আমি পড়াশুনা, কম্পিউটার আর বন্ধুবান্ধবের বাইরে তেমন কিছু জানি না। আমি সংবাদও দেখি না, সংবাদ পত্রও পড়িনা। কিন্তু গত কয়েক দিনে কিছু ঘটনা আমাকে বেশ উদ্বীগ্ন করেছে। তার মধ্য আছে আমার টিউশানিগুলা বন্ধ হয়ে যাওয়া। তারপরই জানতে পারলাম যে সরকার নীতিমালা করে টিউশানি/কোচিং বন্ধ করে দিয়েছে। তাই একজন ছাত্র হিসেবে কিছু কথা বলতে চাই।
ইদানিং প্রাইভেট/কোচিং এর প্রোকোপ খুবই বেড়ে গেছে। বড়দের সাথে সাথে ক্লাস ১/২ এর বাচ্চারাও যেভাবে সকাল সন্ধ্যা কোচিং-এ দৌড়ায় তা সত্যি আশ্চর্যজনক। এটা নিয়ন্ত্রন করার জন্য সরকারের নীতিমালার সাদুবাদ জানাই। কিন্তু এই নীতিমালা একটু বেশি বেশি হয়ে গেছে বলে মনে করি।
এখন চিন্তা করতে হবে ছেলেমেয়েরা টিউশানি কেন পড়তে যায়। এ নিয়ে আমার কিছু ভাবনা:
প্রথমত, ঝোকে উঠে! হ্যা, এখন অনেক বাবা-মাই মনে করে “আরে বাচ্চাকে কোচিং-প্রাইভেট না পড়ালে কি সে অন্যদের সাথে তাল মেলাতে পারবে?” আর এ জন্যই তারা সকাল থেকে রাত অবধি বাচ্চাকে নিয়ে এই কোচিং-এ সেই স্যারের বাসায় ছোটাছুটি করেন। কিন্তু চিন্তা করেন না যে এসবের আদৌ দরকার আছে নাকি।
আর একটি কারণ হল কিছু অসৎ শিক্ষক। কিছু শিক্ষক আছেন যারা স্কুল/কলেজে সরাসরি বা কৌশলে তার প্রাইভেটে আসতে বলেন। তার কালে না পড়লে পরীক্ষায় নাম্বর দেন না। আমার এক খালাত বোনের মেয়ে ক্লাস টু তে পড়ত। ফাইনালে সে দ্বিতীয় হয় কারণ ড্রয়িং স্যার এর কাছে প্রাইভেট না পড়ায় তাকে কম নম্বর দেয়া হয়েছিল। নাহলে সে প্রথম হতো!
হ্যা, এই দুই ধরনের প্রাইভেট/কোচিং অবশ্যই বন্ধ করা উচিৎ এবং কড়া ভাবেই বন্ধ করা উচিৎ। কিন্তু এই দুই কারণ ছাড়া কি কেউ প্রাইভেট পড়ে না বা পড়ায় না?
সব শিক্ষক টাকার জন্য টিউশানি পড়ায় না, শিখানোর জন্যও পড়ায়। আমি যে ৩ জন শিক্ষকের কাছে টিউশানি পড়ি (বা পড়তাম!!) তারা তেমনি কিছু শিক্ষক। আমি মনে করি তাদের কাছে না পড়লে আমি অনেক কিছু শিখতে পারব না বা মিস করব।
আমি খুব ভাল ছাত্র না হলেও দাবি করতে পারি যে আমি খারাপ না। আমি যা পড়ি বুঝে পড়ে এবং শিক্ষকদের এক প্রিয় ছাত্র। না আমি অহংকার করার জন্য বলছি না, আমার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার আগে আমার সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। আমি আমার ছাত্র জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে ক্লাস ১০ পর্যন্ত অর্থাৎ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত কোন রকম প্রাইভেট/কোচিংয়ের কোন দরকার নেই। কেউ যদি বাসায় বসে থেকে নিজ ইচ্ছা ও আগ্রহ থেকে পড়তে চায় সে অবস্যই পারবে। শুধু মাঝেমধ্যে কিছু না বুঝলে স্কুলে শিক্ষকের কাছেই জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে পারবে। স্কুলের সিলেবাসও তেমন বড় নয় তাই ধীরে নিজে বুঝে পড়তে তেমন কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু কলেজেও কি তাই?
কলেজের সিলেবাস অনেক বড়। কিন্তু সে সাপেক্ষে সময় অনেক কম। এই বিশাল সিলেবাস কলেজে ক্লাসে শেষ করা কখনই সম্ভব না। শুধু পরীক্ষায় যতটুকু লাগে ততটুকুই ক্লাসে পড়ানো হয়। এটা কোথাও ব্যতিক্রম নয়, না কোন সরকারী কলেজে, না কোন বিলাশ বহুল বেসরকারী কলেজে। কেলেজে সবচেয়ে ভাল পড়িয়ে যতটুকু করা সম্ভব তা হলো উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভাল ফল করার মত পর্যয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু আমি যদি জানতে চাই? আমি যদি এই সিলেবাসের সব শিখতে চাই? আমার যদি জানার ও শিখার আগ্রহ থাকে সে আগ্রহ মিটাবে কে?
