‘শিশুশিক্ষা’ ও 'সহজ পাঠ'......
"জল পড়ে/ পাতা নড়ে", "সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি", "পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল", "পড়ালেখা করে যেই, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সেই"- ইত্যাদি মদনমোহন তর্কালঙ্কারের বিখ্যার ছড়া কবিতা- যা বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই জানে না। জাতি হিসেবে বাঙালির যত বদনাম, ইতিহাস ঐতিহ্য বিস্মৃতির প্রবণতা তার অন্যতম। বাঙালি খুব সহজে তার ইতিহাস ভুলে যায়, তার ভূগোল ঘুলিয়ে ফেলে, তাদের মহান মানুষদের মুখ মনে রাখে না। এরই ফলে বাঙালির জীবনে যে সুবর্ণ সময়গুলো এসেছে, যে অপরূপ মানুষেরা এসেছেন, বাঙালি তাদের ভুলেছে, পাশ কাটিয়ে নিজের অকিঞ্চিৎকরতাকেই উদযাপন করেছে!
আমরা কমপক্ষে ষাটোর্ধ যারা, মদনমোহন তর্কালঙ্কার বই পড়ে শিশু শিক্ষায় হাতে খড়ি নিয়েছিলাম তাদের মনে মদনমোহন সদা স্মরণীয় থাকলেও পরবর্তী বাঙালি প্রজন্ম তাঁকে প্রায় ভুলে গিয়েছে। অবশ্য তিনি নিজেও এমন ব্যবস্থা করতেও উদগ্রীব ছিলেন না যে- আমাদের সমাজ যেন তাঁকে কখনও না ভুলতে পারে। নিজের নাম পাথরে বা তাম্রলিপিতে খোদাই করে যাওয়ার স্বভাব ও মানসিকতা মদনমোহনের ছিল না। মদনমোহন একটি পিছিয়ে পড়া অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজের বুকে যা করেছিলেন, নিজের প্রতিভা, মেধা আর বিবেকের তাড়নাতেই করেছিলেন, চিরস্থায়ী কীর্তির জন্য নয়। বাঙালির চোখের সামনে জেগে থাকা মরিচাহীন কীর্তিস্তম্ভ তিনি আজ নন। মদনমোহন তর্কালঙ্কার ভারতীয় উপমহাদেশের ঊনবিংশ শতাব্দীয় অন্যতম পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব। তিনি ১৮৭১ সালের ৩ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার নাকাশীপাড়ার বিল্বগ্রাম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তৎকালীন বাংলা ভাষায় শিক্ষা বিস্তারের জন্য অনেক বড় অবদান রেখে গেছেন। মদনমোহন তর্কালঙ্কার এর শিশুশিক্ষা গ্রন্থটি সেই সময়ে শিশুদের শিক্ষা বিস্তারে খবই গুরুত্ব পূর্ণ ভুমিকা পালন করে।
মদনমোহন একটি ভোরের পাখির মতোই যেন বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর প্রখর দিনের আলোয় উধাও হয়ে গেলেন। এর কারন ছিল তাঁর সুকুমার মন। তেজের চেয়ে আলোর প্রতিই মদনমোহনের আগ্রহ ছিল বেশি। প্রিয় বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সম্পর্ক সর্বদা ভাল ছিল না।

বিদ্যাসাগর আমাদের সমাজের একজন মহান মানুষ। কিন্তু কোনো মানুষই তাঁর বিপুল সামাজিক ব্রতটিকে শুধুমাত্র নিজগুণে পালন করতে পারেন না। বিদ্যাসাগরের কর্মযজ্ঞে মদনমোহন ছিলেন অবিচ্ছেদ্য নাম। এই দুই উজ্জ্বল পুরুষের পারস্পরিক প্রীতি, স্নেহ, নির্ভরতা যেমন ফুটেছে, ঠিক তেমনই উভয়ের মধ্যে গড়ে ওঠা তিক্ত দূরত্ব, ভুল বোঝাবুঝি, ব্যবসায়িক বিভেদও আলোচিত হয়েছে। সেই কাহিনি প্রীতিকর নয়। দুই অভিন্নহৃদয় মনিষীর মধ্যে যে দূরত্ব, সে যেন আমাদের মেধা আর বিবেকের মধ্যে চিড় ধরায়- সেখানেই ব্যথা জাগায়। কিন্তু যা হওয়ার ছিল, তা তো হবেই। মহামানবরাও শেষ অবধি রক্তমাংসেই গড়া। মানুষের প্রতিটি আবেগের তাঁরাও অংশীদার। মানুষের রক্তে মিশে থাকা প্রতিটি অসহায়তার স্বাদ তাঁদেরও নিতেই হয়।
