ভালোবাসা দিবসে হারিয়ে গিয়েছে জয়নাল দীপালি সাহার আত্মত্যাগ….
১৪ ই ফেব্রুয়ারী ছিলো শহীদ জয়নাল-দীপালীর আত্মত্যাগের দিন। কিন্তু কোথাও এই দিনটি পালিত হবার খবর দেখলাম না। তবে শহীদ জয়নাল-দেলোয়ারের বন্ধু ডক্টর ওয়াদুদ এর হাতীরপোল ইস্টার্ণ প্লাজা সংলগ্ন বাড়ির সামনে তাঁদের স্মরণে একটা বড়ো ব্যানার দেখলাম। ধন্যবাদ ডক্টর আবদুল ওয়াদুদ।
১৯৮২ সনের ২৪ মার্চ এরশাদ সামরিক শাসন জাড়ি করার পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদ মুখর হয়েছিল।
১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের ২১ বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশে কুদরত -ই- খোদা শিক্ষানীতির বিপরীতে স্বৈরাচারী এরশাদের নির্দেশে আবির্ভূত হল মজিদ খান শিক্ষানীতি। মজিদ খানের প্রস্তাবিত শিক্ষা নীতির ছোট্ট একটাই নীতিই বলি- 'আপনি যতই দূর্বল ছাত্র হন- সমস্যা নাই, আপনি যদি টাকা ঢালতে পারেন তবে আপনি যতই ফেল করুন, আপনি উচ্চ শিক্ষা পাবেন। আপনার টাকা নাই, আপনার শিক্ষা পাওয়ার অধিকার নাই। শিক্ষার মাপকাঠি মেধা নয়, অর্থ।'
এই নীতির বিপক্ষে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন সহ সকল ছাত্র সংগঠন এক হয়ে যায় ১৯৮২ এর ১৭ সেপ্টেম্বর। দিনটি ছিল ১৯৬২ এর শিক্ষা আন্দোলনের ২০ বছর পূর্তি। ২১ তারিখেই গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। জানুয়ারিতে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতিকে গ্রেফতার করা হলে আন্দোলন আরো বেগ পায়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৪ ফেব্রুয়ারি সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচী দেওয়া হয়।
ভালোবাসা দিবস পালনের ‘মহা’ গুরুত্ব আমার বলা অপ্রয়োজন। কারণ হাজার হাজার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ভালবাসা দিবসের ‘গুরুত্ব’ কে আলোকিত করতে সহস্র শ্লোগানের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে প্রতি বছরই। এই দিনে ফুল থেকে শুরু করে কার্ড, চকলেট, ডায়মন্ড, প্লাটিনাম মার্কেটিং দিনকে দিন অসাধারণত্ব পেয়েই চলছে। হয়তো ভবিষ্যতে ফুল, চকলেট, ডায়মন্ড, প্লাটিনামের
মতোই ইউরোনিয়াম, চাঁদের মাটিও বিক্রি হবে যা মৌসুমি ভালোবাসা ক্রেতা বিক্রেতাদের পছন্দের গিফট হবে। এইদিনকে ঘিরে নাটক, কনসার্ট এর ধুম নতুন কিছু নয়। এই দিন যেহেতু এত আয়োজনপূর্ণ সেহেতু ভালাবাসা দিবস ছাড়া ভালোবাসার যথার্থ প্রকাশ অসম্ভব- আমরা তা ধরেই নিতে পারি।
১৯৯৩ সালের দিকে আমাদের দেশে ভালোবাসা দিবসের আবির্ভাব ঘটে। সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব শফিক রেহমান পড়াশোনা করেছেন লন্ডনে। পাশ্চাত্যের রীতিনীতিতে তিনি ছিলেন অভ্যস্ত। দেশে ফিরে তিনিই ভালোবাসা দিবসের শুরু করেন। এ নিয়ে অনেক ধরনের মতবিরোধ থাকলেও শেষ পর্যন্ত শফিক রেহমানের চিন্তাটি নতুন প্রজন্মকে বেশি আকর্ষণ করে মূলত দৈনিক প্রথম আলো এবং যায়যায়দিন পত্রিকার ব্যপক প্রচারে। ১৪ ফেব্রুয়ারিকে শফিক রেহমান আমাদের দেশে ‘ভালোবাসা’ দিবস হিসেবে পরিচিত করানোর আগে দিনটি ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ’ দিবস হিসেবেই পালিত হত।
