আমি অনেক কিছু হতে চেয়েছিলাম.....
জীবন আক্ষরিক অর্থে ছয় দশক আগে পিছিয়ে গেছে। টাইম মেশিনে করে চলে গেছি অনেক পেছনে- গ্রামে দাদা বাড়ি। রাত হলেই গ্রামটা জোনাকজ্বলা হয়ে যেতো- যে জোনাকির আলো শুধু জোনাকি পোকার জন্যই আর চারিদিকে ভূতুড়ে অন্ধকারের এক নেশা। এই অবস্থাতেও মানুষ একে অন্যকে ভালোবাসতো। আর অন্যকে ভালোবাসতে সে হাতে লিখে চিঠি পাঠাতো ভালোবাসার মানুষকে। সন্ধ্যে জুড়ে সেই চিঠি লেখার পরদিন সকালে সযত্নে মৃদু ফুলের গন্ধের আতর ছড়িয়ে সেই চিঠি পাঠানো হতো গন্তব্যে। আশা আতরের সুগন্ধের সাথে চিঠির শব্দ গুলোও সেই প্রিয় মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে। যাতে সে পাশে না থেকেও পাশে থাকার অনুভূতি পাবে। আজ প্রিয়জনকে কেউ চিঠি লেখেনা, দূরের মানুষের কাছে পৌঁছানা আতরে মাখা মনের সুখের কথা। যদি পৌঁছত তাহলে হয়ত একা থাকার এই দিনযাপন এতটা আমরা একলা হতাম না।
ছেলে বেলা আমার অনেকজন কাজিন ছিলো আমাদের বিচরণ ছিল ধানমন্ডি এলাকার বাইরে কলাবাগান, আজিমপুর, ঝিগাতলায় নিকট আত্মীয়দের মধ্যে। মাঝেমধ্যে বাবার চাকরীস্থল ও আমাদের পুরনো বাড়ি ওয়ারীতে। ......আমরা বেড়ে উঠেছি পারিবারিক কঠোর অনুশাসন আর নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে কিন্তু আমরা শৃঙ্খলবন্দী ছিলাম না। আমাদের খেলাধুলা এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক চর্চা ছিলো অবারিত। নিয়মানুবর্তিতার বাইরে আমরা যখন যেখানে একত্রিত হতাম- সবার মধ্যেই প্রচন্ড আকুতি ছিল-"কবে আমরা বড় হবো, কবে একা একা যখন খুশী যেখানে সেখানে যেতে পারবো"! আর এখন বারবার মনে হয়- ইশ আবার যদি সেই ছেলে বেলায় ফিরে যেতে পারতাম!
ব্যক্তিগত ভাবে ছেলেবেলা থেকেই আমি ছিলাম নিভৃতচারী এবং অনেকটাই একাকী। একাকিত্ব আমাকে আমার বয়সী অনেকের চাইতেই এবং আবার বয়সের দ্বিগুণের বেশি বয়সীদের চাইতে অনেক বেশি পড়ুয়া হতে সহায়ক হয়েছিল। জীবনে আমি অনেক কিছু হতে চেয়েছি- যতদূর মনে পড়ে, প্রথম হতে চেয়েছিলাম শিক্ষক। তাও আমাদের পণ্ডিত মশায়ের ছেলেকে মারার জন্য। ঘটনাটা খুলেই বলিঃ- আমাদের বাড়িতে এসে পড়াতেন বিশ্বেস্বর মন্ডল নামের পণ্ডিত মহাশয়। ছেলেবেলায় আমাদের বৃহত্তর যৌথ পরিবারে ৬/৭ বছর বয়সী কয়েকজন কাজীনের সাথে আমিও বাল্যশিক্ষা, নামতা পড়তাম। আমার দুই বছরের বড়ো চাচাতো ভাই জামাল ছিলো খুব দুষ্ট। প্রতিদিনই কোনো না কোনও অপকর্ম করলেও আমরা কেউ কিছু বলতে পারতাম না। ওর আগ্রাসী আচরণের জন্য ওকে আমরা সবাই ভয় পেতাম। পণ্ডিত মহাশয় যে চেয়ারে বসতেন একদিন সেই চেয়ারে জামাল ফাউন্টেনপেন থেকে কালি ঢেলে রেখেছিল। পণ্ডিত মহাশয় এসে চেয়ারে বসার পর সবাই মুখ টিপে হাসাহাসি করছিলো। অবশেষে পণ্ডিত মহাশয় টের পেলেন তার ধবধবে সাদা ধুতি পেছন থেকে কালো হয়ে গিয়েছে.... পণ্ডিত মহাশয় রেগেমেগে সবাইকে জিজ্ঞেস করেও কারোর মুখ থেকে জামালের নাম বলাতে না পেরে সবাইকে কান ধরে দাঁড়িয়ে রেখে এবং বকাবকি করেন।
সবাই কান ধরে দাঁড়িয়ে থেকে এবং বকাবকি স্বাভাবিক ভাবে নিলেও আমি চেয়ারে কালি ফেলিনি তারপরও কেন আমাকে কান ধরে দাঁড়িয়ে রাখলেন তার প্রতিবাদ করলাম। যার জন্য পণ্ডিত মহাশয় আমার কানের পাশের চিপস(চুল) টেনে ধরে। আমি কান্না করে পণ্ডিত মহাশয় এর চোখে চোখ রেখে বললাম- "বড়ো হয়ে আমিও মাস্টার হবো এবং আপনার ছেলের কান টেনে ব্যথা দেবো... তখন বুঝবেন পরের ছেলেকে মারলে কেমন লাগে!"
