জেনারেশন গ্যাপ.......
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ তসলিমা নাসরিনকে বিয়ে করার পর তার বাবাকে একটা চিঠি* লিখেছিলেন। যেখানে রুদ্র পিতা পুত্রের কিছু স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রথমেই স্বীকার করে নিচ্ছেন- দুই প্রজন্মের মধ্যে দূরত্বের কথা যৌক্তিক ব্যাখ্যাটাও চিঠিতে প্রকাশিত হয়েছিলো। রুদ্রর চিঠিটা আমি অনেক বার পড়েছি। তিনি তার বাবার সাথে যে দূরত্ব অর্থাৎ জেনারেশন গ্যাপ এর কথা বলছেন- সেই দূরত্বটা বাস্তব। এই যে দূরত্ব এই যে দুজনের চিন্তার ফারাক এটাই সত্য। একে অস্বীকার করার উপায় নেই। তার কারণ হল- প্রতিনিয়ত বহতা পরিবর্ত্তনশীল সময়। আর সেই বদলে যাওয়া সময়ে প্রযুক্তি থেকে সামাজিক সম্পর্ক, সংস্কৃতি সব কিছুর বদলে যাওয়া। আমরা যেটা করতে পারি তা হল এই দূরত্ব ও দ্বন্দ্বকে অস্বীকার না করা।
একে পূর্ণরূপে স্বীকার করা।
এবং তারপর তা কমিয়ে আনা।
ধৈর্য্য সহনশীলতা ও উপলব্ধির পথে।
এই কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে প্রথম বাধা আমাদের সমাজে বিশেষত মধ্যবিত্ত সমাজে সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের ও বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানদের তীব্রতম অধিকারবোধ ও অবসেশন। পুরনো যৌথ সামন্ততান্ত্রিক একান্নবর্তী পরিবারেও এই অবসেশন ছিল। সেখানেও বাবা-মা ঠিক করে দিতেন মেয়ে কাকে বিয়ে করবে বা ছেলে ডাক্তারী পড়বে না সিভিল সার্ভিসে যাবে। কিন্তু সন্তানের সংখ্যা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ছয় থেকে এগারো হওয়ায় সেই অবসেশন ভাগ হয়ে যেত। নব্য উদারবাদী প্রতিযোগিতামূলক সমাজে একক পরিবারে সেই অবসেশনের পুরো দায় নিতে হচ্ছে একটি পুত্র বা একটি কন্যাকে।
এর বিপরীতে আবার আছে সম্পূর্ণ পিতৃ-মাতৃ স্নেহ থেকে বঞ্চিত সন্তানদের এককভাবে বেড়ে ওঠা। আমাদের বাড়ির কাছাকাছি বাড়ির একটা ছেলে ছিলো, কখনও ওকে হাসতে দেখিনি। অদ্ভুত লাগতো। খুব হাসির কথাতেও যদি কোনো কিশোর গম্ভীর হয়ে থাকে সত্যিই তা চিন্তার বিষয়। অনেক চেষ্টা অনুসন্ধান ও বন্ধুত্ব করে জানতে পারি তার বাবা ও মায়ের এক ভয়ঙ্কর অসুস্থ দাম্পত্য সম্পর্কের কথা। সেই চিরবিষণ্ণ বিষাদগ্রস্ত কিশোর কোনোদিন কোনো পিতা-মাতা দিবসে নিজের বাবা মাকে সাদরে ভালোবাসা জানাবে বলে তো মনে হয় না।
পরিবারের রূপ বদলাচ্ছে। চাহিদার ধরণ বদলাচ্ছে।আর্থিক অনিশ্চয়তা যত বাড়ছে পরিবার টিকে থাকা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে আরো বেশী করে। একটা ভালোবাসাহীন সময়ে একদিকে অবসেশন-তীব্রতম অধিকারবোধ আর অন্যদিকে নির্লিপ্তি-উদাসীনতার মাঝে দাঁড়িয়ে বাবা-মায়েরা কতটা স্পেস দেবেন তাঁদের সন্তানকে যাতে তারা স্বাধীনভাবে বড় হয়ে উঠতে পারে বা সন্তানই বা কতটা দূরত্ব কমিয়ে আনতে পারবে তার ওপরই নির্ভর করবে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির টিকে থাকা।
