পালাগানঃ জীব-পরমাত্মা ও বাঙালির ধর্ম-দর্শনের লোকজ রূপ.....
এদেশের মাটি, পানি, আবহাওয়ার কারণেই লোকজ মাটির গান, ভাটির গান, জারিগান, বাউল-পালাগান আমার অত্যন্ত প্রিয়। একসময় খুব ভালো লাগতো যাত্রাপালা।
বাংলার লোকসংস্কৃতিতে পালাগান শুধুই বিনোদন নয়; এটি একটি দার্শনিক বিতর্কের মঞ্চ, যেখানে লোকজ ভাষায় প্রকাশ পায় ধর্ম, জীবনবোধ, সংশয় ও আত্মঅন্বেষণের জিজ্ঞাসা। আবহমানকাল ধরে বাউল, ফকির, মরমিয়া সাধকরা এই পালাগানের কাঠামোকে ব্যবহার করেছেন সাধারণ মানুষের জ্ঞানবোধ ও ধর্মীয় উপলব্ধিকে সহজ ও অভিজ্ঞতালব্ধ ভাষায় ব্যাখ্যা করতে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়-
"আট কুঠুরি নয় দরজা ঘরখানা হয় তিন তলা" একটি বিখ্যাত গান, যা মানুষের শরীরকে একটি ঘর হিসেবে বর্ণনা করে যেখানে আটটি কুঠুরি (কানের দুটি, চোখের দুটি, নাকের দুটি, মুখ ও নাভি) এবং নয়টি দরজা (একইভাবে, দরজার সংখ্যার উপর ভিত্তি করে) রয়েছে, যা তিনটি তলায় বিভক্ত (মাথার খুলি, বুক এবং পেট)। তিন তলাঃ পুরো শরীরকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই লাইনটি সাধারণত জীবন, মৃত্যু এবং মানবদেহের রহস্যময় গঠন বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এটি একটি প্রতীকী রূপক যা দিয়ে মানব শরীরকে একটি বাড়ির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এইসব দেহতত্ত্ব গান আমাকে খুব আকর্ষণ করতো। ঠিক একই ভাবে পালা গানের প্রশ্ন এবং উত্তর আমাকে ভীষণ ভাবে আলোড়িত করে। কারণ, বাউল শিল্পীরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও তাদের উপলব্ধি, দর্শন একেবারেই ফেলনা নয় বরং অনেক উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিদের চাইতেও উন্নত বললে ভুল বলা হবেনা।
সম্প্রতি বাউল আবুল সরকারের গানের একটি অংশ ভাইরাল হওয়ায় পালাগান নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই বাউলের বক্তব্যকে প্রাসঙ্গিক কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। অথচ পালাগানের প্রকৃত রূপ বোঝাতে গেলে প্রথমেই বুঝতে হবে- এটি কোনো চূড়ান্ত বক্তব্যের ভাষা নয়, বরং প্রশ্ন ও জবাবভিত্তিক এক ধরনের লোকজ দর্শনচর্চা।
(১) পালাগানের কাঠামোঃ প্রশ্ন বনাম উত্তর- জীবের সংশয় ও পরমাত্মার জবাব।
পালাগানে সাধারণত দুইটি পক্ষ থাকে-
(ক) জীব বা “জীবাত্মা”:
এ পক্ষটি সংশয়প্রবণ, কৌতূহলী এবং কখনো কখনো অভিযোগমুখর।
তারা বলেন-
“তুমি কেন এমন করলে?”
“এটা কি ন্যায়সঙ্গত?”
“এই কষ্টের ব্যাখ্যা কোথায়?”
এ প্রশ্নগুলো সরাসরি আল্লাহ বা পরমাত্মাকে উদ্দেশ করে করা হয়- কিন্তু এটি দর্শনের ভাষা, বেয়াদবির নয়। জীবের অংশটি মূলত মানবিক জিজ্ঞাসার প্রতিফলন।
(খ) পরম বা “পরমাত্মা”:
এই অংশে পালাকার জীবের সব প্রশ্নের উত্তর দেন। তিনি তর্ক, সংশয়, অভিযোগ- সবকিছুকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করেন। কখনো কঠোর, কখনো স্নেহপূর্ণ, কখনো গভীর মরমি ভাবনায় তিনি জীবকে পথ দেখান।
এই বিন্যাসই পালাগানের প্রাণ।
এটিই কবির লড়াই।
এটিই বাঙালির লোকজ আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য।
(২) জীব-পরম পালাঃ বাঙালির মৌলিক দার্শনিক চর্চাঃ
পালার বিষয়বস্তু নানা হতে পারে- ধর্ম, সমাজ, প্রেম, ঈশ্বর, নিয়তি- তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো জীব ও পরম পালা। এটি আসলে সমাজের হতদরিদ্র, অশিক্ষিত মানুষের ঈশ্বর-সংক্রান্ত প্রশ্নসমূহকেই লোকভাষায় প্রকাশ করে।
এই কারণে গানের ভাষা সরল, কখনো কড়া, কখনো বেখাপ্পা- কিন্তু তাতে উদ্দেশ্য থাকে মানুষকে ভাবতে শেখানো।
আমরা দেখি, সকল ধর্মেই প্রশ্ন–জিজ্ঞাসা রয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, বিতর্কের ময়দানে জাকির নায়েকের সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের প্রশ্ন–উত্তর পর্বকে যদি আমরা দেখি-
এক পক্ষ প্রশ্ন করে, অপর পক্ষ উত্তর দেয়- ঠিক একই বিষয়ই পালাগানের দার্শনিক কাঠামোতেও ঘটে। তফাৎ হলো- একটি হয় শিক্ষিত মঞ্চে, অন্যটি হয় গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির প্রান্তে।
(৩) বাউলের ভাষা কেন “বেখাপ্পা” মনে হয়?
