স্মৃতির পাতায় ছেলে বেলার চুল কাটানো......
'আমার কোনো কিছুতেই আসক্তি নাই', বললে ভুল বলা হবে। আমার অনেক কিছুতেই আসক্তি আছে, যেমন- চুল কাটানো। মূলত চুল কাটানোর নামে হেড মেসেজ করানো। সাধারণত চুল কাটতে গেলে সেলুন কর্মী জিজ্ঞেস করে, "ছোট হবে?"
বেশ কয়েকমাস আগের কথা, আমি সেলুনে চুল কাটাচ্ছি, তখন আমার থেকেও বয়স্ক একজন চুল কাটাতে বসার পর স্বভাবমতো সেলুন কর্মী জিজ্ঞেস করে- "আংকেল, চুল ছোট করবো?"
অমনি বয়স্ক লোকটা খ্যাকখ্যাক করে উঠে বললো- 'সেলুনে কি কেউ চুল বড়ো করতে আসে? তোমাদের সেলুনে কি চুল বড়োও করা হয়??'
বয়স্ক লোকটার কথায় যুক্তি আছে, তবে তার বলায় খুব ঝাঁজালো এবং উষ্মা ছিলো। খুব অবাক হয়েছিলাম- এমন মোক্ষম যুক্তির জবাবটা আমার কখনও মনে আসলোনা কেনো! আমি আয়নায় লোকটাকে দেখে নিলাম- বোঝা যায় জীবন যুদ্ধে পোড়খাওয়া অভিজ্ঞ মানুষ। বেটে খাটো, শীর্ণকায় লোকটার বয়স আন্দাজ করা যাচ্ছেনা- ৬০ কিম্বা ৭০ বছরও হতে পারে!
প্রায় ৪০ বছর যাবত আমি কলাবাগানের একটা সেলুনেই চুল কাটাই। এবং সেই সেলুনের কর্মী চান মিয়া ২৫ বছরের বেশী সময় আমার চুল কাটে। চান মিয়া বিহারি সেলুন কর্মী। যেহেতু ওই সেলুনের সব সেলুন কর্মীরাই আমার রুচি জানে- তাই কখনোই আমাকে বলতে হয়না কিভাবে চুল কাটবে।
বেলজিয়াম থেকে আমার মাদার কোম্পানীর দুইজন উর্ধতন কর্মকতা এসেছেন। তাদের নিয়ে চট্টগ্রামে ইস্টার্ন রিফাইনারী ভিজিটে যাই। ৫ দিন ছিলাম। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর হোটেল রুমে ফিরে কিছুই করার থাকেনা। অগত্যা হোটেলের সেলুন সার্ভিস নিতে যাই....
ওয়েল ড্রেসের সেলুন কর্মী জিজ্ঞেস করে, 'স্যার চুল ছোট হবে?'
আমি বলি, 'মিডিয়াম'।
আমাকে জিজ্ঞেস করল, "কত নাম্বার?"
আমি বুঝে গেলাম- এরা চুল কাটবে ট্রিমারে। তবুও আমি জিজ্ঞেস করি- 'কাঁচি দিয়ে কাটবে না?'
"স্যার, কাঁচি দিয়ে ফিনিশিং টাচ দেবো।"
আমি আরাম প্রিয় মানুষ। চুল কাটাই কাঁচি দিয়ে...কাঁচির কিসকিস শব্দ আমার কানে অনূরণ সৃষ্টি করে- যা আমাকে মোহাচ্ছন্ন করে। কিন্তু হোটেলের সেলুন কর্মীরা খুব কমার্শিয়াল। এরা ঝটপট চুল কেটে বড়ো একটা বিল ধরিয়ে দেয়....
আমি চুল কতটা ছোট করতে চাই সেই অনুযায়ী ক্লিপার ব্যবহার করবে। তাই ক্লিপারের সাইজ বলতে হবে। আমি কৌশল করে পাঁচ নাম্বার বললাম। যাতে পাঁচ নম্বর সাইজ কাটা হলে চার নম্বর সাইজ করতে বলবো। তারপর তিন নম্বর সাইজ.... অর্থাৎ অন্তত ঘন্টা দেড়েক সময় আমি সেলুনে কাটাতে চাই....এই তিন নম্বরই হলো আমার রেগুলার সাইজ। পাঁচ থেকে যত নিচে নামবো, চুল আরও ছোট হবে।
চললো পাঁচ নম্বরের কারিকুরি। কাঁচির কোনও ব্যবহার নেই- ট্রিমার দিয়েই কাজ সারছে। একমাত্র ফিনিশিং টাচ দেবার সময় ছোট একটি কাঁচি এখানে ওখানে টাচ করে গেলো- তাও কোন আওয়াজ নেই।
সেলুন কর্মী বড়ো একটা আয়না আমার সামনে-পেছনে কয়েক সেকেন্ড ঘুরিয়ে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো- "ঠিক আছে স্যার?"
