ধর্মের নামে বিদ্বেষঃ ড. ইউনূসকে অসুর রূপে দেখানো এবং অসুরের মুখে দাড়ি....
মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শন কোনো সৌজন্য নয়- এটা সংস্কৃতি ও মানবতার পরিচয়। এটাই সভ্যতার প্রথম পাঠ, মানবতার মূল নীতি, আমাদের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের পরিচয়।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপূজার মণ্ডপে নোবেলজয়ী ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ‘অসুর’ রূপে উপস্থাপন করা সেই মানবতার মুখে এক চপেটাঘাত। পশ্চিমবঙ্গের পত্রপত্রিকায় এসেছে, শুধু ড. ইউনূসকেই নয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফকে এমনভাবে দেখানো হয়েছে, যেন দেবী দুর্গা তার ছিন্ন মস্তক ধরে আছেন।
বাংলাদেশের মানুষ ধর্মকে ভালোবাসে, এই দেশে হিন্দু-মুসলমান সহাবস্থান ঐতিহ্যমন্ডিত। শেখ হাসিনার পতনের পর কেউ হিন্দু বলেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি; বরং মুসলমান প্রতিবেশীরা লাঠি হাতে মন্দির পাহারা দিয়েছেন। তাহলে ড. ইউনূসকে অসুর রুপে দেবী দুর্গার পায়ের নিচে, অসুরের মুখে দাড়ি এঁকে কী বার্তা দিতে চাওয়া হচ্ছে? যারা এটা করেছে, তারা হিন্দুধর্মকেও অসম্মান করেছে। ধর্ম কখনো বিদ্বেষ শেখায় না, ধর্ম শেখায় সহমর্মিতা। পূজার মণ্ডপে জীবন্ত মানুষকে অসুর সাজানো ধর্ম নয়- এটা রাজনৈতিক নোংরামি।
জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন ভারতীয় মহল সহজভাবে নিতে পারেনি। সে হতাশা থেকেই ভারতে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজায় ড. ইউনূসকে হেয় করার অপচেষ্টায় অসুর রূপে উপস্থাপন করা হয়; যা অত্যন্ত নিন্দনীয়, দুঃখজনক, অশোভন ও অসম্মানজনক। ধর্ম বিনোদন, ভণ্ডামি, সস্তা রং-তামাশার মতো ফুটিয়ে তুলে উদযাপন নয়। ধর্ম পালন কি উদযাপনের নামে নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো কাউকে ভগবান, ঈশ্বর বা অসুর বানানো স্ব-ধর্মেরই অবমূল্যায়নের বহিঃপ্রকাশ ও ধর্মকে প্রশ্নবিদ্ধ করা নয় কি?
অসুর যখন ইচ্ছেমতো বানানো যায়, তাহলে দুর্গাও তো ইচ্ছেমতো বানানো যায়। যেমন খুশি তেমন সাজো মার্কা ধর্ম! নিজের হাতে নিজেদের সৃষ্টিকর্তা তৈরি, আবার নিজের হাতে নিজেদের শক্রও তৈরি! সবকিছুই কি তাহলে অসার? ধর্ম হিংসা, প্রতিহিংসা, বিদ্বেষ শিক্ষা দেয় না। ধর্ম শিক্ষা দেয় সাম্যের। ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা মূর্খতা। জীবন্ত মানুষের মূর্তি বানিয়ে তার পূজা করে ধর্ম পালন করলে তাকে তো বলা হবে ‘বিনোদন ধর্ম।’
এভাবে প্রতিমা বিগ্রহের নামে কেউ যদি দুর্গার জায়গায় ‘হাসিনা’কে বসিয়ে দেয়! ড. ইউনূসের ক্ষমতা গ্রহণে হিন্দু ধর্মের লোকের ক্ষতি কিংবা ভারতের কোনো ক্ষতি তিনি করেননি। বাংলাদেশের হিন্দুরা তো অসুরের জায়গায় নরেন্দ্র মোদি, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে উপস্থাপন করেনি। রাজনৈতিকভাবে ভারত হাসিনাকে ছাড়া বাংলাদেশের কাউকে মানতে পারছে না।
রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক যে কোনো কর্মকাণ্ডে অন্য দেশের নেতৃত্বকে অসম্মান করা কেবল অনভিপ্রেত নয়, বরং বিপজ্জনকও।

অসুরের মুখে দাড়িঃ আজ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মহোদয় সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন- "বাংলাদেশে এবার প্রায় ৩৪০০ পূজামণ্ডপ তৈরী হয়েছে। দেশজুড়ে ৭৯৩ টি দুর্গাপূজার প্রতিমায় অসুরের মুখে দাড়ি-গোঁফ আঁকাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। গতকালই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন ছাত্র পবিত্র কোরআন পায়ে মাড়িয়ে উস্কানিমূলক আচরণ করেছে। কয়েক দিন আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়িতে গনধর্ষনের মিথ্যা প্রচারণা করে ব্যাপক ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে তিনজনের মৃত্যু, সেনাবাহিনীর সদস্যদের উপর আক্রমণ- এসব পার্শ্ববর্তী একটি দেশের উস্কানিতে হয়েছে, যার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।"
গত দশ দিনে- পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসী কার্যক্রম, ভারতে অসুর রূপে ড. ইউনূস, অসুরের মুখে দাড়ি, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ছাত্রে পবিত্র কোরআন পায়ে মাড়ানো- ধর্মের নামে এ কেমন বিদ্বেষ? কেন এমন উস্কানি? ধর্ম কি প্রতিশোধের উৎসব? পূজা কি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রকাশ? এভাবে একজন সম্মানিত ব্যক্তিত্বকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা কেবল অরুচিকরই নয়- এটা সীমান্তপারের বন্ধুত্ব, সামাজিক সম্প্রীতি এবং কূটনৈতিক শিষ্টাচারের প্রকাশ্য অবমাননা।
আমরা আশা করবো- ভারত সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টির প্রতি অবিলম্বে দৃষ্টি দিক, ব্যাখ্যা দিক এবং ভবিষ্যতে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সেই নিশ্চয়তা দিক। বাংলাদেশের মানুষ শান্তি চায়, অপমান নয়। ধর্ম হোক মানবতার, শিল্প হোক মর্যাদার- বিদ্বেষ নয়, সহমর্মিতাই হোক দুই দেশের সম্পর্কের ভিত্তি।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