এখানে যা কিছু লিখেছি, তা রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লার চিঠি পড়ে আমাদের সামাজিক অবস্থা দেখে নিজ উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ। ১৯৮৩ সালে রুদ্রের চিঠির বাস্তবতা এখন অনেকটাই ফারাক, তবুও সব বাবা-মা চান তাঁদের সন্তান যেনো ভালো থাকে। একজন বাবা হিসেবে সেই প্রত্যাশা আমারও, তবে বাবা-মা'র বাস্তবতা মেনে সময়ের সাথে পরিস্থিতি বিবেচনা করে সন্তানদের মানসিক ভাবে বিকশতি হতে হবে।
* ১৮.৬.৮৩
মুহম্মদপুর
আব্বা,
পথে কোনো অসুবিধে হয় নি। নাসরিনকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গত পরশু ঢাকা ফিরেছি। আপনাদের মতামত এবং কোনোরকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আমি বিয়ে কোরে বউ নিয়ে বাড়ি যাওয়াতে আপনারা কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু আমিতো আমার জীবন এইভাবেই ভেবেছি। আপনার সাথে আমার যে ভুল বোঝাবুঝিগুলো তা কক্ষনোই চ্যালেঞ্জ বা পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্ব নয়। স্পষ্টতই তা দুটি বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব। ব্যক্তি আপনাকে আমি কখনোই ভুল বুঝি নি। আমি জানি না, আমাকে আপনারা কিভাবে বোঝেন।
এ তো চরম সত্য কথা যে, একটি জেনারেশনের সাথে তার পরবর্তী জেনারেশনের অমিল এবং দ্বন্দ্ব থাকবেই। যেমন আপনার আব্বার সাথে ছিলো আপনার। আপনার সাথে আমার এবং পরবর্তীতে আমার সাথে আমার সন্তানের। এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাত কোনোভাবেই রোধ করা সম্ভব নয়। আমরা শুধু এই সংঘাতকে যুক্তিসংগত কোরতে পারি। অথবা পারি কিছুটা মসৃন কোরতে। সংঘাত রোধ কোরতে পারি না। পারলে ভালো হতো কিনা জানি না তবে মানুষের জীবনের বিকাশ থেমে যেতো পৃথিবীতে।
আমার মনে পড়ে না, আমার এই ছাব্বিশ বছরে–একদিনও আপনি পিতা হিসাবে আপনার সন্তানকে আদোর কোরে কাছে টেনে নেন নি। আশেপাশের অন্য বাবাদের তাদের সন্তানদের জন্যে আদোর দেখে নিজেকে ভাগ্যহীন মনে হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে কখনো কষ্ট প্রকাশ করি নি।
ছোটবেলায় আমার খেলতে ভালোলাগতো, খেললে আমি ভালো খেলোয়াড় হতাম। আপনি খেলতে দিতেন না। ভাবতাম, না খেল্লেই বোধহয় খুব ভালো, ভালো মানুষেরা বোধহয় খেলে না। আবার প্রশ্ন জাগত, তাহলে আমার খেলতে ভালো লাগে কেন? আমি কি তবে খারাপ মানুষ! আজ বুঝি, খেলা না-খেলার মধ্যে মানুষের ভালোমন্দ নিহিত নয়–কষ্ট লাগে!
