কোনো এক অজানা কারণে আমাকে একা দেখলেই নন্দ কাকুর শান্তশিষ্ট ভদ্র কুত্তাটা ঘেউঘেউ করতো।
তাই স্কুলে যাওয়ার বেলায় চাচ্চুর ঘুম না ভাঙলে চোখেমুখে কুত্তা-আতংকের ছাপ ফুটিয়ে সহজেই স্কুল ফাঁকি দিতে পারতাম।
চাচ্চু প্রায়ই বকাঝকা করে করে মা-ফুফুদের বলতেন,
'' তোমরা তো তারে চেনো না! আস্ত একটা শয়তানের ঘোড়া। কুকুরের চাইতেও তার লেজ বেশি বাকা।''
চাচ্চুর বকাঝকা আমার গায়ে লাগতো না। আসলে স্কুল ফাঁকি দেওয়ার আনন্দের কাছে ঐসব বকাঝকা নিতান্তই সামান্য ছিলো।
নন্দ কাকুর কুত্তাটার প্রতি আমার রাগের কোনো অন্ত ছিলো না। কারণ চাচ্চু কিংবা অন্যকেউ সাথে থাকলে, সে টু-শব্দ পর্যন্ত করতো না। অথচ আমাকে একা দেখলে হুদাই ঘেউঘেউ.... খেউ খেউ খেএএএউউউউ করে তেড়ে আসতো....
স্কুলের পথে যেতে যেতে একদিন চাচ্চুকে বললাম, তুমি বড় মানুষ; কুত্তা তোমাকে তাড়া করতে ভয় পায়।
চাচ্চুর জবাব, তাহলে সল্লুকে তাড়া করে না কেনো? সল্লু কি তোমার চাইতে অনেক বড়ো।
কথা সত্য। তাই আর কিছু না বলে চুপ করে শুনলাম।
চাচ্চু বলতে থাকলেন,
বড় ছোট ফ্যাক্ট না; কুকুরকে দেখে ভয়ে ঠ্যাং কাপলে কুকুরও মজা পায়। হাসে। কুকুরেরা মানুষের মতো হিহি করে হাসতে পারে না; তারা ঘেউঘেউ করে হাসে, হু হু করে কাঁদে আর রেগে গেলে ঘাউঘাউ করে....
২.
বর্ষার টানা বৃষ্টি আর পাহাড় থেকে নামা ঢলে রাস্তার দুপাশ পানিতে টইটুম্বুর। কয়েকদিন ধরে স্কুল টিস্কুল বন্ধ।
আমাদের বাড়ির প্রবেশ পথে, গ্রামের মেইন রাস্টার পাশেই একটা বিশাল তেঁতুলগাছ ছিলো। একবিকেলে বাশের ঠেঙা (লাঠি) দিয়ে সেই তেঁতুলগাছ থেকে তেতুল পাড়ছিলাম। হঠাৎ চোখ পড়লো নন্দু কাকুর কুত্তাটা ২০-২৫ ফুট দূরে দূরে দাঁড়িয়ে ভীতসন্ত্রস্ত চোখে আমারকে দেখছে। আমিও মনযোগ সহকারে কিছুক্ষণ কুত্তার মনস্তাপ বুঝবার চেষ্টা করলাম।
মনে হলো- হাতে বাশের ঠোঙ্গা দেখে কুত্তা মহাশয় বাশ আতংকে ভুগছে। মাঠঘাট পানিতে ভরপুর থাকায় তার(কুত্তার) বাড়ি ফেরারও আর বিকল্প কোনো রাস্তা নেই।
কুত্তার অসহায়ত্ব দেখে মনের মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে উঠলো। শালাকে শিক্ষা দেওয়া এর চাইতে ভালো সুযোগ আর পাবো না।
হাতের বাশটা নিয়ে কুত্তার দিকে তেড়ে গেলাম। কুত্তা আত্মরক্ষার্থে কিছুটা দূরে সরে আমার দিকে মুখ করে বললো, ঘেউ (একবার)
'ঘেউ' শুনে গতি আরো একটু বাড়িয়ে বাশ উঁচিয়ে তেড়ে যেতে যেতে বললাম, আবার ঘেউ কয়? শালা.... দাড়া...
এবার কুত্তা 'খিইইই খিক....' টাইপ আওয়াজ করে অনেকদূরে চলে গেলো। এবং আমার দিকে মুখ করে পথে বসে রইলো।
কুত্তাকে ধাওয়া করতে পেরে উৎফুল্ল মনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবলাম,
যাক শালা কুত্তাকে শিক্ষা দিতে পেরেছি। এখন আমাকেও সে ভয় পাবে। রাস্তায় একা দেখলে অকারণে ঘেউঘেউ, খেউ খেউ করার না; তেড়ে আসবে না।
সাপ্তাহখানেক পর পানি কমে গেলে স্কুল টিস্কুল পুনরায় শুরু হলো। এক সকালে একাএকা স্কুলে যাচ্ছি। হাতে ছোটখাটো একটা বাশের ঠেঙ্গা।
যদিও মনেমনে বিশ্বাস ছিলো- কুত্তা আমাকে ভয় পাবে; তবুও হাতে করে বাশের ঠোঙা নিয়ে গিয়েছি। বলা তো যায় না, একলা পেয়ে যদি আক্রমণ করে!
সেদিন নন্দ কাকুর বাড়ির কাছাকাছি যেতেই কুত্তা জোরেশোরে ঘেউঘেউ, খেউ খেউ শুরু করলো। আমি ভেতরে ভয় পেলেও বাহিরে সাহস দেখানোর চেষ্টা করে করে এগুলাম। হাত উঁচু করে বাশের ঠেঙ্গা দেখালাম। ভাব এমন, যেন আজ সামনে পেলে কুত্তাপেটা পেটাবে।
হাত উঁচিয়ে বাশ দেখানোতে সম্ভবত কুত্তা আরো রেগে গেলো। এবং নন্দকাকুদের বাড়ির গেইটের কাছে যেতেই 'ঘাউঘাউ' করে তেড়ে এলে আমি ঘাবড়ে গিয়ে লাঠি ফেলে দিলাম এক ভো দৌড়।
অত:পর, কুত্তা একদম কাছাকাছি চলে এলে ব্যাঘ ফেলে দিলাম পানিতে ঝাপ। রাস্তার পাশের ধানে মাঠে তখনো, হাটুর উপরে জল। কুত্তা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘাউঘাউ, খেউখেউ, ঘেউঘেউ করতে লাগলো।
মিনিট দশের পর, পাড়ার এক বড়ভাই কুত্তার হাত থেকে উদ্ধার করে বাড়ি পর্যন্ত পৌছিয়ে দিলো।
কুত্তা আতংক, জোকের কামড়, জলে গড়াগড়ি... সব মিলেমিশে একাকার হয়ে রাতে জ্বল চলে এলো।
তারপর থেকে রোজ ছোটচাচা স্কুলে নিয়ে যেতেন, আবার ছুটি হলে নিয়ে আসতেন।
মাস দুয়েক পর, হঠাৎ কুত্তাটা নিখোঁজ হয়ে গেলো। নন্দ কাকু অবশ্য দুঃখভরা মনে মাঝেমধ্যে আমাদের বাড়ি এসে বলতেন,
তিনি জানতে পেয়েছেন তিনার শান্তশিষ্ট ভদ্র কুত্তাটা গুম হয়ে যাওয়ার পেছনে ছোটচাচা জড়িত।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুলাই, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:৩০