তবুও বেঁচে থাকুক ফিলিস্তিনের অবশিষ্ট প্রাণ....
হায় ফিলিস্তিন!
"ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা" প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৯ সালে স্বাক্ষরিত ভার্সাই চুক্তির (Treaty of Versailles) চাইতেও "অসম ও অপমানজনক" চুক্তি হিসেবে ইতিহাসে বিবেচিত হবে। তবুও বেঁচে থাকুক ফিলিস্তিনের অবশিষ্ট প্রাণ।
ভার্সাই চুক্তিকে "অসম ও অপমানজনক" বলার কারণ, যুদ্ধের দায় একতরফাভাবে জার্মানির উপর চাপানো হয়, বিশাল ক্ষতিপূরণ আরোপ করা হয়, সেনা-শক্তি ভেঙে দেওয়া হয়, বহু ভূখণ্ড কেড়ে নেওয়া হয় এবং আলোচনায় জার্মানির কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। এটি ছিল প্রতিশোধমূলক এবং অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া শান্তিচুক্তি।
ট্রাম্পের গাজা শান্তি পরিকল্পনার ২০টি দফাঃ
(১) গাজা একটা অ-কট্টরপন্থী, সন্ত্রাসমুক্ত এলাকা হবে যা তার পাড়া-প্রতিবেশীদের জন্য হুমকি হবে না।
(২) গাজা গাজার লোকজনের ভালোর জন্য পুনর্গঠন করা হবে, যারা অনেক কষ্ট সহ্য করেছে।
(৩) দু’পক্ষ যদি এই প্রস্তাব মেনে নেয়, যুদ্ধ ততক্ষণাত বন্ধ হবে। ইসরায়েলি বাহিনী জিম্মি ছাড়ার জন্য সম্মত লাইনে সরে যাবে, এবং সমস্ত সামরিক অপারেশন বন্ধ হবে।
(৪) ইসরায়েল এই চুক্তি পাবলিকলি মেনে নেয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সব জিম্মি, জীবিত বা মৃত, ফেরত দেয়া হবে।
(৫) সব জিম্মি ছাড়ার পর, ইসরায়েল ২৫০ জন ফিলিস্তিনি লাইফ সেন্টেন্স কয়েদি এবং অক্টোবর ৭, ২০২৩ পরবর্তী গ্রেফতারকৃত ১,৭০০ জন গাজানদের ছেড়ে দেবে, সেই সাথে ছেড়ে দিবে সব নারী এবং শিশু।
(৬) সব জিম্মি ফেরতের পর, হামাস সদস্যরা যারা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং অস্ত্র ছেড়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়, তাদের ক্ষমা দেয়া হবে। যারা গাজা ছেড়ে যেতে চায়, তাদের নিরাপদ প্যাসেজ দেয়া হবে।
(৭) চুক্তি মেনে নেয়ার পর, গাজায় পুরোপুরি সাহায্য পাঠানো হবে, যা নিদেনপক্ষে জানুয়ারি ১৯, ২০২৫ চুক্তির মতো হবে।
(৮) সাহায্য বিতরণে কোনো পক্ষ হস্তক্ষেপ করবে না, এবংএইড বিতরণ করবে ইউএন, রেড ক্রিসেন্ট।
(৯) গাজা একটা টেকনোক্র্যাটিক, অরাজনৈতিক প্যালেস্টাইনিয়ান কমিটির অধীনে অস্থায়ী শাসন চলবে, যার তত্ত্বাবধানে থাকবে ট্রাম্প এর নেতৃত্বে “বোর্ড অফ পিস” সাথে টনি ব্লেয়ার।
(১০) ট্রাম্পের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গাজা পুনর্গঠনের জন্য বিশেষজ্ঞ প্যানেল দিয়ে তৈরি হবে।
(১১) একটা বিশেষ অর্থনৈতিক জোন তৈরি হবে, অংশগ্রহণকারী দেশের সাথে স্বল্প ট্যারিফ নেগোসিয়েট করা হবে।
(১২) কাউকে গাজা ছাড়তে বাধ্য করা হবে না, যারা যেতে চায় তারা যেতে পারবে এবং ফিরে আসতে পারবে।
(১৩) সামাহা এবং অন্যান্য গ্রুপ গাজার শাসনে কোনো ভূমিকা রাখবে না, সব সামরিক অবকাঠামো ধ্বংস করা হবে, গাজা নিরস্ত্রীকরণ হবে।
(১৪) আঞ্চলিক অংশীদারদের দিয়ে গ্যারান্টি দেয়া হবে যে সমাহা তাদের দায়িত্ব পালন করবে এবং নতুন গাজা হুমকি হবে না।
(১৫) যুক্তরাষ্ট্র, আরব এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে অস্থায়ী আন্তর্জাতিক স্ট্যাবিলাইজেশন ফোর্স (আইএসএফ) তৈরি করবে গাজায় ততক্ষণাত ডেপ্লয়ের জন্য।
(১৬) আইএসএফ প্যালেস্টাইনিয়ান পুলিশকে প্রশিক্ষণ দেবে এবং দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা গ্যারান্টর হবে যতক্ষণ না প্যালেস্টাইনিয়ান অথরিটি রিফর্ম করে নেয়।
