অহেতুক অপমান.....
ভালমানুষি কারে কয়?
অন্যের অসুবিধার খেয়াল রাখে যে, এবং অন্যের অনিষ্ট করতে প্রবল অনীহা যার, সে-ই ভালমানুষ। এই ‘অন্য’টি যে-ই হোক- চেনা, অচেনা, কিংবা চেনা হয়েও শত্রুমনোভাবাপন্ন- তার প্রতি ব্যবহারে আমি নিজ সুনীতিচ্যুত হবো না; যা ভালমানুষের অঙ্গীকার। এগুলো সভ্যতারও মূল শর্ত। তাই সভ্যতা মূলত যা শিখায়, তা হলো আত্মসংবরণ। আকাঙ্ক্ষাকে বেলাগাম না হতে দিয়ে, আত্মসমীক্ষণ নিরন্তর জারি রাখার অভ্যাসই সভ্যতা।
"কাঁটার আঘাত দেও গো যারে তার
ফুলের আঘাত সয় না....."
মানুষ শারীরিক আঘাত যদিও বা ভুলে যায় অপমান আর বেইমানি ভোলে না। এই দুটো ব্যাপার অন্তরে খোদাই হয়ে যায় সারাজীবনের মতো। যে মানুষ অন্যের উপকার, ভালোবাসা, সম্মানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে সে মানুষ অন্যের কাছে এতটাই লঘু আর হীন হয়ে যায় যে হাজার চেষ্টা করেও সেই দাগ মোছে না। তেমনই হলো অপমান।
একটি সম্পর্ক পারস্পরিক সম্মান আর শ্রদ্ধাবোধের ওপর নির্ভরশীল। অন্যের ত্রুটি-বিচ্যুতি যখন অপরের সাথে যুদ্ধ জেতার হাতিয়ার করে নেয় কেউ, তারচেয়ে নগ্নতা এবং জঘন্যতা আর কিছুতে নেই।
তিনি যা করেছিলেন, তা যদি ভালমানুষি হয়, তবে খারাপমানুষি বস্তুটি কী, ভেবে অনেকেই স্তম্ভিত! কারণ তিনি আগাগোড়া অভদ্রতা ও গালমন্দের উপর ভর করে চলছেন, তাঁর পূর্ণ লেখাটিই নোংরামো হিংসা দ্বেষভিত্তিক। অন্যকে অসম্মান করতে যেয়ে যেখানে নিজেই ভালমানুষ হওয়া দূরের কথা, নিজেকে নিশ্চিত অমানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কবি গুরুর ভাষায়- "আসলে ভালমানুষ হওয়ার জন্য কাউকে অহেতুক অপমান অপদস্ত করা যে নিজের ভালো মানুষ হবার প্রবল প্রতিবন্ধকতা, তার প্রকৃত অর্থ যে ভীরু-ভীরু ভাব লইয়া সরিয়া-সরিয়া থাকা, কাড়িয়া লইতে না পারা, এবং পরিণতিতে বিশ্রী ভাবে পরাজিত হওয়া, ইহা লইয়া কাহারও কোনও সন্দেহ নাই।"
বাসে যে আমি অন্যের পা মাড়াইব না, তাহা মর্দিত পায়ের অধিকারীর নিকট হইতে আমাকে শিখতে হইবে কেন! আমি প্রথম হতেই সচেতন থাকব, যেন কারও কষ্টের কারণ না হই। কথা বলতে যেয়ে আমি নিজের প্রতি নজর রাখব, আসর জমাবার তাগিদে আমি যেন কাউকেও, কোনও দূর দেশের অপরিচিত গোষ্ঠীকেও, অহেতুক অপমান না করি। মুশকিল হল, এই সভ্য ভদ্র ভাল মানুষ চিরকালই সংখ্যাগরিষ্ঠ অশিষ্ট অমার্জিত কর্কশের নিকট হেরে বসে, অন্তত সাময়িক ভাবে।
এখন অশিষ্টতা উদ্যাপনের যুগ। অশ্লীল আত্মবিজ্ঞাপনকে এখন বলে মার্কেটিং, অন্যকে অনর্গল অপমান করার প্রবণতাকে বলে সপ্রতিভতা, হিংসা ও আঘাত করার অভ্যাসকে বলে আগ্রাসন। কেবল স্যোশাল মিডিয়ায়ই নয়, জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই, সকল নম্রতা নিয়ম রীতি নীতি ভুলে, আদিম দখল-মানসিকতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া এখন দস্তুর। ভালমানুষ মিনমিনে, তার যথেষ্ট দম নাই, তাই সে লড়তে পারতেছে না। আর অজুহাত হিসাবে বলতেছে, আমি লড়াই করতে চাহি না, এটাই চালু ধারণা। ভালমানুষও দেখতেছে, তার হাত হতে অ-ভালগণ কেড়ে নিচ্ছে চাকুরি সম্মান প্রেম যৌনতা লবেঞ্চুস। নিজেকে তার নিয়ত বিপন্ন মনে হতে থাকে। এক সময় আত্মসন্দেহ, এমনকী আত্মঘৃণার দিকেও সে ঢলে পড়ে। নীতি-বেতোয়াক্কা জয়ীগণের অট্টহাসি তার মরমে আছড়ায় ও বস্তুগত ব্যর্থতার দায় তার স্কন্ধে ভূতের ন্যায় চেপে বসে। তবে তার সাময়িক পরাজয় ঘটবে, যদি সে 'দেখিয়াশুনিয়া খেপিয়া বলিয়া বসে, আর ভালমানুষি নহে, এই বার দস্তানা খুলিয়া ফেলিবার পালা'।