আমিও স্বপ্ন দেখতাম আমি ডাক্তার হবো। আপনার চেয়ে বড় ডাক্তার হয়ে আপনাকে ও নিজেকে গৌরব দেবো। সন্তান বড় হলে পিতারই তো সুখ। আমি সেভাবে তৈরিও হচ্ছিলাম। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের পর কী যে এক বিরাট পরিবর্তন এলো। একটি দেশ, একটি নোতুন দেশের জন্ম হলো। নোতুন চিন্তার সব কথা হতে লাগলো। নোতুন স্বপ্ন এলো মানুষের মনে। সবাই অন্যরকম ভাবতে শুরু করলো। আমিও আর আমার আগের স্বপ্নকে ধরে রাখতে পারি নি। তারচে’ বেগবান এক স্বপ্ন আমাকে টেনে নিলো। আমি সিরিয়াসলি লিখতে শুরু করলাম। আগেও একটু-আধটু লিখতাম, এবার পুরোপুরি।
আমি আমার আগের সব চিন্তা-ভাবনার প্রভাব ঝেড়ে ফেলতে লাগলাম নিজের চিন্তা থেকে, জীবন থেকে, বিশ্বাস, আদর্শ থেকে। অনেক কিছুর সঙ্গে সংঘর্ষ লাগতে লাগলো। অনেক কিছুর সাথে ভুল বোঝাবুঝি শুরু হলো। কখনো ক্ষোভে আমি অপ্রত্যাশিত কিছু করে ফেলতে লাগলাম। আবার আমার বিশ্বাসের সাথে মিল, এমন অনেক মানুষের দেখা পেলাম। তাদের সাথেও সংঘাত হলো। একি, সবার সাথেই সংঘর্ষ হয় কেন? মনে মনে আমি ভীষণ অস্থির হয়ে পড়লাম। তাহলে কি এপথ ভুলপথ? আমি কি ভুলপথে চলেছি? কখনো মনে হয়েছে আমিই ঠিক, এই-ই প্রকৃত পথ। মানুষ যদি নিজেকে ভালোবাসতে পারে তবেই সে সবচে’ সুন্দর হবে। নিজেকে ভালোবাসতে গেলেই সে তার পরিবারকে ভালোবাসবে। আর পরিবারকে ভালোবাসলেই সে একটি গ্রামকে ভালোবাসবে, এক গোষ্ঠীর মানুষকে ভালোবাসবে। আর একটা গ্রাম মানেই তো সারা পৃথিবী। পৃথিবীর সব মানুষ সুন্দর হয়ে বাঁচবে। আমি আমার বিশ্বাসে স্থির হয়েছি।
আমি আমার নিজের কথা সব ক্ষেত্রে বুঝিয়ে বলবো, যতভাবে সম্ভব। না বুঝতে চাইলে বোঝাবো কিন্তু বুঝে না-বোঝার ভান কোরলে তাকে চিহ্নিত করে দেয়া এবং পরমুহূর্ত থেকেই তার সাথে সংঘাতে যাওয়া। কারণ সত্যতো একটা। একটা সত্য। যে-কোনো একটি মুহূর্তের জন্য মাত্র একটিই মুহূর্ত নির্ধারিত। একটি মুহূর্তই সত্য। পৃথিবীতে কতো বড় বড় কাজ করছে মানুষ–একটা ছোট পরিবারকে সুন্দর করা যাবে না! অবশ্যই যাবে। একটু যৌক্তিক হলে, একটু খোলামেলা হলে কতো সমস্যা এমনিতেই মিটে যাবে। সম্পর্ক সহজ হলে, কাজও সহজ হয়। আমরা চাইলেই তা করতে পারি। জানি না, এই চিঠিখানা আপনি ভুল বুঝবেন কিনা।
ঈদের আগে আগে বাড়ি আসবো। আম্মাকে বলবেন যেন বড়মামার কাছ থেকে হাজার চারেক টাকা নিয়ে আমাকে পাঠায়। বাসায় রান্নার কিছুই কেনা হয় নি। বাইরে খাওয়ার খরচ বেশি। এবং অস্বাস্থ্যকর। আম্মার তদারকিতে দেয়া সম্পত্তির এতটকই তো মাত্র রিটার্ন। আপনার সেন্টিমেন্ট থাকা স্বাভাবিক, কারন আপনার শ্বশুরবাড়ি। আমাদের কিসের সেন্টিমেন্ট। শিশু মোংলায় পড়বে। বাবু ইশকুলে। আপনারা না চাইলেও এসব করা হবে।
দোয়া করবেন।
শহিদুল্লাহ।
রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লার চিঠি সূত্রঃ "লেখকদের চিঠি" থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:২৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