মহাপুরুষের জীবনের কিছু সত্য জনগণের মধ্যে প্রীতিকর নয়। এটাও সত্য, দোষশূন্য মানুষ নেই। উনবিংশ শতাব্দীর যে বড়ো নামগুলো আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে, তাঁদের নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক সর্বদা খুব সরল ছিল না। বিদ্যাসাগর আর মদনমোহন শুধু নন, বিদ্যাসাগর এবং বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পর্কও একটি উদাহরণ। বিদ্যাসাগর আমাদের সমাজের জন্য যা করেছেন, তা তাঁকে চির অমরত্ব দিয়েছে। নিজের জীবনের লক্ষ্য ও গন্তব্য বিষয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আজীবন একনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি সর্বার্থেই একজন মহান পুরুষ ছিলেন। কিন্তু কবি ছিলেন না। মদনমোহনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বে যে দূরত্বটি দেখা দিল, তা দুজনের স্বভাবের দূরত্ব বলেই মনে হয়। কিন্তু বিদ্যাসাগর ও তর্কালঙ্কারের মধ্যে যে অপূর্ব বন্ধুত্ব, তাঁদের যে মেলবন্ধন, সেটা আমাদের প্রজন্মের অনেকের কাছেই শিক্ষণীয়।
তর্কালঙ্কার রচিত ‘শিশুশিক্ষা’ একটি সার্থক প্রাইমার। বাঙালি সমাজের সঙ্গেই তা আন্তর্জাতিক শিক্ষাচেতনার সঙ্গেও যুক্ত। এই প্রাইমারটি পণ্ডিতি এবং তর্জন-গর্জনের আবহ থেকে মুক্ত ছিল। ছিল এক অনাবিল আনন্দের পরিসর, সেখানে ছেলেমেয়েরা খুশির ছলে লেখাপড়ার প্রথম ভিতটিতে প্রবেশ করবে। অহেতুক নীতিকথার ভার তার উপরে চাপানো হয়নি। যেটুকু নীতিশিক্ষা তা ছেলেমেয়েদের বেড়ে ওঠার সঙ্গে তাদের জীবনে যেন স্বাভাবিকভাবে প্রবেশ করে, এই ছিল লক্ষ্য। শিক্ষাজীবনের শুরুটা যে গদ্যের পাকা ইট গেঁথে করতে হবে, সেটা না ভেবে, তর্কালঙ্কারের উদ্দেশ্য ছিল কবিতার অপরিসীম রসে যেন শিশুটির দীক্ষা হয়। বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অভেদের ধারণা যাতে শিশুর মধ্যে থাকে, এবং শিশুটির মধ্যে লুকিয়ে থাকা চিরশিশুর যেন আজীবন জাগরণ থাকে, সেই প্রয়াস ছিল তাঁর। শিশুর শিক্ষার মধ্যে বর্বরতা ও বন্যতার সুপরিকল্পিত মাত্রা যে মিশ্রিত থাকা চাই, শিক্ষা যেমন সমাজের বিলাসিতা নয়, তেমনই বিকারও নয়, এ বোধ তর্কালঙ্কারের ছিল। জটিল যুক্তিকাঠামোর বাইরে বাঁচতে চাওয়া একটি শিশুকে ধীরে ধীরে সভ্যতা ও নিষ্ঠার দিকে নিয়ে আসা একটি ক্রমিক পদ্ধতির মাধ্যমে, এই প্রয়াস ‘শিশুশিক্ষা’য় দেখা যায়।

এদিক থেকে তাঁকে রবীন্দ্রনাথের পূর্বসূরীও বলা চলে। রবীন্দ্রনাথ প্রণীত প্রাইমার ‘সহজপাঠ’ এবং তর্কালঙ্কারের ‘শিশুশিক্ষা’ যেন জেনেটিক এক সম্পর্কে গাঁথা দুটি কাজ। একজন ভুবনবিজয়ী কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথের ঝোঁক যে ‘জল পড়ে/ পাতা নড়ে’-র দিকে যাবে, এ তো স্বাভাবিক! এই দুটি পংক্তি যে প্রায় একজন সাধকের সারাজীবনের সাধনায় লিখিত একটি হাইকুর সমান! ভাবসংহতির যে স্তরে এই একটি কবিতা পৌঁছেছিল, তা আধ্যাত্মিকতার জায়গা। সেখানে প্রতিটি শব্দ কবির সারাজীবনের সাধনা ও যাপনের ফল রূপে উদ্ভাসিত হয়। রবীন্দ্রনাথ যে এজীবন এই দুটি পংক্তি তাঁর হৃদয়ে বহন করেছিলেন, কবির প্রতি সচেতন না হয়েই। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আজকের শিশু এই দুটি পংক্তি তার জীবনে পেল না!