(১৭) ইসরায়েল গাজা দখল বা annex করবে না, এবং আইডিএফ ধীরে ধীরে অঞ্চল হ্যান্ডওভার করবে।
(১৮) যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল এবং প্যালেস্টাইনিয়ানদের মধ্যে ডায়ালগ স্থাপন করবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের রাজনৈতিক হরাইজনের জন্য।
(১৯) প্যালেস্টাইনিয়ানদের গাজা থেকে জোর করে বিতাড়িত করা হবে না।
(২০) পরিকল্পনাটি যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের পুরো শক্তি দিয়ে সমর্থিত হবে, না মানলে গুরুতর পরিণতি হবে।
এবার ফিরে যাই ট্রাম্পের শান্তি চুক্তির শর্তগুলোতে-
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৯ সালে স্বাক্ষরিত ভার্সাই চুক্তি (Treaty of Versailles) ইতিহাসে অন্যতম বিতর্কিত এবং "অসম ও অপমানজনক" চুক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। কেন তা বলা হয়- তা বোঝার জন্য কয়েকটি দিক বিশ্লেষণ করা দরকার:
(১) যুদ্ধের দায়ভার জার্মানির কাঁধে চাপানোঃ
চুক্তির ধারা ২৩১ (War Guilt Clause) অনুসারে যুদ্ধের সম্পূর্ণ দায়ভার জার্মানির উপর চাপানো হয়।
অথচ যুদ্ধ শুরুতে শুধু জার্মানি নয়, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, রাশিয়া, সার্বিয়া, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড- সবার ভূমিকাই ছিল।
শুধুমাত্র জার্মানিকে দায়ী করা জার্মান জনগণের কাছে অত্যন্ত অপমানজনক মনে হয়েছিল।
(২) বিশাল ক্ষতিপূরণঃ
জার্মানিকে বিশাল অংকের যুদ্ধ ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা হয় (প্রায় ১৩২ বিলিয়ন গোল্ড মার্কস)। তাদের অর্থনীতি যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত থাকলেও চুক্তি তাদের আরও নিঃস্ব করে দেয়। ফলে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ও দারিদ্র্য তৈরি হয়।
(৩) সামরিক সীমাবদ্ধতাঃ
জার্মান সেনাবাহিনীকে মাত্র ১ লাখ সৈন্যে সীমাবদ্ধ করা হয়। বিমান বাহিনী, সাবমেরিন, ট্যাংক রাখার অনুমতি দেওয়া হয়নি। নৌবাহিনীও ছোট আকারে সীমিত করে দেওয়া হয়। এই সামরিক অপমান জার্মানির জাতীয় গৌরবকে মারাত্মকভাবে আঘাত করে।
(৪) ভূখণ্ড হারানোঃ
জার্মানি তার বহু ভূখণ্ড হারায়। আলসাস-লোরেন ফ্রান্সকে দেওয়া হয়। পোল্যান্ড সৃষ্টি করতে গিয়ে "পোলিশ করিডোর" কেটে নেওয়া হয়, ফলে জার্মানি দুটি অংশে বিভক্ত হয়।
আফ্রিকার উপনিবেশগুলো ফ্রান্স, ব্রিটেন ও জাপানের কাছে চলে যায়। এতে জার্মানি শুধু অর্থনৈতিক সম্পদই নয়, রাজনৈতিক মর্যাদাও হারায়।
(৫) আলোচনা থেকে জার্মানিকে বাদ দেওয়াঃ
প্যারিস শান্তি সম্মেলনে (Paris Peace Conference, ১৯১৯) জার্মানিকে আলোচনায় বসতে ডাকা হয়নি।
বিজয়ীরা (বিশেষত ফ্রান্স, ব্রিটেন, আমেরিকা) নিজেদের ইচ্ছামতো শর্ত চাপিয়ে দেয়। ফলে এটি প্রকৃত শান্তি চুক্তি নয়, বরং বিজয়ীদের প্রতিশোধমূলক চাপ হিসেবে দেখা হয়।
(৬) জার্মান জাতীয়তাবাদে প্রভাবঃ
এই চুক্তি জার্মান জনগণের মনে অপমান, ক্ষোভ ও প্রতিশোধস্পৃহা জন্ম দেয়। তাদের মনে হয় দেশটিকে জোরপূর্বক হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করা হয়েছে।
পরবর্তীতে এই অপমানজনক অবস্থার সুযোগ নিয়ে অ্যাডলফ হিটলার জাতীয়তাবাদী আবেগ উসকে দেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে পৃথিবী ধাবিত হয়।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


