১৯৭০ থেকে ২০২২ বিশ্বকাপ ফুটবলের সাতকাহন.........
আমাদের শৈশব আর কৈশোর- জীবনের এই দুই পর্বের সাথেই ফুটবলের যে কি মাখামাখি সম্পর্ক ছিল- তা ভাবলেই আজো শিহরন জাগে। গ্রীষ্মকাল আর বর্ষাকাল দুই ঋতু জুড়েই ছিলো ফুটবলের রমরমা।
আমাদের ছোটবেলার স্মৃতিতে, ফুটবলে পাম্প দেওয়া ......পানিতে
ভিজে চামড়ার সেলাই খুলে "ব্লাডার" বেড়িয়ে আসা..... "লেসি্ংকল" জাতীয় ফিতায় বেঁধে ফুটবলের মুখ বন্ধ করা..... লেসিংকল....ওটা দিয়ে টেনে হিঁচড়ে বলের জিভ ঠিক জায়গায় রেখে মুখ মিলিয়ে দিতে প্রায় সার্জন এর দক্ষতা লাগতো ....। এই দৃশ্যগুলোর কথা মনে পড়লেই মন ভালো হয়ে যায়! অবশেষে আবির্ভাব হলো সাদা-কালো ফুটবলের। অনেক ঝামেলা কমে গেল যেন! প্রাইমারি স্কুলে পড়ি তখন। বড়োদের আলোচনা থেকে জানতে পারি- পেলে, ইউসেবিও, ববি মুর, গার্লেড মুলার, লেভ ইয়াসিনদের নামগুলো।

ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইত্তেফাক ছাড়াও ডেইলি অবজার্ভার পত্রিকা রাখা হতো। কলেজে শুধু ইংলিশ পেপার। একদিন ইত্তেফাকের খেলার পাতায় আবিষ্কার করলাম, কালো মানিক পেলে, জোয়ার্জিনহো, এ্যালবার্টো সমৃদ্ধ ব্রাজিল, জুলে রিমে কাপটা চিরতরে নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছে। আজো, চার বছর অন্তর এই জুন-জুলাই মাস আসলেই বুকের মধ্যে যেন মাদল বাযে বিশ্বকাপ ফুটবলের। কতো বিকেল, কত মধ্যরাত..... বন্ধু-বান্ধব, আত্নীয়-স্বজনদের সাথে মিলেমিশে হৈচৈ করে বিশ্বকাপ দেখার স্মৃতি মনের মধ্যে উথালপাথাল করে।
এলো ১৯৭৪ আরো বড়ো হয়েছি, কলেজে পড়ি। কলেজ গেমে গ্রাউন্ডে নেমে বড়ো ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন না দেখলেও সেই সময়ে হল্যান্ডের জোহান ক্রুইফ আর তাদের টোটাল ফুটবল আমার মনে আলোড়ন ফেলে দিল....জিতল কিন্তু পশ্চিম জার্মানি। এবার পালা ১৯৭৮ সালের .... তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তখন "খেলার খবর" পত্রিকার অন্যতম আকর্ষণ। তবে ফুটবল নয়, আমি বাস্কেট বল এবং হকি খেলায় মজেছি। তবে ফুলবল বিস্মৃত হইনি কখনও। পাসারেলা, মারিও কেম্পেসের মারকাটারি খেলার উপর ভর করে আর্জেন্টিনার উত্থান হলো; ৩-১ গোলে নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে বিজয়ী হলো তারা।

এরপর এলো ১৯৮২.... দেশে তখন একটা চ্যানেল বাংলাদেশ টেলিভিশন। তবে তখনও টেলিভিশন এতোটা নির্লজ্জ "সাহেব-বিবি-গোলাম এর বাক্স" হয়নি। বিটিভিতে আমরা বন্ধুরা মিলে চুড়ান্ত পর্বের কয়েকটি খেলা দেখেছিলাম, মনে পড়ে। পাওলো রোসি আর ইতালী সেবার সুপার ডুপার হিট। অতঃপর মঞ্চে আগমন হলো ১৯৮৬ র। পেলেকে তার ফর্মে থাকাকালীন আমরা দেখিনি কিন্তু ফুটবলের আর এক রাজপুত্র দিয়েগো মারাদোনাকে দেখলাম আমরা দুচোখ ভরে। টিভি তখন স্বমহিমায় বিরাজমান। আহা, এতো নিমগ্ন হয়ে আগে কখনো বিশ্বকাপ দেখিনি!
তারপর....১৯৯০..সংসারী হয়েছি তখন... সেবার পশ্চিম জার্মানি আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে সেরা হলো। পরের বার অর্থাৎ ১৯৯৪ ..ফিরে এলো ব্রাজিলের মনমাতানো ফুটবল। রোমারিও, বেবেতোরা তখন আমাদের ঘরের লোকের মতো- ইতোমধ্যে আমাদের ঘরে ফুটবল পাগল দর্শক বেড়েছে। আমাদের ছোট ছেলে ইংলিশ ফুটবলের ঘোর সমর্থক। বিশ্ব ফুটবলের সবকিছু তার নখদর্পণে। সত্যিকারের ফুটবল বোদ্ধা। ১৯৯৮; জিদানের কাঁধে ভর দিয়ে ফ্রান্স সেবার বিশ্বসেরা। এলো ২০০২; ফের ব্রাজিলের রাজত্ব। রোনাল্ডো আর রোনাল্ডিনহোদের পায়ের জাদুতে আমরা তখন আচ্ছন্ন। ২০০৬: সেই ১৯৮২ র পর ইতালী আবার চ্যাম্পিয়ন, টাইব্রেকারে ফ্রান্সকে হারিয়ে।

