'দিল্লি দুর অস্ত'......
আলাউদ্দিন খিলজি ছিলেন খিলজি বংশের দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক। যিনি দিল্লিতে বসে ভারতীয় উপমহাদেশে খিলজি শাসন পরিচালনা করেছেন। তিনি চেয়েছিলেন ভারতীয় ইতিহাসেও একজন আলেকজেন্ডারের মতো শক্তিশালী কারো কথা উল্লেখ করা থাকুক। তাই তিনি নিজেকে ২য় আলেকজেন্ডার (সিকান্দার-এ-সানি) হিসেবে পরিচিত করার চেষ্টা চালিয়ে যান। তিনি নিজের নামে মুদ্রা প্রচলন করেন এবং জুম্মাহর খুতবার আগের বয়ানে নিজের কৃতিত্ব বর্ণনার আদেশ দেন। তার শাসনকালঃ১২৯৬-১৩১৬ খৃষ্টাব্দ।
সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজি দিল্লির প্রান্তে একটা মসজিদ তৈরি করলেন। রাজা বাদশাহদের এরকম অনেকরকম খেয়াল থাকে। মনে হল তাই একটা মসজিদ বানিয়ে ফেললেন। মসজিদ তো হল, কিন্তু সেখানে লোকজন সেরকম খুব একটা যাওয়া আসা করল না। আলাউদ্দিন খিলজি মারা যাওয়ার পর বেশ কিছুদিন সে মসজিদ ফাঁকাই পড়ে রইল। কেউ আর আসে না টাসে না।
কিছুকাল পরে হঠাৎই কোথা থেকে এক ফকির এসে বাসা বাধল সেই মসজিদে। তখন দিল্লির তখতে খিলজি বংশ চলে গিয়ে এসেছে তুঘলক বংশ যার প্রতিষ্টাতা সুলতান গিয়াসুদ্দিন তুঘলক। সুলতানের মেজাজ প্রচন্ড রকম কড়া। এক চুল অনুশাসনের শিথিলতা তিনি বরদাস্ত করেন না। শোনা যায় একবার নাকি দিল্লিতে গুজব রটেছিল যে সুলতান মারা গেছে। সুলতানের কানে যখন সে গুজব ওঠে, সুলতান তখন বলেন আমি তো সত্যি সত্যি আর মরিনি, যারা যারা আমার মৃত্যু দেখতে চেয়েছিল এবার তারাই মরুক- বলে দিল্লির আম নাগরিকদের অনেকেই বিনা কারনে কোতল করেছিলেন।
সেই ফকিরের কথায় আসা যাক। ফকির আস্তানা বাধার পর কিছু কিছু মানুষ তার কাছে আসতে শুরু করল। তার সততা সরলতা দেখে অনেক মানুষ গুণমুগ্ধ হতে শুরু করল। এই ফকিরের কোনো দাবী দাওয়া নেই, কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই, যে আসছে তার জন্যই আল্লাহ রাব্বুল আল আমীনের কাছে দোয়া প্রার্থনা করছে! ধীরে ধীরে সব শ্রেণীর মানুষের মনে শ্রদ্ধার জায়গা তৈরি হল ফকির সম্পর্কে।
একবার দিল্লিতে ভীষণ গরমে সুপেয় পানির অভাব দেখা দিল। লোকজন ফকিরকে গিয়ে বললেন তাদের অসুবিধার কথা। ফকির বলল- তাহলে একটা দীঘি খনন করানো যাক। সবাই মিলে স্বেছায় শ্রম দিয়ে দীঘি খনন করবে।
এদিকে তখন সুলতান শত্রু আক্রমণ রোধ করার জন্য পত্তন করতে চাইছেন এক নতুন নগরী যার নাম হবে তুঘলকাবাদ। সেই নগরীর মাঝখানে থাকবে বিশাল এক পুকুর যাতে পাহাড় গলা পানি এসে জমা হবে আর নগরী বেষ্টন করে তৈরি হবে প্রাচীর। এর জন্য প্রচুর শ্রমিক দরকার। সুলতান জানতেন এক ফকির থাকে তার রাজত্বের প্রান্তদেশে, নিজের মতো থাকে, তাই তাকে নিয়ে সুলতানের কোনো মাথাব্যথা ছিল না।
যখন সুলতান নগর তৈরি করার জন্য লোক লাগাতে চাইলেন, দেখা গেল লোকজন বেশিরভাগই ওই ফকিরের পুকুর কাটায় ব্যস্ত হয়ে রয়েছে। সুলতানের নগর তৈরিতে লোকজনের উৎসাহ সেরকম নেই। এতদিন সুলতান আর ফকিরের কোনো সঙ্ঘর্ষ ছিল না।
