সে হারাল কোথায় কোন দূর অজানায়....
একদা বিজয়ের মাসে, স্বাধীনতার মাসে শাহনাজ রহমতুল্লাহর গান ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। দেশাত্মবোধক গান মানেই শাহানাজ রহমতুল্লাহ, দেশপ্রেমের গান মানেই শাহানাজ রহমতুল্লাহ- যা এখন আমরা অনেকেই ভুলে গিয়েছি।
প্রায়শই আমি তাঁর গান শুনি। যখন তাঁর গান শুনি তখন অন্যরকম আনন্দ এবং বিষাদ জড়িয়ে ধরে।
আনন্দঃ- এত ভালো গান যে শুনতে শুনতে রাত পেরিয়ে যায়! ক্লান্তি লাগে না কোনও।
বিষাদঃ- এমন গুণী শিল্পীর অস্তিত্বের খবর বর্তমান প্রজন্মের তরুণ তরুণীরা অনুভব করতে পারলো না।

বাংলাদেশের শিল্পীদের মধ্যে ফিরোজা বেগম, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, কলিম শরাফি, ফরিদা পারভিন, সুবীর নন্দী, ইফাফত আরা দেওয়ান, নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, অদিতি মহসিন, পাপিয়া সারওয়ার, শামা রহমান, ফেরদৌস আরা, তপন চৌধুরীদের আমরা নিয়মিত শুনি। কিন্তু ভুলে গিয়েছি কিংবদন্তী শিল্পী শাহানাজ রহমতুল্লাহর নাম।
অথচ শাহনাজ রহমতুল্লাহ- 'যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়...সে হারালো কোথায় কোন দূর অজানায়?'
এখানকার কোনও শিল্পীকে তাঁর নাম করতে শুনি না। বিষাদের পাশে নিজেদের জন্য জড়ো হয় ধিক্কার। আমরা বাংলা গান নিয়ে গর্ব করি, বাংলা গান চর্চা করি। কিন্তু শাহানাজ রহমতুল্লাহর নাম ভুলে গিয়েছি!
শিল্পী শাহানাজ রহমতুল্লাহর যা একক কীর্তি, তা আর কোনো বাঙালি কণ্ঠ শিল্পীর নেই। ওপার বাংলার শিল্পীদের বাদ দিলে আমাদের রুনা, সাবিনা এবং আর কারও নেই। আমার মতে, ‘ভারতে যেমন লতা মঙ্গেশকর, পাকিস্তানে যেমন নুরজাহান, বাংলাদেশে তেমন শাহনাজ রহমতুল্লাহ।'
এক যুগেরও বেশি আগে বিবিসি এক সমীক্ষা চালিয়েছিল দুই বাংলার সর্বকালের সেরা ২০ গান নিয়ে। সেখানে শাহনাজেরই চারটি গান ছিল। সেই সেরা ২০ টি গানের তালিকাটা একবার দেখে নেইঃ-
(১) আমার সোনার বাংলা (রবীন্দ্রসঙ্গীত)
(২) মানুষ মানুষের জন্য (ভূপেন হাজারিকা)
(৩) আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো(কোরাস)
(৪) কফি হাউসের সেই আড্ডা (মান্না দে)
(৫) এক সাগর রক্তের বিনিময়ে(স্বপ্না)
(৬) আমি বাংলায় গান গাই (প্রতুল মুখোপাধ্যায়)
(৭) মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো (আপেল মাহমুদ)
(৮) তুমি আজ কত দূরে (জগন্ময় মিত্র)
(৯) এক নদী রক্ত পেরিয়ে (শাহনাজ রহমুতুল্লাহ)
(১০) ধনধান্যপুষ্প ভরা (দ্বিজেন্দ্রগীতি)
(১১) মুছে যাওয়া দিনগুলি (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়)
(১২) সালাম সালাম হাজার সালাম (আবদুল জব্বার)
(১৩) জয় বাংলা, বাংলার জয় (শাহনাজ রহমতুল্লাহ)
(১৪) খাঁচার ভিতর অচিন পাখি (ফরিদা পারভিন)
(১৫) একবার যেতে দে না (শাহনাজ রহমতুল্লাহ)
(১৬) কারার ওই লৌহকপাট(কোরাস)
(১৭) এই পদ্মা এই মেঘনা (ফরিদা পারভিন)
(১৮) চল, চল চল (কোরাস)
(১৯) একতারা তুই দেশের কথা বল (শাহনাজ রহমতুল্লাহ)
(২০) তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয় (আবদুল জব্বার)

