ঘুড়ি উড়ানো.....
ছেলেবেলা ফিরে ফিরে আসে নানান ভাবে .........
"এখন বয়স হয়েছে, অতএব..." - এমনটা নয়, অন্ততঃ আমার জন্যে৷ ছেলেবেলা আমি ফিরে পেয়েছি সারা জীবন ধরেই, বারে বারে, ছোট ছোট ঘটনার মধ্যে দিয়ে- এমন কি নানান গন্ধেও৷ পোড়া পেট্রোলের গন্ধ, মার্বেল খেলা, লাটিম ঘোরানো, বৃষ্টি কর্মদাক্ত মাঠে ফুটবল খেলা, ভরা ভাদরে পানিতে টইটুম্বুর লেকে এমনকি বুড়িগঙ্গায় সাতার কাটা... এ সব দিয়ে ভরানো ছিল আমার ছেলেবেলা৷
আজকাল যেমন আবার পাচ্ছি- রোজ বিকেলে ছাদে গিয়ে নাতনীর ঘুড়ি ওড়ানোর ভেতর দিয়ে ... ৷

আমাদের অনেক আত্মীয়স্বজন পুরনো ঢাকায়। পুরনো ঢাকা মানেই নানানরকম উতসব! সাইকেল নিয়ে লালবাগ কেল্লা সংলগ্ন ফুফুদের ডজ ইন্ডাস্ট্রি চলে যেতাম। সেই বাড়ি থেকে কাজীনদের সাথে ঘুড়ি নিয়ে চলে যেতাম লালবাগ কেল্লার মাঠে- পৌষ মাসে গোটা পুরনো ঢাকার সব বাড়িতেই ছোটবড়ো সবার হাতে ঘুড়ির নাটাই! সেই জীবনে কী সব উন্মাদনা ছিল!
অ্যারারুট গুলে, তাতে গুঁড়ো করা কাঁচ মিশিয়ে আমার থেকে বয়সে বড় দুই ফাফাতো ভাই মিলে সুতোয় 'মাঞ্জা' দেওয়া, তারপর অন্যের ঘুড়ি কেটে দেওয়ার সুখ আর নিজেদের ঘুড়ি ভো কাট্টা (কোনো ঘুড়ি কাটা পরলেই চারিদিক থেকে উল্লাশ/চীতকার ভেসে আসতো- "ভক্কাডা" বলে) হওয়ার গভীর শোক! আবার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজোর সময় কুল গাছের কাঠ পুড়িয়ে ছাই তৈরী করে তাতে হরেক মশলা মিশিয়ে বাজি বানানো(তখনকারদিনে পুরনো ঢাকার প্রায় সব তরুণেরাই বাজি বানাতে পারতো, আমার ফুফাতো ভাইরাও বড়োদের চোখ এড়িয়ে সেই বিদ্যা অর্জন করে ব্যাপক মার খেয়েছিলো)... সে ছিল এক স্বপ্নের জীবন!
ঘুড়ি ওড়ানো আর প্যাঁচ খেলা যে একটা আর্ট তা শিখেছিলাম মিঠুদার কাছেই।

ঘুড়ি ওড়ানোর চেয়েও আমাদের বেশী নেশা ছিল সুতা কাটা ঘুড়ি ধরা। সুতা কাটা ঘুড়ি ধরায় এক ধরনের থ্রিল, রোমাঞ্চ- কোন অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের তুলনায় কম নয়। মেঘের ঢেউয়ে ভেলার মত ভেসে যাওয়া ঘুড়ি ধরার জন্য আমরা সবকিছু করতে প্রস্তুত ছিলাম।
আজ সে কৈশোর আর নেই। রাতের তারার মতন দিনের আকাশে ঘুড়ি ফুটে থাকা নেই। এখন শৈশবের পরেই যৌবন। ঘুড়ি নেই, লাটাই নেই, মাঞ্জা নেই। আছে Facebook , WhatsApp , Twitter । ১৫/২০ তলার হাইরাইজ ছাদ আছে কিন্তু সেই ছাদে লাটাই ধরা কৈশোর নেই। জানিনা আবার কোনও প্রজন্মের কিশোররা হাতে লাটাই তুলে নেবে কি না? তবে একথা বেশ জানি কৈশোরকে বাদ দিয়ে এসেছে যে যৌবন, সেই যৌবন আক্ষেপ করার সুখানুভুতি থেকে বঞ্চিত। মাঞ্জা সুতোর ধারে কেটে যাওয়া আঙুলে ব্যথার থেকে সুখ অনেক বেশী ছিল। অনেক সুতো সমেত একটা ময়ুরপঙ্খী ঘুড়ি ধরতে পারার উত্তেজনা ভিডিও গেমস খেলার থেকে অনেক বেশি ছিল।
আজ আর সেদিন নেই, তবে এখনও মনের আকাশে ভেসে ওঠে লাল, নীল, হলদে, সবুজ ঘুড়ির মেলা।
ঘুড়ি বয়সে খুব প্রাচীন৷ ঘুড়ির ইতিহাস ঘেটে যানা যায়- এর উদ্ভব খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে- চীন দেশে- Mozi আর Lu Ban-নামের আবিষ্কারকের হাত ধরে৷ চীনদেশ থেকে ঘুড়ি ক্রমশঃ ছড়িয়ে পড়ে কম্বোডিয়া, ভারত, জাপান, কোরিয়া হ'য়ে পশ্চিমের দেশগুলিতেও৷ বেশ কয়েক বছর আগেও কম্বোডিয়ার Siem Reap শহরে দেখেছি রংবাহারী, রকমারি ঘুড়ির কেনাবেচা৷পাকিস্তানের লাহোরে, ভারতের দিল্লিতে ঘুড়ি উতসবে ঘুড়ির সূতায় কাটা পরে অসংখ্য মানুষের আহত হওয়ার ঘটনা দেখেছি, এমনকি মৃত্যুর ঘটনাও শুনেছি।
শুনেছি, Wright Brothers যে এরোপ্লেন তৈরী করেন, তার প্রেরণাও ঐ ঘুড়ি৷
ইদানীং ঘুড়ি যে আমাকে আবার ভাবাচ্ছে, তার পেছনে নাতনীর ঐ ঘুড়ি নিয়ে মাতামাতি ... যার অংশীদার আমিও, অনেকদিন পরে৷
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:২৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