শিক্ষিত সমাজ সাধারণত দার্শনিক বা ধর্মীয় আলোচনায় সাহিত্যিক, মার্জিত ভাষা ব্যবহার করে। কিন্তু পালাকাররা গান করেন- চাষা-ভূষা, মজুর, রিকশাওয়ালা, মাঠের মানুষ- অশিক্ষিত বহু শ্রোতার সামনে।
অতএব তারা বলেন- মানুষ যেমন বোঝে, যে ভাষায় অনুভব করে, যে ভাষায় কষ্ট প্রকাশ করে- সেই ভাষায়ই।
এই ভাষা অনেক সময় আমাদের কাছে “অশোভন” মনে হয়। অথচ তাদের উদ্দেশ্য আল্লাহকে অসম্মান করা নয়; বরং লোকভাষায় প্রশ্ন তুলে হৃদয়ে ধার্মিক ভাব জন্মানো।
অনেক বাউল পালার শুরুতেই ঘোষণা দেন-
“ভুলত্রুটি হইলে ক্ষমা করবেন। মানবজীবের জিজ্ঞাসা হিসেবেই কিছু কথা আসতে পারে- সেইসব জিজ্ঞাসার জবাব আমরা দেওয়ার চেষ্টা করবো, কিন্তু আমাদের জবাবই চুড়ান্ত নয়।”
অতএব প্রেক্ষাপট ছাড়া এসব বাক্যকে ধর্মবিদ্বেষী বলা ভুল ব্যাখ্যা।
(৪) বিভ্রান্তি, উস্কানি ও ঘোলা পানিতে মাছ ধরাঃ
সাম্প্রতিক বিতর্কের মূল সমস্যা হলো-
পালাগানের অংশকে এর সম্পূর্ণ কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রচার করা। জানেনা প্রেক্ষাপট, জানেনা নিয়ম, জানেনা ঐতিহ্য- তারপরও হুজুগে লাফিয়ে পড়ে উস্কানি ছড়ানো হচ্ছে।
পালাগানকে বোঝাতে গেলে আগে বোঝাতে হবে এটি প্রশ্ন- উত্তরের কাঠামো; এটি অভিযুক্ত করার গান নয়, বরং দার্শনিক জিজ্ঞাসার গান। উস্কানিমূলক ব্যাখ্যা দিলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি বাড়ে- এবং তাতে ধর্মের কোনো লাভ হয় না।
(৫) সমালোচনার বদলে সংলাপ প্রয়োজনঃ
যদি কোনো হুজুর বা আলেম মনে করেন বাউলের কোনো বক্তব্য সীমার বাইরে চলে গেছে- তাহলে যেভাবে তারা নিজেদের মসজিদ-মাদরাসার ছাত্রদের ভুল প্রশ্ন ধৈর্য ধরে বোঝান, তেমনি বাউল বা লোকশিল্পীদের সঙ্গেও আলোচনায় বসা উচিত। বাউলরা যে অনিচ্ছাকৃত ভুল করতে পারেন- তা শোধরানো সম্ভব সংলাপের মাধ্যমে, সংঘাতের মাধ্যমে নয়। ইসলাম জ্ঞান, আলোচনাকে উৎসাহ দেয়- উগ্রতা বা হুজুগে বিচারকে নয়।
পালাগান বাঙালির আত্মা। এটি ধর্মকে সহজ করে বলে,
জীবনের জটিলতা লোকজ ভাষায় তুলে ধরে। তাই-
বাউলদের তাদের মত থাকতে দিন। পালাকে পালার প্রেক্ষাপটে দেখুন। প্রতিপক্ষকে বিষয়টি বুঝিয়ে বলুন- এটি প্রশ্ন, উত্তরের শিল্প, সৃষ্টিকর্তার নিন্দা নয়।
আর যারা ধর্মের প্রতি আন্তরিক, আলেম ওলামা-
তারা বাউলদের সাথে সংলাপের পথ বেছে নিলে ধর্মই উপকৃত হবে, মানুষ উপকৃত হবে।
বিভাজন নয়।
বিঃদ্রঃ পেশী এবং ঈমানীশক্তি থাকলে তা শক্তিমানদের বিরুদ্ধে দেখান। কাদিয়ানী, বাহাই, দেওবন্দী, নকশবন্দিয়া, মওদুদীবাদীদের বিরুদ্ধে দেখান। দুর্বল বাউলদের উপর নয়।
(চলতি প্রথাবিরোধী পোস্ট)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:০৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