২০০৬ সালের ওই ভোট জরিপের তালিকা শুনে প্রথমে মনে হবে, ভোটাররা বেশি বাংলাদেশি বলেই এই তালিকা। সেটা কোনও যুক্তি নয়। ওপার বাংলার ভোটারদের তো কেউ ভোট দিতে বারণ করেননি। এখানেই যেন জিতে যান শাহনাজ। তাঁর গানগুলোর লাবণ্য জেগে থাকে মন জুড়ে।
তাঁর ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়/ যেথায় কোকিল ডাকে কুহু দোয়েল ডাকে মুহু মুহু নদী যেথায় ছুটে চলে আপন ঠিকানায়।’ গানে ‘একবার’ কথাটার আলতো উচ্চারণ মন দিয়ে শুনবেন। ওটাই শাহনাজের ট্রেডমার্ক ছিল। তাঁর গলা শুনে লক্ষ লক্ষ বাঙালি প্রেমে পড়েছে, বিরহযন্ত্রণায় জ্বলেপুড়ে মরার ফাঁকে সামান্য স্বস্তি পেয়েছে- আধুনিক গানে, সিনেমার গানে।
বাংলাদেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা গায়িকার চেহারা কী ভাবে পাল্টে গিয়েছে, দেখলে অবাক লাগে। অতি স্টাইলিস্ট তরুণী শাহানাজ ধীরে ধীরে একেবারে গোঁড়া ধর্মভীরু হয়ে গেলেন। এর পিছনে কী যন্ত্রণা, কী দুঃখ রয়েছে, কেউ বোঝার চেষ্টা করল না।
আরও অবাক লাগে, যে ভাবে তিনি আওয়া্মী জমানায় গানের জগত থেকে চূড়ান্ত বঞ্চিত হয়ে গেলেন। কত অজস্র জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গান ছিল তাঁর। তিনিই গেয়েছিলেন,- ‘একতারা তুই দেশের কথা বল।’ গেয়েছিলেন,- ‘আমার দেশের মাটির গন্ধে’। অথচ তাঁর গায়েই লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে স্বাধীনতা বিরোধীর তকমা। কারণ?
আবুল বাসার রহমতুল্লাহ শাহনাজের স্বামী, তিনি জেড ফোর্সের একজন মুক্তি যোদ্ধা। সেই সূত্রে তাঁর সঙ্গে জিয়াউর রহমানের ভালো সম্পর্ক ছিল। তাই তাঁর গায়ে বিএনপির দাগ লাগিয়ে দেওয়া হয়। ভুলে যাওয়া হল, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ বাংলার ঘরে ঘরে বাজত। কত মুক্তিযোদ্ধাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। বা ‘বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ’ গানটি।
তাঁর আর একটি দেশাত্মবোধক গান ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’ শাহানাজ রহমতুল্লাহর কণ্ঠে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল। সে গানকে বিএনপি দলীয় সঙ্গীত করে। ব্যস, বাঙালির প্রিয় গায়িকার সর্বনাশটি সম্পন্ন হয়ে যায়।
এক টিভি সাক্ষাৎকারে শাহনাজকে দেখেছিলাম, তিনি এ নিয়ে প্রবল প্রতিবাদ করে বলেছিলেন,- "এটা অত্যন্ত অন্যায়। আমার সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক সম্পর্ক নেই- আমি একজন শিল্পী। আমার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নাই। আমি মনে প্রাণে বশ্বাস করি- বংগবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাংগালী, যিনি আমাদের স্বাধীনতার মহা নায়ক। আমার বড়ো ভাই প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ আনোয়ার পারভেজ, ছোট ভাই জনপ্রিয় নায়ক জাফর ইকবাল এবং স্বামী রহমতুল্লাহ সবাই মুক্তি যোদ্ধা। "

কে শোনে কার কথা? বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আল মাহমুদের মতোই এই গায়িকাকে দিয়ে দেওয়া হয় স্বাধীনতা বিরোধী তকমা। মৃত্যুর পর শাহনাজের মরদেহ শহিদ মিনারে রাখা হয়নি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। তিনি নিজেই সেটা চাননি- যা জীবিত কালে বলে গিয়েছিলে। কতটা অভিমান বুকে জমা থাকলে এমন ভাবনা হয়?