আমার আগে একটা ভ্রান্ত ধরনা ছিল যে বই পড়ে নিজেই সব শিখা যায়। হ্যা, স্কুল পর্যয়ে সটা সম্ভব হলেও কলেজ পর্যায়ে সটা সম্ভব না। উচ্চ মাধ্যমিকের পদার্থ, রসায়ন, গণিতের যত লেখকের বই আছে সবই হয় misleading না হয় অসম্পূর্ণ! আমার এখনও মাঝেমাঝে এই রসায়ন বই দেখলে রাগ হয়, কিভাবে এত ভুল তথ্যা থাকতে পরে! আবার কখনও কখনও অনেক বিষয়ের উপর দিয়ে উড়ে উড়ে চলে যায়, পরিষ্কার ভাবে কিছু বলে না। তাহলে আমরা কিভাবে শিখব? (আমি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র, তাই অন্যগুলোর কথা জানি না)
আমি যেই শিক্ষকের কাছে পদার্থ পড়ি তিনি শুধু পড়ান না আমাদের চিন্তাশিলতা শেখান। আমাদের সিলেবাসের বিষয় এবই এগুলো বুঝতে সংস্লিষ্ট সবই বুঝান। এই সংস্লিষ্ট বিষয় গুলো কলেজে বুঝানোর মত সময় কোথায়? তাছাড়া আমাদের কোন কোন বিষয় জানা দরকার সেটা নিজে থেকে জানার জন্যও তো দিক নির্দেশন এবং ভাল বইয়ের দরকার। সবকার কি সেগুলোর ব্যবস্থা করেই টিউশানি বাতিল করেছেন? জানতে চাই।
আমাদের অনেক বড় ভাইয়ারা সুন্দর শিক্ষা প্রসারের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন (যেমন, রমানুজান গণিত সঙ্ঘ)। কিছুটা নলেজ ক্যাম্পিং এর মত। আমার প্রশ্ন ভাইয়ারা যদি এরকম করতে পারে তবে কেন শিক্ষকরা পাবেন না? কেন সে সব শিক্ষককে সুযোগ দেয়া হবে না যারা শুধু না পড়িয়ে সত্যি কিছু শেখায়? যাদের এক একটি প্রাইভেট এক একটি নলেজ ক্যাম্প। কারণ একটাই, তারা ভাইয়া না, তারা শিক্ষক? কারণটা আমার কাছে খুব একটা যুক্তিসই মনে হয় না!
আমি একজন শিক্ষকের কাছে গণিত পড়তাম। উনি শুধু ঢালাও সমাধান তুলে না দিয়ে সমস্যাটা কোথা থেকে আসলো, থিওরিগুলো কোথা থেকে আসলো সব বুঝান। উনার ল্যাপটপ এনে বিভিন্ন গ্রাফ দেখান। সেগুলো কিভাবে তৈরি হলো, ইত্যাদি একদম আমাদের ভিতর থেকে অনুভব করান। আমার না হল কম্পিউটার আছে, আমি ইচ্ছা করলেই সেগুলো দেখে ভালভাবে চর্চা করতে পারি। কিন্তু যাদের নেই তাদের কেন বঞ্চিত করা হবে? তারা কেন কোন কিছু ভেতর থেকে উপলব্ধি করে শিখতে পারবে না?
আসলে বিষয়টা এমন হয় দাড়িয়েছে যে, কোন এক দেশে চোরের প্রাদুর্ভাব খুবই বেড়ে গেছে। রাজা গোপন সূত্র(?) জানতে পারল যে চোরগুলো সবাই ভাত খায়! তাই তিনি তার রাজ্যে ভাত খাওয়া নিশিদ্ধ ঘোষনা করলেন যেন না খেয়ে চোরেরা মারা যায়। হ্যা, চোরের ঠিকই মরল কিন্তু সাথে রাজ্যের সাধারন গরিব জনগনও মারা গেল যারা শুধু ভাত খেয়েই থাকত। শুধু সেই রুই-কাতলারাই বেঁচে থাকল যারা ভাতের মত তুচ্ছ খাবার না খেয়ে পোলাও-চাইনিজ খায়।
এই পরিস্থিতি থাকলে দেখা যাবে শুধু ধনীরাই শিক্ষকদের অনেক টাকা দিয়ে বাসায় নিয়ে সন্তানদের প্রাইভেট পড়াতে পারবে। শুধু তারাই শেখার সুযোগ পাবে। আর আমাদের মত ছাত্ররা এই নাজেহাল বইপুস্তক পড়ে কষ্ট করে যতটুকু শেখার চেষ্টা করব তার অনেকটাই হবে ভুলে ভরা।
শেষে,
আমরা যদি শিখতে চাই তবে কেন আমাদের শিখতে দেয়া হবে না?
কেন আমাদের শুধু পাশ করা পড়াশুনা করতে হবে?

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



