গতকাল সালাহউদ্দিন আহমেদ ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা থেকে ওয়াক আউট করলেন কেন?
উত্তর:
এক কথায় বলতে গেলে, রাষ্ট্র পরিচালনায় দ্বৈত-শাসন ব্যবস্থা যাতে না আসে, ঠিক এজন্যই গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী সালাহউদ্দিন আহমেদ ওয়াক আউট করেছেন৷
দ্বৈত-শাসন ব্যবস্থা বলতে কী বোঝায়?
একটি রাষ্ট্র বলতে আমরা প্রধানত সরকারের নির্বাহী বিভাগকেই বুঝি। একটি রাষ্ট্র তিনটি প্রধান অঙ্গ দিয়ে চলে- বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ (সংসদ) ও নির্বাহী বিভাগ।
সংসদ আইন তৈরি করে,
আদালত আইনের বৈধতা পরীক্ষা করে,
আর নির্বাহী বিভাগ সেই আইন বাস্তবায়ন করে।
রাষ্ট্র পরিচালনার এই বাস্তবতা অনুযায়ী, নির্বাহী বিভাগই হলো জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার- যারা মন্ত্রীসভা গঠন করে, প্রশাসন চালায়, পলিসি নেয়, বাজেট করে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করে, আমলাতন্ত্রকে পরিচালনা করে।
এই নির্বাহী বিভাগ যদি শুধু নামে থেকে যায়, আর বাস্তবে তাদের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা না থাকে- তাহলে সেটা হবে কেবল 'কাগুজে বাঘ'।
নির্বাহী বিভাগে আসীনরা যদি ক্ষমতাহীন হন, কাগুজে বাঘ হন, তাহলে আমলা ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কেন নির্বাহী বিভাগের কথা মেনে চলবে?
উত্তর হলো- চলবে না। যেটা আরো পরিষ্কার উদাহরণে দেখা যায় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বেলায়। প্রায় ১ বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও এই সরকারকে পুলিশ এবং আমলারা পাত্তা দেয় না। কারণ, এই সরকার তথা নির্বাহী বিভাগ একটি কাগুজে বাঘ, তাদের ক্ষমতা প্রয়োগের সক্ষমতা নেই৷ ফলতঃ অভিযোগ উঠেছে, এই সরকারের মধ্যেই রয়েছে আরো একটি সরকার, যা মূলত দ্বৈত শাসনকেই ইঙ্গিত করে।
তাহলে, একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে যদি খুব কম ক্ষমতা দেওয়া হয়, এবং ক্ষমতার বড় একটি অংশ যদি বিভিন্ন কমিটি বা কমিশনকে ন্যস্ত করা হয়- তাহলে নির্বাচিত সরকারের আমলেও দ্বৈত শাসন চলবে। ফলাফল- ঐ নির্বাচিত সরকার দুর্বল হওয়ায় আরো বিতর্কিত হবে৷
গতকাল ঐকমত্য কমিশনের যে আলোচনা ছিলো, তার অন্যতম এজেন্ডা ছিলো 'সরকারি কর্মকমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল' নিয়োগের বিধান সম্পর্কিত।
কমিশন প্রস্তাব করেছে, এসব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য একটি কমিটি গঠন করতে হবে। সালাউদ্দিন আহমেদ এই জায়গাটাতেই আপত্তি করেছেন। কারণ, সরকারে থাকবো আমি, অথচ আমি আমার টিম কাদের নিয়ে সাজাবো- তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা আমার থাকবে না! এটা একটা অযৌক্তিক আইডিয়া।
বারবার একটা অজুহাত দেওয়া হচ্ছে যে ফ্যাসিবাদ ফিরে আসবে। অথচ, নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য ঐকমত্য কমিশনের সকল প্রস্তাব মেনে নেওয়া হলো৷ কেউ ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না, সেই প্রস্তাবও মেনে নেওয়া হলো। কিন্তু, তারপরেও যদি নির্বাহী বিভাগে হাত দিতে হয়, তা মেনে নেওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ থাকে কী?
