somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইতিহাস

১৮ ই জুলাই, ২০১৬ দুপুর ১:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উপেক্ষিত একটি অংশ হল বীরাঙ্গনা।
................এক বীরাঙ্গনা মায়ের মেয়ের বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল তার বীরাঙ্গনা পরিচয়ের কারণে। অন্যদিকে আমাদের পরিবারে কেউ মুক্তিযোদ্ধা থাকলে সেই সার্টিফিকেটের সুবিধা নিয়ে সেরা স্কুল-কলেজে ভর্তি হই। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরী নিই। অন্যদিকে বীরাঙ্গনার সন্তানের, বীরাঙ্গনা কোটায় বিয়ে ভেঙে যায়।
একাত্তরে তাদের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায় আচরণ তাদেরকে যতটা না কষ্ট দেয়, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি কষ্ট দেয়, যুদ্ধের পর পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে পাওয়া নির্যাতন,বঞ্চনা ও উদাসীনতা। সমগ্র জীবন তারা পার করে দিলেন, এক বুক বেদনা নিয়ে। সমাজের বাঁকা চোখ তাদেরকে বাধ্য করছে, মানবেতর জীবনযাপন করতে। যেন বীরাঙ্গনা হওয়া অপরাধ। দেশের জন্য পুরুষের আত্মত্যাগ মহান হলেও, নারীর আত্মত্যাগ লজ্জার!

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের গৌরবের ইতিহাস। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের দেশের বীর সন্তান। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক লেখা আছে অনলাইনে। আমি সেসব আবার নতুন করে বলতে চাই না। আজ আমার লেখার বিষয়, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উপেক্ষিত একটি অংশ।

বীরাঙ্গনা। যারা একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার আলবদরদের দ্বারা নির্মম অত্যাচার, নির্যাতন, ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে গর্ববোধ করেন। নিশ্চয়ই এটি গর্বের বিষয়। কিন্তু জানেন কি বীরাঙ্গনা পরিচয়টি আমাদের সমাজে, লজ্জা ও অপমানের। যুদ্ধ প্রক্রিয়ার কৌশলগত দিক হিসেবে নির্যাতিত হয়েছেন এইসব বীর নারীরা, নিঃসন্দেহে তারা মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু এই বীর নারীরা কী পেয়েছে স্বাধীন দেশটির কাছ থেকে ঘৃণা আর অপমান ছাড়া?

যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হল, এক বুক কষ্ট-দুঃখ-যন্ত্রণা নিয়ে বীরাঙ্গনারাও তাদের আপনজনদের কাছে ফিরে গিয়েছিলেন। কিন্তু হায়! ধর্ষকেরা নাকি তার ইজ্জত নষ্ট করে ফেলেছে, তার আর ইজ্জত নেই, কাজেই স্বামী তাকে ঘরে তুলবে না। হ্যাঁ, বেশির ভাগ নারীর সাথে এটিই ঘটেছিল। তারা বাড়ি হারা, স্বামী হারা, সন্তান হারা হয়েছেন এই স্বাধীন দেশে। কতটা নির্মম, কতটা বর্বর জাতি আমরা, ভাবতে পারেন?

বঙ্গবন্ধু এসকল বীর নারীদের জন্য ‘নারী পুনর্বাসন’ অফিস খুলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সেসবও বন্ধ হয়ে গেল। তাদের অনেকে মানুষের বাড়িতে কাজ করে নিজের জীবিকা নির্বাহ করতে শুরু করেছিলেন। সেখানেও অনেককে কুকুরের মত তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের সম্পর্কে এলাকায় কথা বলতে গেলেই, মুক্তিযুদ্ধে তাদেরকে পাক বাহিনী ধরে নিয়ে গিয়ে কয়জন কী করেছে, সেসব কথা আগে উঠে আসে। এসবই তাদের পরিচয়। তাদের জীবন ঠিক ওই সময়টাতেই থেমে আছে।

এক বীরাঙ্গনা মায়ের মেয়ের বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল তার বীরাঙ্গনা পরিচয়ের কারণে। অন্যদিকে আমাদের পরিবারে কেউ মুক্তিযোদ্ধা থাকলে সেই সার্টিফিকেটের সুবিধা নিয়ে সেরা স্কুল-কলেজে ভর্তি হই। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরী নিই। অন্যদিকে বীরাঙ্গনার সন্তানের, বীরাঙ্গনা কোটায় বিয়ে ভেঙে যায়। বেগম খালেদা জিয়া, হোক তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী, আমরা কিন্তু ৭১এ তাকে ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার ধর্ষণ করাকে মজার কোন বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করে মুখ টিপে হাসি।

একাত্তরে তাদের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায় আচরণ তাদেরকে যতটা না কষ্ট দেয়, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি কষ্ট দেয়, যুদ্ধের পর পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে পাওয়া নির্যাতন,বঞ্চনা ও উদাসীনতা। সমগ্র জীবন তারা পার করে দিলেন, এক বুক বেদনা নিয়ে। সমাজের বাঁকা চোখ তাদেরকে বাধ্য করছে, মানবেতর জীবনযাপন করতে। যেন বীরাঙ্গনা হওয়া অপরাধ। দেশের জন্য পুরুষের আত্মত্যাগ মহান হলেও, নারীর আত্মত্যাগ লজ্জার।

একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামে শোক গাঁথার অন্যতম অধ্যায় বীরাঙ্গনা। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সহ সমস্ত ক্ষতিগ্রস্তরা বিভিন্ন সময় আলোচনায় এলেও সবসময় উপেক্ষিত থেকে গেছেন বীরাঙ্গনারা। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বইগুলোতেও এসকল বীর নারীদের আত্মত্যাগের কথা খুব বেশি পাওয়া যায় না। ব্লগে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখা হয়। বীরাঙ্গনাদের ব্যাপারে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শুধু একটি বাক্য থাকে, ‘২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম হানি’ দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম হানি মোটেই ঘটে নি। সম্ভ্রম যোনির ভেতরে থাকে না।
দুই লক্ষ মা-বোনের সাথে কী ঘটেছিল ৭১ এ, সেসব বলে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনীকে আমরা আরও লোমহর্ষক ভাবে উপস্থাপন করি, পাক হানাদারদের নির্মমতাকে বুঝানোর জন্য ধর্ষণের কথা তুলে ধরি, কিন্তু যুদ্ধের পর তাদের সাথে কী ধরণের নির্মম আচরণ করেছি নিজেরা, এজন্য কি আমাদেরকে কেউ নির্মম- অকৃতজ্ঞ - বর্বর জাতি বললে, খুব বেশি ভুল বলা হবে?

বীরাঙ্গনার সংখ্যা নিয়েও আছে দ্বন্দ্ব। তখনকার সরকারি জরিপ মতে বীরাঙ্গনাদের সংখ্যা ২ লাখ। সেই সময়ের নির্যাতিত নারীদের গর্ভপাতের চিকিৎসার কাজে বাংলাদেশে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ডাক্তার জেফ্রি ডেভিস। নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও গ্রাম প্রতি গর্ভপাতের গড় হার হিসেব করে তিনি প্রমাণ করেছেন, এই সংখ্যা সাড়ে ৪ লাখের বেশি, যাদের বেশির ভাগেরই বয়স ছিল ২০ বছরের নিচে।
সাড়ে চার লাখ বীরাঙ্গনাদের অনেকেই হয়তো আজ বেঁচে নেই। যারা বেঁচে আছেন, তারা আজ মুখ লুকিয়ে থাকেন, বীরাঙ্গনা পরিচয় কাউকে জানাতে চান না। কারণ পাকিস্তানিদের বর্বরতা তাঁরা দেখেছেন, কিন্তু বর্বরতার দিক থেকে বাঙ্গালী জাতিও যে কোন অংশ কম নয়, সেটাও তাঁরা হাড়েহাড়ে টের পেয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ৪০ বছরের বেশি সময় পর আওয়ামীলীগ সরকার বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দিয়ে প্রাথমিক ভাবে ৪১ জন নারী মুক্তিযোদ্ধার নাম গ্যাজেট হিসেবে প্রকাশ করে, আরও ৫০০ জনের একটি তালিকা তদন্তাধীন রয়েছে। সরকারের উচিত দ্রুত সকল বীর নারীদের নাম প্রকাশ করে তাদের ভাতার ব্যবস্থা করা সাথে তাদের সন্তানদেরকেও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে, সকল সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা।

স্ব ভূমির জন্য আত্মত্যাগ লজ্জার নয়, গৌরবের। ইতিহাসে উপেক্ষিত এসব নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি হতে পারে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অনন্য দলিল।

এখন এসবের মূল নিয়ে কথা বলা যাক। কিছুদিন আগে সাবিরা নামের এক নারী মডেল আত্মহত্যা করেছে ঠিক একই কারণে। প্রভা-রাজীবের ঘটনা তো আমরা জানি, ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর সবাই ছি ছি করেছে প্রভাকে, রাজীবকে নয়। হ্যাপি-রুবেলের কাহিনীতে রুবেল কিন্তু আমাদের হিরোই থেকে গেছে, নষ্ট হয়েছে হ্যাপি।

ধর্ষণ সেটা মুক্তিযুদ্ধে করা হোক কিংবা স্বাধীন দেশে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ধর্ষিতা মানেই, ইজ্জত-সম্ভ্রম নষ্ট হওয়া এক নারী। পুরুষের ইজ্জত-সম্ভ্রম তাদের কর্মে, চিন্তায়, জ্ঞানে। নারীর ইজ্জতটা তবে কোথায় থাকে? কোন অসভ্য পুরুষের নষ্টামির ফল কেন একটি মেয়েকে বয়ে বেড়াতে হবে? দুজন মানুষের স্বেচ্ছায় যৌন মিলনে পুরুষের কিছু না হলেও নারীর ইজ্জত যায় কেন? কীভাবে?

এইসব প্রশ্ন দূর হয়ে যাবে, সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, নারীকে মানুষ ভাবতে পারলে। কোন অংশে কম মানুষ কিংবা দুর্বল প্রজাতির কিছু ভাবলে এসব সমস্যা চলতেই থাকবে। কিন্তু পুরুষের চিন্তার দৈন্যতার কারণে নারীকে আজও তারা মানুষ ভাবতে পারে না। আর কতকাল ‘আমরাও মানুষ’ ‘আমরাও পারি’ ‘নারী মায়ের জাত, মায়ের জাতকে সম্মান করো’ ইত্যাদি ন্যাকা ন্যাকা কথা বলে সম্মান ভিক্ষা চলবে? পুরুষের চেতন ফেরাতে হলে আঘাতের বিপরীতে পাল্টা আঘাতের বিকল্প কিছু আছে কি?
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুলাই, ২০১৬ দুপুর ১:১৫
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×