যথার্থ জ্ঞানীর অন্যতম লক্ষণ- বিষয়টা সহজ করে বোঝা এবং বোঝাতে পারা।
ছেলে বেলায় ভাবসম্প্রসারণ করতে হতো- "আপনারে বড় বলে বড় সেই নয়, লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়"....অর্থাৎ নিজের বিষয়ে কথা বলা সমীচীন নয়। মানুষ নিজে নিজেকে বড় করে দেখানো তার হীন প্রবৃত্তি মাত্র- যা করে কখনও বড় হওয়া যায় না।
ছাত্রজীবনে এক অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষক বলেছিলেন, "বিষয়ের উপর দখল বা জ্ঞান আর ভালো পড়াতে পারা, দুটো আলাদা ব্যাপার।"
অর্থাৎ কেউ ভালো জানলেই যে ভালো পড়াতে পারবেন, এমন নাও হতে পারে। আমি একমত হলাম না। স্যার বললেন, দ্যাখো, তোমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে অমুকের বাড়িটা কোথায় আর তুমি যদি রাস্তাটা ভালো চেনো, তাহলে তুমি ঠিকই বোঝাতে পারবে কীভাবে সেই বাড়িতে যেতে হবে। কেউ হয়ত একেবারে ছবির দৃশ্যকল্পের মতো বোঝাবে, আর তুমি হয়ত একটু কম করে অর্থাৎ বললে- এইতো দুইশো আড়াইশো গজ দূরে....
তোমার উত্তরে প্রশ্নকর্তার কনফিউশন থাকলে সে প্রশ্ন করে ক্লিয়ার করে নেবে। কিন্তু বাড়িটা ঠিকঠাক চিনলে দুজনের ডিরেকশনেই তার পৌঁছাতে অসুবিধে হবে না। একইভাবে, বড় লেকচার ক্লাসের কথা আলাদা, কিন্তু ইনফর্মাল পড়ানো বা ছোট গ্রুপের পড়ানোয় বিষয়টা যে জানে, সে যথেষ্ট সহজ করে বুঝিয়ে দিতে পারে। জানার মধ্যে কোনও অস্পষ্টতা থাকলে সেটা পড়ানোতেও রিফ্লেক্টেড হবে।
সেই থেকে কথাটা আমার মনে গেঁথে রয়েছে এবং মিলিয়ে দেখেছি- কথাটা প্রায় সব ক্ষেত্রেই ঠিক।
কয়েক দিন আগে, একটা সেমিনারে অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয়েছিল....তা নিয়ে এই ব্লগে একটা পোস্ট লিখেছিলাম। সেই সেমিনারে একজন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ বলছিলেন, আর্থিক বৃদ্ধি আর অসাম্যের কথা। বলছিলেন, বৃদ্ধি বাড়লে অসাম্যও বাড়বে। তার মোকাবিলা করা যায় কীভাবে, সেটাই চ্যালেঞ্জ। মানে, উপযুক্ত উপায় কী, বা সম্ভাব্য ও গ্রহণযোগ্য উপায় কী কী। যেমন, বৃদ্ধির হার কমিয়ে দিলেই অসাম্যও কমে যাবে- কিন্তু তা গ্রহণযোগ্য রাস্তা নয়, কেননা তাতে কারোরই উপকার হবে না।
বলতে গিয়ে তিনি দুর্দান্ত একটা উদাহরণ দিলেন। ধরুন, একটা মসৃণ হাইওয়ে। আমার একটা আটো রিকশা কিম্বা টয়োটা করোল্লা কার আছে, আর আপনার আছে রেঞ্জ রোভার। অর্থাৎ আপনার সঙ্গে আমার এমনিতেই অনেকখানি দুরত্ব- বিশাল অসাম্য। এমন মসৃণ রাস্তা পেলে সে দূরত্ব আরও বহুগুণে বেড়ে যাবে। অন্যদিকে ভাঙাচোরা খানাখন্দে ভরা রাস্তায় চললে রেঞ্জ রোভার নিজের গতিতে যেতে পারবে না, টয়োটা করোল্লা তো তেমনই - অসাম্য নতুন করে সেভাবে বাড়বে না। কিন্তু হাইওয়ের বদলে রাস্তা খানাখন্দে ভরিয়ে তুললে টয়োটা করোল্লা চালকও খুব উপকৃত হবেন, এমন সম্ভাবনা কম। কাজেই...
অর্থনীতির তত্ত্বকথাটথা নয়, শুনতে শুনতেই আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই ছাত্রজীবনে শোনা পড়াতে পারার গল্পটা। সত্যিই, যিনি বিষয়টা জানেন, তিনি বলবত তরল করে আরেকজনকে বুঝিয়েও দিতে পারেন। এমনকি আনাড়িকেও। আর যিনি জানেন না, তিনি...
এসব কথা বলার ফাঁকে নিজের কথা ভাবছিলাম। ভেবে দেখলাম, কোনও বিষয়ই আমি, কাউকেই সহজ করে বুঝিয়ে উঠতে পারি না। জ্ঞানীগুণী লোকের সঙ্গে কথা বলার এই এক সাইড-এফেক্ট। নিজের অপদার্থতা এমন কারণে-অকারণে এমন দিনের আলোর মতো নিজের কাছেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে অল্পবিস্তর আত্মপ্রসাদ লাভের আশাটুকুনি থাকে না। সেটা মোটের উপর ভালো নাকি খারাপ, বুঝতে পারিনা। ইন ফ্যাক্ট, এ বিষয়ে প্রাজ্ঞ কাউকে চোখে পড়েনি। অবশ্য খুঁজে পাওয়াটাও তো মুশকিল। সত্যি বলতে কি, নিজের অপদার্থতা বিষয়ে যিনি প্রাজ্ঞ, তিনি কি আর অপদার্থ হতে পারবেন - এবং উল্টোটাও সত্যি।
কাজেই...'আমারে না যেন করি প্রচার আমার আপন কাজে, তোমারই ইচ্ছা করো হে পূর্ণ আমার জীবন মাঝে'.....(যাহার জন্য প্রযোজ্য)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জানুয়ারি, ২০২৩ সকাল ১১:০৫