এমন কালজয়ী শিল্পীদের নিয়ে রাজনীতি ভালো লাগে না। এখানে কীসের বিএনপি, কীসের আওয়ামী লীগ? এত এত দেশপ্রেমের গান, এত লোককে উদ্দীপ্ত করা- এ সব কি কিছুই নয়?
বাংলাদেশের নামী অভিনেত্রী ঝরনা বসাক পাকিস্তানে শবনম নামে সুপারস্টার ছিলেন। লাহোরে অসংখ্য সুপারহিট সিনেমা তাঁর। নুরজাহানের অসংখ্য গান তাঁর লিপে। ঢাকায় তবু তিনি আড়ালে। এভাবেই হারিয়ে গিয়েছিলেন আর এক প্রখ্যাত শিল্পী বশীর আহমেদ!
আওয়ামী টেলিভিশন শাহনাজকে অলিখিত ভাবে নিষিদ্ধ করলে একযুগ শাহনাজ প্রকাশ্যে গান গাওয়া কার্যত বন্ধ করে দিয়েছিলেন। টিভি দেখতেন না। রেডিও শুনতেন না। গান থেকে বিচ্ছিন্ন। বাড়ির ছাদে ছাদ বাগান করে পরিচর্যা করে সময় পার করতেন তিনি।
তাঁর বিখ্যাত গানের কথাই শেষ তাঁর জীবন হয়ে যায়। ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়’- এই কারণ খুঁজতে গিয়ে তাঁর জীবনের আর একটা দিক পাওয়া যায়। সুর সেখানেই আসলে বেসুরো হয়ে যায়। শাহনাজ ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন, তাঁর স্বামীর বন্ধু ঢাকার পরিচিত মাফিয়া ডন আজিজ মহম্মদ ভাইয়ের সাথে। নানা রহস্য তাঁকে ঘিরে। বেনামে লগ্নি করতেন সিনেমায়। সেই লোক তাঁর টিনএজ(১৬ বছর) মেয়েকে ফুঁসলিয়ে নিয়ে চলে যায় লন্ডন এবং বিয়ে করে। মেয়েকে ফিরে পাওয়ার অনেক চেষ্টা করেও ব্যার্থ হন। এই সব ঘটনাও শাহনাজকে মূলস্রোত থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার অণুসংগ।
তাঁর জীবন হয়ে ওঠে তাঁর চোখে জল আনা গানগুলোর মতো- ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়, যে ছিল হৃদয়ের আঙিনায়/ সে হারাল কোথায় কোন দূর অজানায়, সেই চেনামুখ কতদিন দেখিনি/ তার চোখে চেয়ে স্বপ্ন আঁকিনি’।
মৃত্যুর কিছুদিন আগে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে শাহনাজ বলেছিলেন, "এখন আমার নামাজ আর কোরআনের অনুবাদ পড়েই সময়টা বেশ কাটছে। হজ্জ করে আসার পর দিন থেকেই আর গান করতে ইচ্ছা করেনি। আমি নমাজ পড়া শুরু করেছিলাম। পার্থিব বিষয়ে আর আগ্রহী নই আর। বাকি জীবন সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ইবাদত বন্দেগী করে কাটিয়ে দিতে চাই। যদিও হিন্দি, উর্দু, আরবি ফারসি সহ বেশ কয়েকটি ভাষায় কথা বলতে পারি, গান গাইতে পারি কিন্তু প্রথম জীবনে কোরআন পড়া শেখা হয়নি। এখন একজন বাড়িতে এসে কোরান পাঠ শেখান।"
'গানের জগৎকে মিস করেন না?'