আমি যাত্রা দলের নায়ক হতে চেয়েছিলাম.....
ছেলে বেলায় কমলাপুর মাঠে জীবনে প্রথম বার যাত্রাপালা দেখেছিলাম ছোট চাচার সাথে। যাত্রা পালার নাম ছিলো "এজিদ বদ"। এজিদ বদ যাত্রাপালা (মীর মশাররফ হোসেন এর বিষাদ সিন্দু বইয়ের সারাংশ ভিত্তিক ঘটনা) দেখে আমি এমনই বুঁদ হয়েছিলাম যে অনেক কান্নাকাটি করে ছোট চাচার মন ভিজিয়ে আরও এক রাত 'সীতার বনোবাস' নামের একটি পালা দেখেছিলাম। আর একবার আমার মামাতো ভাই, আরাফাত ভাইয়ের সাথে দেখেছিলাম 'নবাব সিরাজুদ্দৌলা' পালা। আরাফাত ভাই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ১৯৭১ সনের ২৫ মার্চ কালো রাতে ইকবাল হলে পাক হানাদারদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞে তিনি শহীদ হন। নবাব সিরাজুদ্দৌলা পালা দেখে আমি 'মোহন লাল' হতে চেয়েছিলাম। তখনকার দিনে শীতের সিজনে কমলাপুর, ধূপ খোলা মাঠে ১৫ দিন থেকে এক মাস যাবত যাত্রার আসর বসতো। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের যাত্রা দল আসতো এবং তাদের সেরা পালা মঞ্চায়ন করতো। যাত্রাপালায় একজন 'বিবেক' থাকতেন। বিবেক চরিত্রটা আমাকে কাঁদাতো....আমি যাত্রাপালার 'বিবেক' হতে চাইতাম।
আমি 'মোহন লাল' কিম্বা 'বিবেক' হতে পারিনি। তবে আমার ভেতরে অভিনয় করার একটা সুপ্ত বীজ রোপিত হয়েছিল যাত্রাপালা দেখে। কলেজ জীবনের শুরুতে কলেজের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে 'সম্রাট শাহজাহান' নাটকে আমি 'জাহানারা' চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম! পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্য দলের সক্রিয় সদস্য ছিলাম।
আমি আমার পূর্বের(১৫ আগষ্ট ২০২২ তারিখ "অটো প্রমোশন" শিরোনাম) একটা লেখায় মুক্তিযোদ্ধা আহাদ ভাইয়ের হত্যা নিয়ে লিখেছিলাম....সৎ ন্যায়নিষ্ঠ নির্দোষ আহাদ ভাইয়ের হত্যাকাণ্ড আমাকে ভীষণ ভাবে শোকাহত এবং বিমর্ষ করেছিলো। আহাদ ভাইয়ের মর্মান্তিক হত্যায় আমার কিছুই করতে না পারার বেদনায় মনে মনে 'সিরিয়াল কিলার' হতে চেয়েছিলাম.....না আমার পক্ষে সিরিয়াল কিলার হওয়া দূরের কথা, মানব সমাজের একটা দুষ্ট মাছি তাড়াবার মতো শক্তিও অর্জন করতে পারিনি।
আমি 'মাস্টার', 'মোহন লাল', 'বিবেক' কিম্বা 'সিরিয়াল কিলার' ছাড়াও আরও অনেক কিছু হওয়ার তালিকা দীর্ঘায়িত না করে কল্পনার রাজ্য থেকে বাস্তবতার কষাঘাত জর্জরিত মর্তে ফিরে আসি।