মদনমোহন যে একজন অপরূপ কবি ছিলেন, ‘শিশুশিক্ষা’-র বেশ কিছু উদাহরণ আমাদের বুঝিয়ে দেয়। তিনি শিশুকে যে উচ্চারণগুলো উপহার দিচ্ছেন, সেগুলোর মাধ্যমে আসলে তার সংবেদনশীলতাকে আরো জাগিয়ে তুলছেন। শিশুর অনুভূতিকে এতটাই পোক্ত করে তুলতে পারে এই উদাহরণগুলি, যে সে নিজের ভয়, নিজের আনন্দ, পুলক, উল্লাস, লোভ এবং ঈর্ষা ও ভালবাসার সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় আসতে পারে জীবনের ঊষালগ্নেই। ‘বড় ভয়’... শুধু এই দুটি শব্দেই যে পৃথিবীর যাবতীয় ত্রাসের আবহাওয়ার সঙ্গে তার একটা পরিচয় হয়ে যায়। সেই ভয়কে জয় করার তাগিদও গড়ে ওঠে তার মধ্যে। এই কাজ মদনমোহন পেরেছিলেন নিজে একজন কবি বলেই। আজ যখন আমরা একটি শিশুর শিক্ষার শুরুতেই তার পিঠে ঝুলিয়ে দিই ভারি ব্যাগ, তার মনের চেয়ে তার মেধার দিকেই তাকিয়ে থাকি হন্যে হয়ে, একবারও ভেবে দেখি না তার মনের সুকুমার শক্তিগুলো বিকশিত হচ্ছে কিনা, তার প্রবৃত্তিগুলো কোনো বিকৃত রূপ নিচ্ছে কিনা, তখন মদনমোহনের মতো একজন মানুষের অভাব স্পষ্ট চোখে পড়ে। ওই প্রাইমারটিতে যে স্বাভাবিক বোধ ছিল, আজ তা হারিয়ে আমরা এক লক্ষ্যহীন দিশাহীন শিক্ষাব্যবস্থার দাস হয়ে পড়েছি।
মদনমোহন তর্কালঙ্কার ১৮৫৮ সালের ৯ মার্চ কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। তর্কালঙ্কারের সময়টি ছিল এ-দেশে স্ত্রীশিক্ষার দ্বার উন্মোচনের সূচনা। একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে তাঁর এ-ব্যাপারে নির্দিষ্ট ভূমিকা ছিল। ‘শিশুশিক্ষা’- বইর মধ্যে তার প্রমাণ পাই। তর্কালঙ্কারের প্রাইমারটিতে শিক্ষার ক্ষেত্রে ছেলে এবং মেয়ের কোনো ভেদ স্বীকার করা হয়নি। শিশু শব্দটিতে যে মেয়েপুরুষ উভয়ের সমান অধিকার, শিক্ষাজীবনের শুরুতে নারীপুরুষের ভেদের চেয়ে অভেদটি যে জরুরি, এই বিজ্ঞানসম্মত বোধও মদনমোহনের মধ্যে ছিল। যা আজও অনেক পাঠ্যপুস্তকে আমরা সেটা দেখতে পাই না। বিবিধ উদাহরণে আজও লিঙ্গবৈষম্য বেশ প্রকটভাবেই চোখে পড়ে। আজও গ্রামে গ্রামে নাবালিকা মেয়েদের বিবাহ হয়ে যায় স্কুলের গণ্ডী পেরনোর আগেই। ছেলেদের লেখাপড়া বন্ধ হয় অর্থ অভাবে। মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়ার জন্য বাবা-মাকে খুব একটা যুক্তির অবতারণা করতে হয় না। গ্রামে তো বটেই শহরেও পরিবারের ছেলে আর মেয়েটি অনেক সময়ই শিক্ষাগত বৈষম্যের শিকার হয়। ছেলেটি পায় বিদ্যালয়ের পাশাপাশি কোচিং সুবিধা, কিন্তু অনেক মধ্যবিত্ত বাড়িতেও মেয়েটিকে বিবিধ কৌশলে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত রাখা হয়। মদনমোহনের বইটিতে বিভিন্ন উদাহরণে যখন শিশুকন্যাদের আমরা দেখতে পাই, মন ভ’রে ওঠে। বাবা-মার কানে এই উদাহরণগুলো পৌঁছলে তাঁদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটতে পারে, এই বোধ ঊনবিংশ শতাব্দীর মানুষটির ছিল, কিন্তু আজ অঢেল সুযোগ সুবিধা নিয়ে যারা আমাদের শিক্ষানীতি এবং সিলেবাস প্রস্তুত করেন, তাঁরা অনেক সময়েই সেই বোধে নিজেদের পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হন।
শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা কি আদৌ এগোচ্ছি, নাকি অনবরত পিছোচ্ছি? মন আর মেশিন কি এক করে ফেলছি?
তথ্য ও ছবি সুত্রঃ মদনমোহন তর্কালংকার উইকিপিডিয়া এবং গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