একটা সময় মানুষের এতশত ডিগ্রি ছিলো না, ঘরে ঘরে এত শিক্ষিত লোক ও ছিলো, গুটিকয়েক শিক্ষিত লোক সমাজে কাঠি নাড়তো। তবে সে সময় মানুষের মাঝে ছিলো নৈতিকতা, মনুষ্যত্ব, জীবনবোধ। তখন মানুষ এতটা হিংস্র ছিলো না। একে অপরের কষ্টে কষ্ট পেত।
কিন্তু আজ এসব তলানিতে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, নৈতিকতা, মনুষ্যত্ব এসব কি কিছু না।
অপরকে দোষীর কাঠগোড়ায় দাঁড়া করানোর আগে আমাদের আজকাল সত্য মিথ্যে যাচাই করার ও সময় হয় না কারণ আমরা প্রত্যেকেই বড্ড বেশি স্বেচ্ছাচারিতাই ব্যস্ত। এই যে ধরুন, আপনি যদি আপনার জুনিয়রকে প্রাপ্য সম্মান দেন তাহলে সে আপনাকে সর্বদা সম্মানের আসনেই রাখবে এটাই আমরা অনেকে করি না। প্রতিটি মানুষের নিজস্ব সম্মান রয়েছে। কিন্তু এটা আমরা অনেকেই মানতে নারাজ। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ যে একটা মানুষের ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্ব বহিঃপ্রকাশের অদ্ভুত সুন্দর একটা মাধ্যম তা আমরা ভুলে গিয়েছি। সত্যি বলতে, জীবনবোধ, মনুষ্যত্ব, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এসব সমাজে বিকলাঙ্গ হয়ে পড়েছে।
আমরা যখন কোনকিছুতে একটা মানুষকে দমিয়ে রাখতে না পারি তখন যে কোন প্রকার হীন কাজ করতে দ্বিধাবোধ করি না। অন্যকে ছোট বা হেয় করার মাঝে কোন কৃতিত্ব নেই। বরং নিজের ভিতরের সবচেয়ে নিকৃষ্ট রুপটাকে আপনি প্রকাশ্যে বের করায় আপনি অপরের কাছে ছোট হচ্ছেন। অবশ্য এসব নিয়ে এই প্রকৃতির লোকজনের তেমন মাথাব্যাথা নেই। "যে সহে সে রহে"- সত্যিকারের মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা কখনো দমিয়ে রাখা যায় না।
বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আপনি সার্টিফিকেটধারী হতে পারেন, রাষ্ট্রের খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রোফাইলের মানুষ তবে আপনার মাঝে নেই মনুষ্যত্ব, মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করার গুণ। সহজ কথায়, আমি জীবনে কতটা এ্যাচিভ করেছি তা দেখিয়ে সেই অপমানের বদলা নেওয়া আমার স্বভাব নয়। জীবনের অনেক অপমান আমাকে স্তম্ভিত কিম্বা কিছুদিনের জন্য মানসিক কষ্ট দিলেও পরক্ষণে আমাকে অন্য এক পথ দেখিয়েছে। যা আমার নিজের পথ।
অতিরিক্ত ক্ষমতা অর্জন, অঢেল অর্থ উপার্জন করার জন্য মানুষের মাঝে যে ছোটাছুটি চলছে এসবের মাঝে জীবনবোধ, মনুষ্যত্ববোধ ও পারপাস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আজকাল পদপিষ্ট হয়ে পড়েছে। "সুবোধ" সত্যিই শহর ছেড়েই শুধু নয়, গোটা পৃথিবী থেকে পালিয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:২৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