ব্যস, সুলতানের হয়ে গেল গোস্যা! সুলতান আদেশ জারি করলেন, বন্ধ করো পুকুর কাটা। আগে আমার নগর তৈরি হবে তারপর হবে ফকিরের পুকুর। কিন্তু লোকে তা শুনবে কেন! পুকুর হচ্ছে সাধারণ মানুষের জন্য। তারা নিজেরা মন থেকে সেই কাজ করছে। আর নগর তো তৈরি হচ্ছে সুলতান আর রাজপুরুষদের জন্য। সেই কাজে লোকজনের মনের সাড়া নেই।
এমন সময়ে বিদ্রোহ দেখা দিল বাংলাদেশের প্রান্তে। সুলতানকে ছুটতে হল বিদ্রোহ দমন করার জন্য। দিল্লির সিংহাসনে বসিয়ে গেলেন তার জ্যোষ্ঠ পুত্র মহম্মদকে আর হুমকি দিয়ে গেলেন তিনি ফিরে এসে দেখে নেবেন ফকিরকে। কোথা থেকে এত সাহস হয় ফকিরের তিনি দেখবেন। যা শুনে ফকির মুচকি হেসেছিল একটু।
বাংলাদেশের বিদ্রোহ দমন করে সুলতান এগিয়ে আসছেন দিল্লির দিকে। জ্যোষ্ঠ পুত্র যাকে তখত এ বসিয়ে গেছিলেন সে আবার ফকিরের গুণমুগ্ধ। মহম্মদ নিজে গিয়ে দাঁড়ালেন ফকিরের সামনে। বললেন, আপনি এক্ষুনি চলে যান এখান থেকে, তা নাহলে আব্বাহুজুর এসে আপনার গর্দান নেবে।
এই কথা শুনে ফকির আবার সেই একটা মুচকি হাসি দিল।
লোকজন যারা ফকিরকে ভালোবাসত সবাই ফকিরকে অনুরোধ করল পালিয়ে যান এখান থেকে, সুলতান আর কদিনের মধ্যেই এসে পড়বে, আর এসেই আপনার গর্দান নেবে।
ফকির আবার মুচকি হাসল। তবে এবার কথাও বলল। বলল, 'দিল্লি দুর অস্ত'। অর্থাৎ দিল্লি দূর আছে।
কিছুদিন বাদে আবার সবাই এলো ফকিরের কাছে। এবার জোরাজুরি আপনি চলে যান এখান থেকে, সুলতান এসে গেলে আর কিছু করার থাকবে না।
ফকির মুচকি হেসে বললেন, 'দিল্লি হনুজ দূর অস্ত'। অর্থাৎ দিল্লি এখনো দূর আছে।
পাশে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন সুলতানের বড় ছেলে মহম্মদ।
সুলতান পৌঁছে গেছেন দিল্লির কাছে। মহম্মদ দিল্লি প্রবেশের মুখে সুলতানের অভ্যর্থনার জন্য বানালেন এক বিশাল তোরণ আর তার সাথে এক বিশাল অস্থায়ী মঞ্চ। সেই মঞ্চে বসালেন সুলতানকে। সুলতান গিয়াসুদ্দিন বসলেন সেই মঞ্চে সাথে নিয়ে তার প্রিয় পুত্রকে। নাহ, মহম্মদ নয়। সুলতানের প্রিয় পুত্র তাঁর কনিষ্ঠ সন্তান যাকে নিয়ে বিদ্রোহ দমন করতে গেছিলেন। গিয়াসুদ্দিনের থেকে অনুমতি নিয়ে পুত্র মহম্মদ শুরু করলেন হাতির কুচকাওয়াজ। তিনি নিজে নিয়ন্ত্রণ করবেন হাতির পালকে। এভাবেই বিজয়ী পিতাকে অভ্যর্থনা জানাতে চাইলেন পুত্র।
হঠাৎ বিশাল কড়কড় আওয়াজ। কী হল কী হল বলতে বলতেই সবাই দেখল হাতির মাথা ঘোরানোর সাথে সাথে ভেঙে পড়ছে বিশাল সিংহাসন। চাপা পড়লেন সুলতান গিয়াসুদ্দিন তুঘলক তার প্রিয় পুত্রের সাথে। দিল্লি রয়ে গেল সুলতানের থেকে দুর অস্ত। আর কোনোদিনই দিল্লি পৌঁছন হল না সুলতানের। সিংহাসনে বসলেন মহম্মদ বিন তুঘলক আর সেই ফকির রয়ে গেলেন সবার চোখের মণি হয়ে, নিজামুদ্দিন আউলিয়া যার নাম আর সেই মসজিদ পরিচিত হল নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগাহ নামে।
আজও নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সেই অমর উক্তি 'দিল্লি দুর অস্ত' উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
(ওল্ড পোস্ট)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