বিচার বিভাগকে বলা হয় গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ। আমরা বিচার বিভাগ সংস্কার করলাম। এর অর্থ হলো নির্বাহী বিভাগের বিভিন্ন একশন যদি অসাংবিধানিক বা বেআইনী হয়, তাহলে অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে আদালত সামনের দিনগুলোতে তার জুশিডিয়াল পাওয়ারের মাধ্যমে অধিকতর ভূমিকা রাখতে পারবে। তাহলে নির্বাহী বিভাগকে ক্ষমতাহীন করতে চাওয়ার যুক্তি কি?
নির্বাহী বিভাগে যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত হন, তারা প্রত্যেকে জনগণের আস্থায় নির্বাচিত হয়েই তো মন্ত্রী, উপ-মন্ত্রী হন। সেক্ষেত্রে, তাদেরকে সরাসরি জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়৷ তাহলে সরকার এবং রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য 'পর্যাপ্ত অথরিটি' আপনি আমাকে দেবেন না, ওদিকে আমার টিম গুছিয়ে দেবে অন্য কেউ আর তার জবাবদিহি করতে হবে আমাকে — এটা কি একটা উদ্ভট আইডিয়া না? সংস্কারের নামে কেন নির্বাহী বিভাগকে প্রোপারলি ফাংশন করতে দিবেন না?
সালাহউদ্দিন আহেমদ আরো বলেছেন, সাংবিধানিক যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, সেখানে নিয়োগের জন্য আলাদা কমিটি না করে আপনারা শক্ত আইন পাস করেন। তাহলেই তো অনেকটা চেক এন্ড ব্যালান্স চলে আসে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সাংবিধানিক ও আইনগত সংস্থাগুলোর নিয়োগে নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ সীমিত করা হলে শাসন ব্যবস্থায় ভারসাম্য নষ্ট হবে।
অবশ্যই তা হবে। কারণ, দ্বৈত শাসন চলে আসলে ভারসাম্য বলে আর কিছু তো থাকেই না।
এখন আপনি আরো পরিষ্কারভাবে চিন্তা করুন।
দেশে যদি কেউ ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হতে পারে,
দেশে যদি কার্যকর সার্চ কমিটির দ্বারা তৈরী নির্বাচন কমিশন থাকে, দেশে যদি মুক্ত স্বাধীন বিচার বিভাগ এবং গণমাধ্যম থাকে, দেশে যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকে, দেশে যদি সাংবিধানিক কমিশনগুলোতে নিয়োগের শক্ত আইন থাকে, তাহলে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা কমানোর আদৌ কি কোনো যৌক্তিকতা আছে? যে বা যারাই নির্বাচিত হোক, তর্কসাপেক্ষে ধরে নিলাম, তারা খুব খারাপভাবে দেশ চালালো। তবুও তো আপনার হাতে ভোট দিয়ে সরকার পরিবর্তন করার অপশন আছে। সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ আছে। তো এতো কিছু থাকতে কেন নির্বাহী বিভাগের অথোরিটি কেড়ে নেওয়াটাই একমাত্র সমাধান গণ্য করতেছেন?
কুদরত-ই-এলাহী বনাম রাষ্ট্র মামলায় বিচারপতি মুস্তফা কামাল মন্তব্য করেছিলেন, “আদালতই শুধু সুড়ঙ্গের শেষে একমাত্র আলো নয়।”- তেমনি, নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা কমানোই টানেলের শেষ প্রান্তে থাকা একমাত্র আলোর উৎস না৷
তাই, সংস্কারের নামে দয়া করে দেশটাতে দুর্বল সরকার স্থাপন করার বিদেশী শক্তির সাজেশন চাপায় দিয়েন না।
আপনারা 'নোট অব ডিসেন্ট' দিয়ে একটা সিদ্ধান্ত চাপায় দিতে চান বলেই সালাহউদ্দিন সাহেব ওয়াকআউট করেছেন।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০২৫ দুপুর ১২:২৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