এদেশের প্রায় সব অবিভাবকের আশা- তাদের সন্তান ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার পাইলট হবে, গাড়ি বাড়ির মালিক হবে....কোনো বাবা-মা চান না তাদের সন্তান বিজ্ঞান গবেষক হবেন, মানবাধিকার কর্মী হবেন কিম্বা খেলোয়াড় হবেন বরং আমাদের ছেলে বেলায় খেলাধূলায় আশক্ত সন্তানদের কপালে বাবা-মা ছাড়াও স্কুল শিক্ষকের হাতে মাইর, অপমান অপদস্ত ছিলো নিত্যকার শাস্তি। ছোট ছোট বাচ্চারা জানেইনা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার পাইলট, জজ ব্যারিস্টার কি? তবুও তারা মুখস্থ বলে দেয়- 'বড়ো হয়ে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার পাইলট জজ ব্যারিস্টার হতে চাই'।
'বড়ো হয়ে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার পাইলট জজ ব্যারিস্টার হতে চাই'- ছোটবেলা থেকে এই কথাগুলো শুনতে শুনতে আমরা মনের মধ্যে গেঁথে ফেলি এবং তা সারা জীবন বহন করে বেড়াই। কিছু করার আগে ভেবে দেখতে পারি, আসলেই কতটুকু প্রযোজ্য এটা আমার জন্য। ছোটবেলা থেকে বাচ্চাদের আমরা শেখাতে পারি, কীভাবে নিজেকে ভালোবাসতে হয় এবং তা প্রকাশ করতে হয়। আমি যেমন আমার অধিকারটুকু দেখব তেমনি অন্যেরটুকুও দেখব। যখনই আমি এভাবে চিন্তা করতে পারব, তখনই দুটির সমন্বয় কীভাবে নিজস্ব মতামত দিতে হয়, তা বুঝতে পারব। আমি যখন নিজে না বলতে পারব, একই সঙ্গে অন্যের না বলাটাকেও গ্রহণ করে নিতে শিখতে হবে। আমার যেমন পছন্দ–অপছন্দ রয়েছে, তা আরেকজন মানুষেরও আছে। তা মেনে নিতে শিখতে হবে, যা আমাদের নিজের প্রতি যত্নশীল হতে শেখাবে। ভুলে যাই, আমরা যদি নিজেকে নিয়ে ভালো থাকতে পারি, কেবল তখনই অন্যকে ভালো রাখতে পারব।
আমাদের মনে রাখতে হবে- সফল হওয়া মানেই টাকা পয়সা ধন-দৌলত প্রাচুর্য নয়। সফল হওয়ার মূলমন্ত্র আত্মবিশ্বাস- আমি দৃশ্যমান কোনো ভালো কাজ না করতে পারলেও কোনো খারাপ কাজ করিনি।
সফল হওয়া সহজ কাজ নয়। তবে ছোট ছোট কাজের মধ্যেও অনেক বড়ো সফলতা থাকে। বিষয়টা দৃষ্টিভংগির, আত্মদর্শী। ছোট কিম্বা বড়ো সফল হবার জন্য পরিকল্পনা জরুরী।
সবার আগে নিজেকে গুরুত্ব দিন। অন্যরা কী ভাবছে তা ভাবার দরকার নেই। দৃষ্টিভঙ্গি বদলান। ইতিবাচক মানুষের চারপাশে থাকুন। সামনে এগিয়ে যাওয়া থামাবেন না। বুদ্ধি বিবেক খাটান। নিজেকে মাঝে-মধ্যে সবকিছু থেকে ছুটি দিন এবং আবার শুরু করুন। মনে রাখবেন, ব্যর্থতা জীবনের শেষ কথা নয় বরং ব্যর্থতা দিয়েই শুরু হোক আগামীর সফলতা।
সফলতার চাইতেও সবার ভালোবাসা পাওয়া কঠিন ব্যাপার। অনেক মানুষের স্নেহ ভালোবাসা পেয়েছি- এটাই বড় প্রাপ্তি। আমার যতটুকু অর্জন করার ছিল, তা করেছি। জীবনে কিছুই করতে পারলাম না- এমন আক্ষেপ নেই। এক জীবনে অনেক পেয়েছি। সৃষ্টিকর্তা আমাকে অনেক দিয়েছেন। তাঁর প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:২৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


