আপনি নিজেই হতে পারেন মোটিভেশান স্পিকার....
গত দুই তিন দশক যাবত মোটিভেশনাল স্পিচ এবং স্পিকারদের রমরমা ব্যবসা। সমাজের সব ক্ষেত্রে না হলেও ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রের এলিট শ্রেণীর মধ্যেও বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। বিশেষ করে নিজ নিজ কর্ম এবং পেশাগত হতাশগ্রস্থ মানুষের মধ্যে এদের কদর অত্যন্ত বেশী। বাংলাদেশে এই প্রথার প্রচলন করে ছিলেন একদা ভণ্ড হস্তরেখা বিশারদ মহা জাতক নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে। যিনি হস্তরেখা দেখে মূলত রত্ন পাথরের ব্যবসা করতেন। পরবর্তীতে তিনি শহীদ আল বোখারী মহা জাগত নামে কোয়ান্টাম মেথড নিয়ে আবির্ভূত হন। কোয়ান্টাম মেথড হল একটি মেডিটেশন এবং মানসিক প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম যা ব্যক্তির মানসিক অস্থিরতা দূর করে এবং আত্মশক্তি বৃদ্ধি করে, কোয়ান্টাম মেথড অনুসারে। কোয়ান্টাম মেথড মহা জাতক চালু করার আগেও এলিট শ্রেণীর মধ্যে সিলভা মেথড চালু ছিলো। কোয়ান্টাম মেথড এবং সিলভা মেথড একই প্রক্রিয়া। এ দুটোরই দীর্ঘ ইতিহাস আছে- যা এখানে অপ্রসাংগিক।
কোয়ান্টাম মেথড এবং সিলভা মেথড এর আধুনিক সংস্করণ হচ্ছে-মোটিভেশনাল স্পিচ বা প্রেরণামূলক বক্তৃতা। এই বক্তৃতা বা বক্তব্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করে, তাদের মধ্যে ইতিবাচক মানসিকতা তৈরি করে এবং তাদের লক্ষ্য অর্জনে উৎসাহিত করে।
এই বক্তৃতার মূল উদ্দেশ্য হলো শ্রোতাদের মনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করা এবং তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য অনুপ্রাণিত করা। মোটিভেশনাল স্পিচের কিছু উদাহরণ হলোঃ- অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য, লক্ষ্য অর্জনের জন্য অনুপ্রেরণা, আত্ম-বিকাশ।
মোটিভেশনাল স্পিচ সাধারণত বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। যেমনঃ শিক্ষায়, ব্যবসা, সামাজিক অনুষ্ঠানে-
বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে মানুষের মধ্যে ইতিবাচকতা এবং সহযোগিতা তৈরি করার জন্য মোটিভেশনাল স্পিচ ব্যবহার করা হয়। মোটিভেশনাল স্পিচ কেবল একটি বক্তব্য নয়, এটি একটি শিল্প যা মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারে এবং তাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।
মোটিভেশনাল স্পিকাররা দুনিয়াজুড়ে বেশ ভালই পসার জমিয়েছেন। তাদের উদ্দেশ্য দুনিয়া জুড়ে সবাইকে সফল বানানো। তাদের বক্তব্যের সারমর্ম- দুনিয়ায় ব্যর্থ মানুষের কোন স্থান নেই। দক্ষতাবিহীন সততা মূল্যহীন। তাই সবাইকে দক্ষ এবং স্বার্থক হতে হবে।
বাস্তবতার নিরিখে দুনিয়ায় সফল এবং সুখী মানুষ শতকরা ১ ভাগও না। আশাতীতভাবে প্রকৃতির নিয়মে সবাই সেই অর্থে সফল হতে পারে না। তাহলে অসফল ব্যক্তিরা যাবেন কোথায়? তাদের জন্য মোটিভেশন কি? আজকের এই কনজিউমারিজমের দুনিয়ায় মানুষের অতৃপ্তি শুধু বাড়ছেই।
এই অতৃপ্তি কমানোর জন্য প্রকৃতপক্ষে পুঁজিবাদের কোন পদক্ষেপ নেই। আত্মার হত্যা এবং আত্মহত্যার মহামারী চলেছে। এমনকি যারা ভোগবাদের অতৃপ্তি মোকাবিলায় আধ্যাত্মিকতা ছড়াতে চান, তারাও ভোগেই জড়িয়ে পড়ছেন। প্রকৃতপক্ষে অ্যাকিউমুলেটেড সম্পদ মানেই চুরি করা ধন। এই ক্রমবর্ধমান বৈষম্য সৃষ্টি করছে এক অপ্রতিরোধ্য ডিস্ট্যাবিলাইজেশন, অস্থির করে তুলছে বিশ্ব, বর্তমান সভ্যতার সবচেয়ে বড় হুমকি আসলে এটাই। এই ডিস্ট্যাবিলাইজারই ধসিয়ে দিয়েছে সবকিছু। তবুও ভোগবাদকে আরও আগলে রাখার, আরও প্রসারিত করার চেষ্টাই চলছে।
