবিন তেল ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিলোনা। তবে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা থেকে আমদানি করা সীমিত টিনজাত ভোজ্য তেলের ব্যবহার ছিলো স্বাধীন বাংলাদেশের নব্য ধনীক শ্রেণীর মধ্যে। সত্তর দশকের শেষ এবং আশির দশকে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা থেকে ব্যপক ভাবে সায়া বিনতেল এবং মালেশিয়া থেকে পাম অয়েল আমদানি হতে থাকে। দামে সস্তা আমদানিকৃত ভোজ্য তেল দখল করে রসনা প্রিয় বাংগালীর রান্নাঘর। হারিয়ে যায় আমাদের ঐতিহ্য- ঘানি ভাংগা সরিষার তেল।
স্বাধীনতার আগে কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম ও টাংগাইলে বিদ্যুৎ চালিত ভোজ্য তেলের মিল চালু হয়। স্বাধীনতার বছর খানিক পর ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে(বর্তমান বাটার সিগনাল)-বিদ্যুৎ চালিত "ভোজ্য তেল কল" চালু হয় যা এখনো সগৌরবে চালু আছে। আমাদের বৃহত্তর পরিবারের সবাই বাটার মোড়ের এই ভোজ্য তেল কল থেকেই তেল কিনি।
বাজারে পাওয়া খাঁটি সরিষার তেলের ঝাঁজ খুব কড়া হয়। আদতে ঘটনা ভিন্ন। ইলেকট্রিক কলে পিষ্ট হয়ে যে সরিষার তেল পাওয়া যায়, তার সুঘ্রাণ না থাকলেও, ঝাঁজ থাকে অনেক বেশি। কারণ, তেল তৈরির প্রক্রিয়ায় সরিষা পুড়ে তেল তৈরি হয়। তেলের রঙ উজ্জ্বল করতে ব্যবহার করা হয় কৃত্রিম রঙ। 'মাস্টার্স এসেন্স' (যদিও বহুজাতিক কোম্পানির সরিষা তেলের বোতলের গায়ের ছোট করে লেখা আছে ‘’mustard oil is banned for edible consumption in the EU, USA& Canada principally due to its euric acid content... euric acid known to cause some health risks ...’’ কিন্তু ওরা এই সতর্কবার্তা শুধু লিখেই রাখে, প্রয়োগ বন্ধ করে না) নামক একটা কেমিক্যাল মাত্র কয়েক ফোঁটা মেশালেই তেলের রঙ উজ্জ্বল এবং ঝাঝালো গন্ধ হয়। উপরন্তু তেলের ঝাঁঝ বাড়াতে মেশানো হয় শুকনো মরিচ যা সরিষার সাথে সরাসরি মিশিয়ে মাড়াই করা হয়। অন্যদিকে, সরিষা কাঠের ঘানিতে ভাঙা হলে, সেই তেলের ঝাঁজ হয় কম। কিন্তু সুঘ্রাণ হয় তীব্র এবং তেলের রঙ মোটেই স্বর্নজ্জল নয়, বরং কিছুটা কালচে রঙের(এই কালো রঙের উৎস- সরিষা বীজের খোসা)।
আমাদের অনেকেরই মনে আছে, বছর দশেক আগেও ভেজাল বিরোধী অভিযানে ম্যাজিস্ট্রেট রোকনউদ্দৌলা দেখিয়েছিলেন কিভাবে সায়াবিন তেলের সাথে কয়েক ফোঁটা কেমিক্যাল মিশিয়ে খাটি সরিষার তেল বানিয়ে ভোক্তাদের প্রতারিত হওয়ার ঘটনা!
ভোজন প্রিয় বাংগালীর সরিষা তেলের প্রতি আগ্রহের সুযোগ নিয়ে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে "খাটি ঘানি ভাংগা সরিষার তেল" উৎপাদন এবং বিপননের মচ্ছব! অনলাইনে এই ব্যবসা জমজমাট। তবে আমিও অনেকের মতো অনলাইনে এবং দোকান থেকে "খাটি ঘানি ভাংগা সরিষার তেল" কিনে প্রতারিত হয়েছি।
সোশ্যাল মিডিয়ায় অত্যন্ত পরিচিত মুখ, অনুজ প্রতিম একসময়ের প্রখ্যাত ব্লগার লালসালু এখন অনলাইনে বিখ্যাত ব্যবসায়ীদের অন্যতম। সম্প্রতি নিজের প্রতিষ্ঠান লালসালু ব্রান্ড ঘানি ভাংগা সরিষার তেল উৎপাদন ও বিপননের ব্যবসা শুরু করেছে। পূর্বের খারাপ অভিজ্ঞতায় প্রথম দিকে আমি লালসালুর তেলে সাড়া দেইনি। কিন্তু আমাদের সার্কেলের অনেকেই ওর থেকে তেল নিয়ে তেলের খুব প্রসংশা করে। ইতোমধ্যে ফখরুল ইসলাম(লালসালু ব্রান্ডের মালিক) নিজেই আমার জন্য ঘানি ভাংগা সরিষার তেল নিয়ে আসে। ফখরুল জানালো, ওরা সরাসরি দেশীয় উন্নত মানের সরিষা এবং আমদানিকৃত উন্নত মানের সরিষা নিজেদের ব্যবস্থাপনায় কাঠের ঘানিতে ভাংগিয়ে তেল বাজারজাত করে।

হ্যা, লালসালুর দেওয়া সরিষার তেল সত্যিই ভালো। বহুকাল পর সত্যিকারের "ঘানি ভাংগা খাটি সরিষার তেল" পেয়েছি! প্রতিটি রান্নায় বাড়তি স্বাদ গন্ধে মৌ-মৌ করছে রান্নাঘর! অতুলনীয় স্বাদ!!!
আশা করি, স্নেহধন্য ফখরুল ওরফে লালসালু অতিরিক্ত লাভের জন্য তেলের মান নষ্ট করে ব্যবসা করবেনা। বরং 'মিনিমাম প্রফিট, ম্যাক্সিমাম সেল' নীতিতে ব্যাবসা প্রসারিত করার সুযোগ গ্রহণ করবে।
খাঁটি সরিষার তেল চেনার ঘরোয়া উপায়ঃ
* খাঁটি সরিষার তেল উজ্জ্বল রঙের হয়না, বরং একটু কালচে রঙ হয়(তবে সামান্য কেমিক্যালে রিফাইন করে রঙ উজ্জ্বল করা যায়)।
* যেকোনো সামান্য রান্ননায়(হতে পারে ডিম ভাজি/কোনো মশলা)খাঁটি সরিষার তেল কড়াইয়ে ঢেলে গরম দিলেই ফেনা(ফোম) হবে।
* ভেজাল সরিষার তেল সুতির কাপড়ে ঢাললে কালো দাগ পড়ে। খাঁটি সরিষার তেলে সুতি কাপড়ে কোন দাগ হয় না।
* খাঁটি সরিষার তেল তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ হয় না। কিন্তু ভেজাল সরিষার তেলে তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ থাকে।
* ঘানিতে ভাংগা সরিষার তেল রোদে না দিয়েই কমপক্ষে ছয় মাস সরংক্ষণ করা যায়।
* খাঁটি সরিষার তেল ফ্রিজে রাখলে জমে যাবেনা।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১১:১৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