আমিও আয়না ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভালো করে দেখে বললাম- 'নাহ চুল অনেক বড়ো রয়েছে....চার নম্বর সাইজ করে দাও।' চার নম্বর শেষ হবার পর তিন নম্বর সাইজ করালাম...এমনিতেই মাথায় চুল কম...তিন নম্বর সাইজে এখন মাথার তালু বেড়িয়ে গেছে....মাথা মেসেজ করতে করতে দেড় ঘন্টা পার....আমি বারবার ঘুমিয়ে পড়ে যাচ্ছি....
মনে পড়ে গেল ছোটবেলার কথা। ছোটবেলায় লালবাগ থেকে সুরেন কাকু আসত আমাদের বাড়িতে। আমরা ছোটোরা সবাই বাড়িতে বসে সুরেন কাকুর কাছেই চুল কাটতাম। পুরুষানুক্রমে সুরেন কাকু পেশাদার সেলুন কর্মী। আমাদের পরিবারের সঙ্গেও যুক্ত ছিল বংশানুক্রমে। আমাদের ছোটদের চুলের স্টাইল নির্দিষ্ট করা ছিলো, যার নাম "বাটি ছাঁট"!
আমরা যারা ছোট তাদেরকে একটা ছোট চৌকিতে (এই চৌকিকে বলা হতো জল চৌকি। চৌকিকে কেনো জলচৌকি বলা হয় তা আজও অজানা। অবশ্য এখন জলচৌকি'র যায়গায় সর্বত্রই প্লাস্টিকের টুল ব্যবহার করা হয়) বসিয়ে সুরেন কাকু নিচু হয়ে, আবার কখনও হাঁটুগেড়ে চুল কাটতেন। চুল কাটার সময় ঘাড়ে চুল পরলে আমরা নড়াচড়া করতাম তাই সুরেন কাকু আমাদের মাথাটা তার দুই পায়ের মাঝখানে চেপে ধরে চুল কাটতেন, যাতে নড়াচড়া করতে না পারি! 'বাটি ছাঁটের' বাইরে কোনো পছন্দের কথা ভাবতেও পারতাম না। কিন্তু আমাদের সমবয়সী অনেক বন্ধুদের বাহারি চুলের ছাঁট দেখে আমরাও মনে মনে তেমন চুল কাটানোর শখ থাকলেও সুরেন কাকুর সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত ছিলো। তবুও ইনিয়েবিনিয়ে সুরেন কাকুকে বললেও কাজ হতো না। অনেকটা যন্ত্রের মতো আমাদের চুল কেটে তার ছোট বাক্সে খুড়-কাঁচি ভরে চলে যেতেন। চুল কাটানোর বিল কবে কখন দেওয়া হতো তাও আমরা জানতাম না- ওগুলো বাবা-চাচাদের ব্যাপার। সুরেন কাকুকে ভয় না পেলেও তিনি আমাদের কাছে সম্মানিত ছিলেন। তিনি আমাদের খুব স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন। তাই চুল কাটা হয়ে গেলে বলতেন- "দেখিতো হাতের নখ বড়ো হয়েছে কিনা?"
কিন্তু কখনও কখনও এমনও হতো, চুল বেশ বড় হয়ে গেছে, কাটানো দরকার। কিন্তু সুরেন কাকুর দেখা নেই। হয় ব্যস্ততার কারণে সেলুনে কিম্বা অন্য পাড়াতেই দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমাদের বাড়ির দিকে আসতেই পারছেনা। কিন্তু তখনও আমাদের কারোরই বাড়ির কাছের সেলুনে চুল কাটতে যাওয়ার পারমিশন হতো না......
হোটেলের সেলুনে চুল কাটতে যেয়ে ছেলেবেলার কথা মনে পরলো- যা
ব্লগ বন্ধুদের সাথে শেয়ার করলাম, অথবা লিখে রাখলাম স্মৃতি।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:২৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