১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বাঙলাদেশের মাটি লাল হয়েছিল জয়নাল এবং শিশু দীপালি সাহার রক্তে- এ ইতিহাস আমাদের জানা সত্ত্বেও আরেকবার স্মরণ করতে কোন ক্ষতি নাই।
এখনো আমার স্মৃতিতে দগদগে- ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বাংলাদেশে সামরিক শাসন জারি করা হলে সকল রাজনৈতিক দল এবং তাদের কর্মকাণ্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা নেমে আসে। নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে তৎকালীন ছাত্র সমাজ বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রথম থেকেই সামরিক শাসনের বিরোধিতা করে আসে। ৮ নভেম্বর ১৯৮২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের মিছিলে পুলিশি হামলার প্রতিবাদে তার পরদিন মধুর ক্যান্টিনে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’। ১১ দফার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ‘কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের’ অন্যতম প্রধান দাবী ছিল এরশাদ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রী ড.আব্দুল মজিদ খান কর্তৃক ১৯৮২ সালের ২৩ শে সেপ্টেম্বর প্রণীত শিক্ষানীতি বাতিল করার।
এরশাদ এবং তার শিক্ষানীতির বিরোধিতা জোড়াল হয়ে ওঠে ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিক্ষোভ কর্মসূচিকে সমর্থন দিয়ে ওই দিন হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী ঢাকার বুকে নেমে পড়ে। বিশাল এক মিছিল সচিবালয়ের অভিমুখী যাত্রা করে স্মারকলিপি পেশ করার উদ্দেশ্যে। মিছিলটি পুলিশের দ্বারা বাধা-প্রাপ্ত হয় হাইকোর্ট-মোড়ে। পুলিশের বসানো কাঁটাতারের বেড়ার উপর উঠে পড়ে অনেক ছাত্র। জ্বালাময়ী সব শ্লোগানে কেপে ওঠে পুরো এলাকা। হঠাৎ করেই মিছিলে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। সেই সাথে নিরস্ত্র ছাত্র-ছাত্রীদের লক্ষ্য করে টিয়ার গ্যাস আর গুলি ছোড়ে পুলিশ। গুলির আঘাতে প্রাণ হারায় জয়নাল। আহত হয় জাফর, আইয়ুব, কাঞ্চনসহ আরো অনেকে। শিশু একাডেমীতে ছড়িয়ে পড়া সংঘর্ষে জীবন হারায় ছয় বছরের শিশু দীপালি সাহা।বতখন ছিল কেবল রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বিটিভি। সেই বিটিভির খবরেই স্বীকার করা হয় ১০ জনের মৃত্যুর কথা, ১৩১০ জনকে এই এলাকা থেকে গ্রেফতারের কথা।
দীপালি সাহা, জয়নালদের স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে এর পরের বছর মানে ১৯৮৪ সাল থেকে মোটামুটি ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ১৪ ফেব্রুয়ারি পালন করা হতো ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে।
১৪ ফেব্রুয়ারি ‘ভালবাসা দিবস’ বাংলাদেশে প্রচলিত হওয়ার পর থেকে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ইতিহাস অনেকটাই ঢাকা পড়ে যায়। তারপরও কেউ কেউ জয়নাল- দেলওয়ার-দীপালীদের মনে রেখেছেন।
‘ভালবাসা দিবস’ যার খুশি সে পালন কিংবা অ-পালন করতেই পারে তবে ১৯৮৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি যারা জীবন দিয়েছিলেন তাঁদের স্মরণ আমরা করে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শহীদদের প্রতি সম্মান জানাতে পারি।।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