সকল ধর্মের অন্যতম উদ্দেশ্য মানুষকে এই ভোগবাদবিমুখ করা। স্রষ্টার উপাসনা করে এবং তাঁর সন্তুষ্টিকল্পে সৃষ্টির সেবা করে পরকালে স্বর্গ হাসিলকেই ইসলামে জীবনের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। অন্যান্য সেমিটিক ধর্মগুলোরও একই থীম। সনাতন ধর্মে জন্মান্তরবাদ আছে, তাতেও পরজনমের শান্তি-অশান্তি এই জনমের পাপপুণ্যের উপর ভিত্তি করেই নির্ধারিত হয়। ধর্ম সিংহভাগ মানুষের এক বিশাল অবলম্বন। তবুও বেশিরভাগ মানুষের জীবনই রয়ে যায় অতৃপ্ত। ইহকালের অতৃপ্তি মানুষকে পরকালের তৃপ্তি অন্বেষণে উদ্বুদ্ধ করে। আবার যেসব অন্যায় অবিচারের ফয়সালা হয় না, নিপীড়িত মানুষ পরকালে তার সুবিচার আশা করে।
সেহেতু ধর্মের প্রয়োজনীয়তা এখনও ফুরায়নি। বরঞ্চ অতৃপ্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। ধর্ম হয়েছে আত্মিক তৃপ্তির তাৎপর্যপূর্ণ অবলম্বন। এই অবলম্বনকে অবজ্ঞা এবং উপেক্ষা করার চেষ্টাও কম চলছে না। কিন্তু তার বিকল্প কি দিতে পেরেছে অবজ্ঞাকারীরা? ধর্মকে বাতিল ঘোষণা করার আগে তার বিকল্প দিন। দুনিয়ার অগণিত অতৃপ্ত মানুষের সম্বলকে এভাবে অবজ্ঞা বা উপেক্ষা করাটা অযাচিত। তবে যারা ধর্মে আত্মার শান্তি না খুঁজে অন্যের শান্তি হরণে মত্ত তাদেরকে নিরস্ত করা প্রয়োজন। এই বিকৃত আদর্শ পরিত্যাজ্য।
ধর্মের নির্দেশ মেনে সৃষ্টির সেবা করুন, মানুষকে শ্রদ্ধা করুন। ইসলামের ৯৫% নির্দেশনাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সততা, দায়িত্বপরায়নতা এবং সামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠাভিত্তিক। দুঃখজনক হল সেসবে মুসলমানদের মন নেই। ফলে তাদের সমাজে ন্যাযতা নেই, জীবনে তৃপ্তি নেই, আত্মারও শান্তিও মিলছে না। ইসলামী অর্থনৈতিক এবং সামাজিক নীতিগুলো যেমনঃ ন্যায়বিচার, ন্যাযতা, পিতামাতা, পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশী, দরিদ্রজনতা, পশুপাখি, পরিবেশ, শালীনতা, পরিচ্ছন্নতা সংক্রান্ত বিধিনিষেধগুলো মেনে চলুন। বেশি বেশি করে পাবার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না থেকে বেশি করে দেবার মাধ্যমে তৃপ্তি খুঁজে নিন। আর্থসামাজিক দায়িত্বকর্তব্যগুলো যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে পরিতৃপ্তি খুঁজে নিন।ভোগবাদের অতৃপ্তি থেকে বেরুতে না পারলে, দুনিয়াটাই শুধু জাহান্নাম হবে না, এই ক্ষুধা মেটাতে গিয়ে আপনি এমন দুর্নীতিতে জড়িয়ে যেতে পারেন, যা আপনার ইহ এবং পরকাল দু’টোকেই কণ্টকাকীর্ণ করে ফেলবে।
মোটিভেশান স্পিস কিম্বা মোটিভেশান স্পিকারের দরকার নাই। মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি আর্থসামাজিক দায়িত্ব এবং কর্তব্যগুলো পালন করুন। সবার আগে, সুখ খুঁজে নিন এসব পালনে সফলকামীতার ভেতর দিয়ে। তাহলে, নিজেও সুখ পাবেন, সমাজেও শান্তি আসবে, ইহ এবং পরকাল দুইতেই সফল হবেন। ধর্মের সবচেয়ে বড় অ্যাপ্লিকেশন সেটাই।
ভাল মানুষ হন, অন্যের ভাল করুন, ভাল কামনা করুন। সুখে থাকুন, সুখী হন, অন্যকে সুখ দিতে চেষ্টা করুন। এর চেয়ে বড় সাফল্য আর নেই। আর এই সাফল্যের সুখ অর্জনের ক্ষমতা প্রায় সবারই আছে- সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করুন।
আমি যা লিখলাম তাও হয়তো মোটিভেশনাল স্পিস হয়ে গিয়েছে। তবে এটা আমার উপলব্ধি, যা আপনাদের কারোর চিন্তা চেতনার সাথে মিলে যেতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুন, ২০২৫ দুপুর ১:০২