২০১০: ইনিয়েস্তার পায়ের জাদুতে ভর করে স্পেন প্রথমবারের জন্য বিশ্বসেরা। ওদিকে ১৯৯৮ সাল থেকেই আমার বিশ্বকাপ অভিযানে সঙ্গী থেকেছে আমার পুত্র। আমি বরং ১৯৯৮-২০১০ এই সময়টায় অতটা মন দিয়ে সব খেলা দেখে উঠতে পারিনি। বহুবার এমন হয়েছে- আমি রাতে খেলা দেখতে গিয়ে ঘুমে ঢুলে পড়েছি, কিন্তু ছেলে টানটান উত্তেজনা নিয়ে পুরো খেলা দেখেছে। ২০১৪ সালে বাপ-ব্যাটা মিলে পুরো টুর্নামেন্টটাই দেখেছিলাম। সেবার ব্রাজিলের সাত গোল খাওয়া দেখে আমাদের ছোট ছেলের অসহ্য মানসিক অবস্থা অথচ আমার কোনো বিকার নেই.... বরং মনে মনে হাসছি.....! আসলেও তখন লিওনেল মেসির দক্ষতায় গরীয়ান হয়ে কাপ জেতার খোয়াব দেখছিল আর কি! যা হোক শেষে তো ঐ জার্মানরাই কাপ জিতে নিল।

২০১৮: আবারও , ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে। রাশিয়া ১৪ই জুন থেকে শুরু হলো বিশ্বকাপ.... কেমন খেলবে কুটিনহো-জাসুস-নেইমার সমৃদ্ধ ব্রাজিল? মেসি কি পারবেন, বাংলাদেশের অসংখ্য "শুভ"দের মুখে হাসি ফোটাতে? জোয়াকিম লো-র কোচিং আর নয়্যারের কূশলতায় পারবে কি জার্মানরা পরপর দ্বিতীয়বারের জন্য সমর্থকদের উল্লসিত করতে? আর সেইসব সাড়াজাগানো নাম..... পগবা , ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, সুয়ারেজ, টমাস মুলার, গ্রিজম্যান, ৩৪ বছর বয়সী ইনিয়েস্তা। কতটা পারবেন তারা নিজেদের সুনামের মর্যাদা দিয়ে নিজেদের দলকে টেনে তুলতে? মিশরের বিরাট ভরসা মহম্মদ সালাহ তো চোটই পেয়ে বসলেন কয়েকদিন আগে। খবরের কাগজ সহ সকল মিডিয়ায় বিশ্বকাপ! কিন্তু সবাইকে হতাশ করে, কাউকে খুশী করে চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স। ফুটবলের নতুন রাজার আবির্ভাব- মাত্র এক কুড়ি বছরের ক্লিয়ান এমবাপ্পে!
আবার চার বছর পর এলো ২০২২ কাতার বিশ্বকাপ। সব সময়ের ফেবারিট ইতালী এবার কোয়ালি ফাই করতেই ব্যার্থ! ফেবারিট যথারিতী ব্রাজিল। তারপর জার্মানী, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস এবং যথারিতী আর্জেন্টিনা। এশিয়া থেকে সৌদি আরব, দক্ষিন কোরিয়া, জাপান এবং আফ্রিকা থেকে মরক্কো চমতকার ফুটবল উপহার দিয়েছে। এবারের বিশ্বকাপে সুপারস্টার অনেক- মেসি, এমবাপ্পে, নেইমার, রোনালদো.......
বর্তমানে বিশ্বকাপের বেশীরভাগ দলেই দ্বৈত নাগরিকদের তথা এক দেশের নাগরিকদের সাথে মাইগ্রেট করা খেলোয়াড়দের ছড়াছড়ি। বৃটিশ, ফ্রান্স, জার্মানি সহ ইউরোপ, বলকান, স্কান্ডেভিয়ান দেশগুলো মাইগ্রেশন করা খেলোয়াড়দের দিয়ে দল গড়ে। বাদ যায়নি- সৌদি আরব, কাতার, মরক্কোও। কিন্তু শুরু থেকে ব্যতিক্রম লেটিন আমেরিকান দেশগুলো, স্পেশালী ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা। এই দুই দেশ সব সময়ই নিজ দেশের নাগরিকদের থেকেই ফুটবল খেলোয়াড় বেছে নেয় বলেই ল্যাটিন আমেরিকান ফুটবলের ঐতিহ্য বজায় রেখে খেলেন।
শেষ হাসিটা আর্জেন্টিনাই হেসেছে, বিশ্ববাসীকে হাসিয়েছেন ফুটবলের ক্ষুদে যাদুকর লিওনেল মেসি। মজার ব্যাপার ফেবারিট আর্জেন্টিনা আগের দুই বারের মতো এবারও কষ্ট করে বিশ্বকাপ জিতেছে- যা এখন বাসী খবর।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:২০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