জবাবে শাহনাজ বলেছিলেন,- "পঞ্চাশ বছরের ওপরে তো গেয়েছি, পৃথিবীর পঞ্চাশের বেশি দেশ দেখেছি, শো করতে দেশ-বিদেশ ঘুরেছি। শুধু আমেরিকাতেই ২০ বার গিয়ে স্টেজ শো করেছি প্রতিটা স্টেসটে। আর কত গাইব?"
শাহানাজ রহমতুল্লাহর কথা শুনে তাঁর আর এক বিখ্যাত গানের কথা মনে পড়ে,- "আমি তো আমার গল্প বলেছি, তুমি কেন কাঁদলে?"
শাহনাজ রহমতুল্লাহর গাওয়া কালজয়ী গানগুলো হল:-
১. এক নদী রক্ত পেরিয়ে
২. জয় বাংলা বাংলার জয়
৩. একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়
৪. একতারা তুই দেশের কথা বল।
৫. প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ
৬. আমার দেশের মাটির গন্ধে
৭. আমায় যদি প্রশ্ন করে
৮. ফুলের কানে ভ্রমর এসে
৯. সাগরের সৈকতে, কে যেন দূর হতে আমারে ডেকে ডেকে যায় আয়, আয়, আয় পারিনা তবু যেতে ...
১০. পারি না ভুলে যেতে
১১. যেভাবে বাঁচি বেঁচে তো আছি
১২. আমি সাত সাগরের ওপার হতে
১৩. শুনেন শুনেন জাঁহাপনা
১৪. কে যেন সোনার কাঠি ছোঁয়ায় প্রাণে
১৫. আমি যে কেবল বলে তুমি
১৬. একটু সময় দিলে না হয়
১৭. স্বপ্নের চেয়ে সুন্দর কিছু নেই
১৮. আবার কখন কবে দেখা হবে
১৯. যদি চোখের দৃষ্টি দিয়ে চোখ বাঁধা যায়
২০. তোমার আগুনে পোড়ানো এ দুটি চোখে
২১. তুমি কি সেই তুমি
২২. ও যার চোখ নাই
২৩. ঘুম ঘুম ঘুম চোখে
২৪. আমি তো আমার গল্প বলেছি
২৫. বন্ধুরে তোর মন পাইলাম না
২৬. খোলা জানালায় চেয়ে দেখি তুমি আসছো
২৭. একটি কুসুম তুলে নিয়েছি
২৮. আমায় তুমি ডাক দিলে কে
২৯. ওই আকাশ ঘিরে সন্ধ্যা নামে
৩০. আমার ছোট্ট ভাইটি মায়ায় ভরা মুখটি
৩১. আষাঢ় শ্রাবণ এলে নেই তো সংশয়
৩২. বারোটি বছর পরে
৩৩. আরও কিছু দাও না দুঃখ আমায়
৩৪. আমি ওই মনে মন দিয়েছি যখন
৩৫. আমার সাজানো বাগানের আঙিনায়
৩৬. দিগন্ত জোড়া মাঠ
৩৭. তোমার আলোর বৃন্তে
৩৮. এই জীবনের মঞ্চে মোরা’ ছাড়াও অসংখ্য গান।
কৃতজ্ঞতাঃ শিল্পী শাহানাজ রহমতুল্লাহ উইকিপিডিয়া।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:০৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



